রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডির নেপথ্যে সেই ‘জকরিয়া চক্র’
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:৩৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভোটার করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘বড় ধরনের’ দুইটি সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার তথ্য প্রাথমিক অনুসন্ধানে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে একটি সিন্ডিকেট হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ‘বিতর্কিত’ কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়ার আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে গড়া ওঠা চক্র। আরেকটি সিন্ডিকেটে শাহনেওয়াজ নামে এনআইডি প্রকল্পে যুক্ত এক কর্মচারীর তথ্য পেয়েছে দুদক।
রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাওয়া নিয়ে গত রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) তাৎক্ষণিক অভিযানে নামে দুদক চট্টগ্রামের এনফোর্সমেন্ট টিম। এরপর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নাল আবেদীনসহ তিন জনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। নির্বাচন কমিশনের খোয়া যাওয়া যে ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সরবরাহ করেছে জয়নাল, সেটিও উদ্ধার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের এনআইডি: ইসি কর্মীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুর্নীতি কমিশনের উপপরিচালকের (এনফোর্সমেন্টের) কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। দুদকের চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের-২ উপসহকারী পরিচালক মো.শরীফ উদ্দিন এই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
জানতে চাইলে শরীফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানে আমরা পেয়েছি, নির্বাচন কমিশনের দুইটি বড় ধরনের সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়া ও ভোটার করার সঙ্গে যুক্ত। দু’টি সিন্ডিকেটে ১৫ থেকে ২০ জন আছেন, যাদের সঙ্গে বড় বড় রাঘববোয়ালরাও জড়িত। আমরা বিস্তারিত অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়েছি। কমিশন অনুমোদন দিলেই দ্রুত কাজ শুরু করব।’
দুদক ও চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেফতার হওয়া ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন (৩৪) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ জলদী গ্রামের আবদুল মোনাফের ছেলে।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের এনআইডি ‘প্রাপ্তিতে’ ইসির কেউ জড়িত নয়, দাবি কমিশনারের
এই জয়নালের অন্তত ১০ জন আত্মীয় চাকরি করছেন নির্বাচন কমিশনে। ২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন জয়নাল। একই সময়ে তার ভগ্নিপতি নুর আহমদও যোগ দেন অফিস সহায়ক পদে। নুর আহমদ এখনো আছেন চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে। আবার কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী মো. মোজাফফর গ্রেফতার জয়নালের খালাত ভাই। রাঙ্গামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী মোহাম্মদ আলীও জয়নালের নিকটাত্মীয়। আর কমিশন সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওসমান গণি এই মোহাম্মদ আলীর ভাগ্নে।
এছাড়া গ্রেফতার জয়নাল আবেদীন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ জকরিয়ার ভাগ্নে। জয়নাল ও জকরিয়া— দু’জনের বাড়িই বাঁশখালী উপজেলায়। জয়নালের আত্মীয়-স্বজন যারা নির্বাচন কমিশনে চাকরি করছেন, তাদের অধিকাংশের বাড়িও বাঁশখালীতে।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডি, ইসি কর্মীসহ তিনজন রিমান্ডে
দুদকের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জয়নাল আবেদিন ও তার আত্মীয়-স্বজনরা ইসিতে নিয়োগ পেয়েছেন ২০০৪ সালে। সেসময় কমিশনে জকরিয়া সাহেবের খুব প্রভাব ছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে জকরিয়া সাহেবের প্রভাব ছিল। রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়ার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত দুদকের কাছে যাদের জড়িত থাকার তথ্য এসেছে, তারাও জয়নাল ও তার আত্মীয়স্বজনরাই। অনুমতি পেলে এসব বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হবে।’
আশির দশকের মাঝামাঝিতে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়া মোহাম্মদ জকরিয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে খুবই ক্ষমতাধর হিসেবে আলোচনায় আসেন। ওই সময়কার যুগ্ম সচিব জকরিয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিতর্কিত ‘এম এ আজিজ কমিশনের’ অধীনে ভারপ্রাপ্ত সচিব হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের আন্দোলনের সময় বিচারপতি আজিজ কমিশনের পদত্যাগের সঙ্গে সচিব জকরিয়াকে অপসারণের দাবিও উঠেছিল। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে জকরিয়াকে ওএসডি করে। প্রায় ১০ বছর ওএসডি থাকার পর জকরিয়া ২০১৭ সালে অবসরজনিত ছুটিতে যান।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডি, গলদ নির্বাচন কমিশনেই
রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতিতে আত্মীয়স্বজনদের সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ জকরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। আমি দীর্ঘদিন ভারতে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ছিলাম। আজ (বুধবার) ফিরেছি। ইসিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, এসব বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই।’
গ্রেফতার হওয়া জয়নালের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান জকরিয়া। অনুরোধের একপর্যায়ে বলেন, ‘আমার বাড়ি বাঁশখালীতে। সেখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন আছে। কারও বিষয়েই আমি কিছু জানি না। মাত্র দেশে এসেছি। আস্তে আস্তে হয়তো জানতে পারব।’
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডি, ইসি কর্মচারীসহ আটক ৩
জয়নালের স্বজনদের বাইরে আরও একটি চক্রের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পেয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই চক্রের সঙ্গে আছে এনআইডি উইংয়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট শাহনেওয়াজ ও তার কমপক্ষে ১৬ জন স্বজন। এদের সবাই স্থায়ী ও আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনে কর্মরত আছেন।
এদিকে, দুদক থেকে পাঠানো প্রাথমিক অনুসন্ধানে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও এনআইডি পাইয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের অনুসন্ধানেরও অনুমতি চেয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গারা কিভাবে এনআইডি-পাসপোর্ট পাচ্ছে, অনুসন্ধানে দুদক
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সাল থেকে কতজন রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন ও এনআইডি পেয়েছেন, নির্বাচন কমিশন এর আগে কাউকে শনাক্ত করতে পেরেছিল কি না, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তদন্ত হয়েছিল কি না, তদন্ত হলে কী কী তথ্য তারা পেয়েছিলেন, এই চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত— এসব বিষয় এবং তাদের সম্পদের অনুসন্ধানের অনুমতি চাওয়া হয়েছে প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
দুদকের হাতে এনআইডি পাওয়া ৬৭ রোহিঙ্গার তথ্য
চট্টগ্রাম জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে ইস্যু হওয়া ৬৭ জন রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দুদকের হাতে এসেছে। কমিশনে পাঠানো প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই ৬৭ জনের বিষয়ে এখন বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য অনুমতির অপেক্ষায় আছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা নির্বাচন অফিসের ফরম-২-এ লিপিবদ্ধ ৬৮ জন ভোটারের তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু একজন বাংলাদেশি। মোস্তফা কামাল নামে এই ব্যক্তি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা এবং গ্রেফতার হওয়া ইসিকর্মী জয়নাল আবেদীনের আত্মীয়। বাকি ৬৭ জনই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা।
নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা ৪৩৯১ ও ০৩৫১ নম্বরের দু’টি ল্যাপটপ থেকে সার্ভারে তাদের তথ্য ইনপুট দেওয়া হয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জেনেছেন দুদক কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, এই দু’টি ল্যাপটপ নির্বাচন কমিশনে নেই। গত ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনীর হোসাইন খান দুদকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ৪৩৯১ নম্বরের ল্যাপটপটি ২০১৪ সাল থেকে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, তিনি উল্লেখ করেননি।
নির্বাচন কর্মকর্তা ৪৩৯১ নম্বরের ল্যাপটপ নিয়ে এই দাবি করলেও দুদক কর্মকর্তাদের দাবি, গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়া রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদকে ২০১৬ সালে এনআইডি দেওয়া হয়েছিল ওই নম্বরের ল্যাপটপ থেকেই। খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহার করে কিভাবে নূর মোহাম্মদকে এনআইডি দেওয়া হলো, অনুমতি পেলে সেটাও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হবে।
নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজে লাকী নামে যে রোহিঙ্গা নারীর তথ্য পাওয়া গেছে, তার ফরম নম্বর ছিল ৪১৮৬৬৩৬৮। নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের ধারণা ওই নিবন্ধন বইয়ের ৪১৮৬৬৩৬০ খেকে ৪১৮৬৬৩৯৩ নিবন্ধন ফরম নম্বরের সবাই রোহিঙ্গা। ৪১৮৬৬৩৬০ নম্বর নিবন্ধন ফরমের ফয়জুল্লাহ নামের ব্যক্তির। তিনি কক্সবাজার ইসলামপুরের বাসিন্দা হলেও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তবে দুদক কর্মকর্তারা জানান, কোন ল্যাপটপে তারা ভোটার হয়েছে, সেটি বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হবে ঢাকার অনুমতি পেলে।
দুদক কর্মকর্তারা আরও জানান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ছয়টি ল্যাপটপ খোয়া যাওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে দুদকে। এর মধ্যে ২০১২ সালে চন্দনাইশ উপজেলার চারটি এবং রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই থেকে দুইটি ল্যাপটপ খোয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনীর হোসাইন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চন্দনাইয়ে চারটি ল্যাপটপ হারিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনায় দু’জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। তারা গ্রেফতার হয়ে পরে জামিনে বেরিয়ে আসে। ওই মামলায় অভিযোগপত্রও দিয়েছে পুলিশ। আরও একটি ল্যাপটপ জেলা বা উপজেলা অফিস থেকে হারিয়ে গেছে। সেটার কোনো হদিস আমরা পাচ্ছি না।’
এনআইডি এনআইডি জালিয়াতি জকরিয়া চক্র নির্বাচন কমিশন রোহিঙ্গাদের এনআইডি