Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘মালেকে’র পাজেরো গাড়ির মালিক কে, চাবি কই?


২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৭

ঢাকা: স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনের সামনেই পড়ে আছে সাদা রঙের একটি পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯)। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে গাড়িটি এখানে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদল চালাতেন এই গাড়িটি। সেই মালেকের বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য এরই মধ্যে বেরিয়ে আসায় তিনি এখন কারাগারে। তবে সেই কোটি টাকার এই গাড়িটি এখন পড়ে রয়েছে বলতে গেলে ‘অভিভাবকশূন্য’ হয়ে। গাড়িটি অধিদফতরের সামনে পড়ে থাকলেও গাড়ির চাবি বা লগবুক কার কাছে— সে তথ্য বলতে পারছেন না কেউ। এই গাড়ির জ্বালানি তেল বাবদ কত টাকা খরচ করা হয়েছে বা সেই খরচ কে দিয়েছে— সে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছেন না খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেউই।

বিজ্ঞাপন

গাড়িচালক আবদুল মালেক গ্রেফতার হওয়ার পর তার অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে সারাবাংলাতেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত কাগজে-কলমে তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ডা. এনায়েত হোসেন বর্তমানে যে টয়োটা ভিগো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৩৯৫১) গাড়ি ব্যবহার করেন, সেটির চালক হারুন। এর আগে এনায়েত হোসেন যখন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ছিলেন, তখন তার গাড়ির চালক ছিলেন আবদুল মালেক। সেই সময় ডা. এনায়েত হোসেনের জন্য বরাদ্দ ছিল ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯ নম্বর প্লেটের সাদা রঙের পাজেরো জিপ, যা চালাতেন মালেক।

বিজ্ঞাপন

পরে ডা. এনায়েত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেলে নতুন গাড়ি ব্যবহার করতে থাকেন। ওই সময় থেকেই সাদা পাজেরো জিপটি ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছেন আবদুল মালেক, যার লগবুক বা চাবির কোনো তথ্য কেউই দিতে পারছেন না।

গাড়িচালক মালেককে নিয়ে আরও খবর-

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাজেরো গাড়িটি দিয়ে মালেক নিজের ডেইরি ফার্মের দুধ নিয়ে আসতেন। অফিসে ঢুকানোর আগে গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে পরে অফিসে আসতেন তিনি। এই ঘটনা অফিসের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। কারণ বড় কর্মকর্তাদের খুব কাছের মানুষ মালেক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে বেশকিছু নতুন গাড়ি কেনা হয়। তার মধ্যেই ছিল ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯ নম্বর প্লেটের এই পাজেরো গাড়িটি। এটি কেনা হয় অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) অধীনে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, নতুনভাবে আসা গাড়িগুলোর মধ্যে চারটি গাড়ি বরাদ্দ হয় একটি প্রোগ্রামের অধীনে। পদাধিকার বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্যই নতুন গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে, যেহেতু তাদের জন্য পুলের কোনো গাড়ি নেই। সেই অনুযায়ী ২০১০ সালে ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯ নম্বর প্লেটের গাড়িটি বরাদ্দ হয় অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) জন্য, যার চালক ছিলেন আবদুল মালেক। ২০১৪ সালে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যখন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদে যোগ দেন, ওই সময় তিনি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) গাড়ি ব্যবহার করতেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই কর্মকর্তা বলেন, পরে ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) এই গাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে নতুন একটি নির্দেশনা আসে। সেখানে বলা হয়, সিডিসি থেকে পাঁচ কোটি টাকার বেশি তেল বাবদ খরচ করা যাবে না। পরে আরেক নির্দেশনায় বলা হয়, গাড়ি সিডিসির হলেও এনসিডিসি থেকে গাড়িটির তেল ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দেওয়া হবে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন মহাপরিচালক (শিক্ষা) হিসেবে নিয়োগ পেলেও তিনি এই গাড়িটিই ব্যবহার করতেন। কারণ তখন তিনি মহাপরিচালক হিসেবে নতুন গাড়ি পাননি। পরে তিনি নতুন গাড়ি পেলে সেটি ব্যবহার করতে থাকেন, যার চালকও ছিলেন আবদুল মালেক, তবে ওই সময় থেকে তিনি পাজেরো গাড়িটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে থাকেন।

ওই কর্মকর্তার তথ্য, সম্প্রতি অধিদফতর থেকে ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের কাছে পাজেরো গাড়িটির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, গাড়িটি জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য অধিদফতরের কোথাও সংরক্ষিত নেই। আবার গত ১৬ সেপ্টেম্বর আবদুল মালেক গাড়িটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনের সামনে রেখে গেছেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে সেই গাড়ির চাবি ও লগবুকের সন্ধান কারও কাছে নেই।

ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯ নম্বর প্লেটের গাড়িটির চাবি কার কাছে, গাড়ির লগ বুক কার কাছে, গাড়িটির জ্বালানি খরচ কে দিত— এসব প্রশ্ন নিয়ে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু পাওয়া যায়নি কোনো উত্তর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরে নিচতলায় বসেন প্রতিষ্ঠানটির পরিবহন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমি পুলে থাকা ১৮টি গাড়ির বিষয়ে জানি। কিন্তু বাকি গাড়িগুলোর বিষয়ে কিছু জানি না। এর বাইরের গাড়িগুলো প্রকল্পের হয়ে থাকলে সেগুলো সম্পর্কে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। আবদুল মালেক আমার অধীন পুলে থাকা কোনো গাড়ি ব্যবহার করতেন না। তবে গাড়িটি সিডিসির, তাই সেখান থেকেই এই গাড়ির সব তথ্য পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে জানতে সিডিসি’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসীর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে এই বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, গাড়িটি সিডিসি নয়, এনসিডিসি প্রোগ্রামের অধীনে। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন এনসিডিসি’র কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমানও এ বিষয়ে জানতে এনসিডিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

এনসিডিসিতে গিয়ে জানা গেল, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গাড়িটির তেলের খরচ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরে গাড়িটি কে ব্যবহার করেছিল, কার কাছে ছিল— এরকম কোনো তথ্য তাদের কাছেও নেই। গাড়ির চাবি কার কাছে, তাও জানা নেই তাদের। সেখানকার কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতেও রাজি হননি।

পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. আফরিনা মাহমুদ, পরিকল্পনা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান ও হিসাবরক্ষক সুনীল কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। কিছু জানতে হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেল থেকে বক্তব্য নিতে হবে জানান তারা। পরে ২১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেলে যোগাযোগ করে গাড়িটির তথ্য জানতে লিখিত আবেদন করেন সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। আজ ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি মিডিয়া সেলের কাছ থেকে।

এর মধ্যে বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় সারাবাংলার পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, আমি এই বিভাগে নতুন এসেছি। আবদুল মালেকের আগে কী করেছেন, সে বিষয়ে তাই তেমন কিছু বলতে পারছি না।

তিনি বলেন, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরে গাড়িচালক আবদুল মালেককে ন্যস্ত করা হয়। তবে তার বেতন ভাতা হতো স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে। তাই গাড়িটির চাবি ও লগবুক বর্তমানে কার কাছে বা কার কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এসব তথ্য আমি বলতে পারব না।

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের মোবাইল নম্বরে দফায় দফায় কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

এর আগে, গত ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র, জালনোটের ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব-১-এর একটি দল স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেককে গ্রেফতার করে। র‌্যাব জানায়, জাল টাকার ব্যবসা ছাড়াও তিনি এলাকায় চাঁদাবাজিতে জড়িত। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারের পর বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে ঢাকায় তার সাতটি প্লটে চারটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।

কোটি টাকার গাড়ি গাড়িচালক মালেক ড্রাইভার মালেক পাজেরো জিপ স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর