বিজ্ঞাপন

বাবার নামে মাজার বসিয়েও জায়গা দখল করেছেন মালেক!

September 21, 2020 | 11:41 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: আবদুল বারী। পেশাগত জীবনে ছিলেন সচিবালয়ের পিয়ন। ২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। এরপর তার নামে টঙ্গীর কামারপাড়া এলাকায় একটি মাজার গড়ে তোলেন তারই সন্তান স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদল। মাজার শরীফের নাম দিয়েছেন শাহ সূফী আলহাজ আবদুল বারী মাইজভান্ডারী। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে তারা অভিযোগ করেন, জায়গাটি দখল করে মাজার বানানো হয়েছে। আবদুল মালেকের ছেলের বিলাসবহুল জীবন সম্পর্কেও অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, আবদুল বারী মাইজভান্ডারী নামে কাউকে চিনতেন না তারা। আগে এখানে একটি ডেইরি ফার্ম ছিল। এটির দেখাশোনা করতেন আবদুল বারী নামে একজন। তিনি সচিবালয়ে পিয়নের চাকরি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই এখানে গড়ে উঠেছে মাজার। প্রথম দিকে কয়েকজন প্রতিবাদ করলেও পরবর্তী সময়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় আর কেউ কথা বলেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র বাবার নামেই নয়, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জায়গা দখল করার জন্য নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতেন আবদুল মালেক। তার সন্তান ইমন পড়াশোনা করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা মেট্রো-ল ২০-৯৫৪৪ নম্বর প্লেটের একটি গাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতো সে। র‍্যাব জানায়, অভিযানের সময় মালেকের ছেলের ঘর থেকে ইয়াবা সেবনের আনুষাঙ্গিক বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায়।

পেশায় গাড়ি চালক আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের (শিক্ষা) গাড়ি চালানো ছিল তার দায়িত্ব। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়ির ড্রাইভার পদে আছেন। কিন্তু সেই গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদল। ব্যক্তিগতভাবে তিনটি প্লটের মালিক এই আবদুল মালেকের রাজধানীতে রয়েছে বিভিন্ন স্থানে একাধিক বাড়ি ও গাড়ি। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হওয়া আবদুল মালেক জিজ্ঞাসাবাদে নানা অপকর্মের কথা স্বীকার করেছেন।

বিজ্ঞাপন

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেকের ঢাকায় সাতটি প্লটে চারটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব দিলোয়ার বখত।

তিনি বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে যদি জ্ঞাতআয়বর্হিভূত সম্পদ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে সম্পদ পাওয়া গেলে তার বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি কমিশনে যে সম্পদবিবরণী দাখিল করবেন সেটি পরে যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া প্রাথমিক অনুসন্ধানে মালেকের ঢাকায় সাতটি প্লটে চারটি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে দুদক। তারা যদি সম্পদবিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সম্পদের হিসাব মেলাতে না পারলে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত মামলা হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গাড়ি চালক আব্দুল মালেক দীর্ঘদিন ধরে অধিদফতরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বিশেষ করে অধিদফতরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য তার প্রধান কাজ। কোনো কর্মকর্তা যদি আবদুল মালেকের সুপারিশ না শোনেন তাহলে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটিয়েছেন একাধিকবার।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

কর্মকর্তারা লোকলজ্জার ভয়ে এসব বিষয় কখনও প্রকাশ করেননি। নিজে অধিদফতরের একজন গাড়ির চালক হয়েও আ. মালেক একটি পাজেরো জিপ ব্যবহার করেন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিন প্রিয় তিনি পরিচালনা করেন। তার রয়েছে তেল চুরির সিন্ডিকেট, স্বাস্থ্য অধিদফতরের যত গাড়ির চালক তেল চুরি করে, তার একটি অংশ তাকে দিতে হয়। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি পুরো অধিদফতর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পেশায় একজন গাড়ি চালক মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদলের রাজধানীর হাতিরপুলে আবদুল মালেকের সাড়ে চার কাঠা জায়গার উপরে দশতলা ভবন নির্মানাধীন। তুরাগ থানা এলাকায় ছয় কাঠা জায়গায় সাত তলার দুইটি ভবনে ২৪টি ফ্ল্যাট আছে। এছাড়াও একই এলাকায় আছে প্রায় ১০ থেকে ১২ কাঠার প্লট। সেইসঙ্গে দক্ষিণ কামারপাড়ার ১৫ কাঠা জায়গায় একটি ডেইরি ফার্ম আছে আবদুল মালেকের।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধুমাত্র মহাপরিচালকের গাড়িই নয়, আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি পিক আপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো- ঠ- ১৩-৭০০১) নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রির কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এই গাড়িটি মাহবুব নামে একজন চালক চালিয়ে থাকেন। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৬৭৪১) পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহার করতেন আবদুল মালেক। এই গাড়িটিও কামরুল নামে একজন চালককে দিয়ে ব্যবহার করাতেন তিনি।

এর আগে শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর হাতিরপুলে আবদুল মালেকের সাড়ে চার কাঠা জায়গার উপরে নির্মানাধীন দশতলা ভবনে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে জানা যায়, মামলাজনিত কারণে আদালতের নির্দেশে ভবনের কাজ আপাতত বন্ধ আছে।

আবদুল মালেকের দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তার গৃহিনী। এই পরিবারের আবদুল মালেকের তিন মেয়ে ও এক ছেলে আছে। বড় মেয়ে বেবির স্বামী স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনের দায়িত্বে আছেন। ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের দ্বিতীয় মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অফিস সহকারী পদে চাকরি নিয়ে দেন আবদুল মালেক। একমাত্র ছেলে ইমন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আবদুল মালেকের দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইব্রেরিতে বুক সর্টার পদে কর্মরত আছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মালেকের কাচ্ছে জিম্মি ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংখ্য কর্মকর্তা। শুধুমাত্র বর্তমান শিক্ষা ডিজিই না বরং আগের যত ডিজি ছিল তারাও তাকে সম্মান দিয়ে চলতো। কারণ মালেকের প্রভাব বিস্তৃত ছিল গণমাধ্যমেও। মালেকের সিন্ডিকেটের কারও বিরুদ্ধে কিছু হলেই বিভিন্ন মিডিয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতো; যেখানে ওই কর্মকর্তাদের চরিত্র হনন করা হতো। এই ভয়েও কর্মকর্তারা চুপ থাকতো। মূল সারির গণমাধ্যমের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গেও ছিল এই মালেকের যোগাযোগ। সবকিছু মিলিয়ে আসলে কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পেত না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ক্ষমতা নিয়েই অধিদফতরের চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিল আবদুল মালেক। একজন পরিচালক তার বিরুদ্ধে অডিটের চেষ্টা করলে সেটিও তিনি করতে পারেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারণে। যে কারণে আবদুল মালেক কোন গাড়ি ব্যবহার করতো, কীভাবে তেল খরচ করতো তা নিয়ে খুব একটা বেশি ভাবার অবকাশ ছিল না।’

শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি ব্যবহারই নয় বরং প্রশাসনের নিয়োগেও ছিল আবদুল মালেক ক্ষমতা প্রয়োগ করতো। অধিদফতরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজেই সেই সংগঠনের সভাপতি পদে দায়িত্ব নেন আবদুল মালেক। সেই ক্ষমতাবলে অধিদফতরের গাড়ি চালকদের মাঝে নিজের ক্ষমতার বলয় তৈরি করেন আবদুল মালেক।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকই না, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও যদি রাজধানীতে একাধিক বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হতে দেখা যায় তবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এই সম্পদ বৈধ কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এসব ক্ষেত্রে। এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমটি হলো- বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদ আহরণ হলে সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এই কাজটি দুর্নীতি দমন কমিশন খুব সহজভাবেই করতে পারে। ব্যক্তির আয়ের সঙ্গে সম্পদের হিসেব নিলেই পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসবে যে, তিনি কীভাবে এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। যদি সেক্ষেত্রে অবৈধ কিছু পাওয়া যায় তবে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আরও একটি দিক রয়েছে। একজন গাড়িচালক এই সম্পদের মালিক এককভাবে হয়েছেন এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে তার সঙ্গে যোগসাজশকারী আরও অনেকেই রয়েছেন। যারা গাড়িগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের কেউ কেউ থাকতে পারেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। একইভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ থাকতে পারে। অতএব সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। শুধুমাত্র কান টানলে হবে না, মাথাও টানতে হবে। চুনোপুটিরা অবশ্যই প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কিন্তু রুই কাতলারা কী করেছেন সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। সেটি করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে একটি নিয়ন্ত্রণের জায়গায় যাওয়া যাবে। অন্যথায় এমন অন্যায়-দুর্নীতির বিকাশ আরও ঘটতে থাকবে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের কিছু কিছু ব্যক্তি অনেক বছর ধরে এসব দুর্নীতি করছে। আসলে দুয়েকজনকে গ্রেফতারে কী লাভ, আমি জানি না। তাদের যারা প্রশ্রয় দিয়েছে, বড় হতে দিয়েছে এদেরকে ধরা উচিত। ড্রাইভারকে ধরে আর কী লাভ? চারদিন রিমান্ডে যাবে, দশদিন রিমান্ডে যাবে, পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করবে এর বেশি তো কিছু হবে না। কিন্তু যারা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তাদের খুঁজে বের করা উচিত। সে তো আর একদিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়নি। এই আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই প্রশাসনিক মামলা থেকে শুরু করে অনেক অভিযোগ ছিল।’

এর আগে রোববার (২০ সেপ্টম্বর) ভোরে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র, জালনোটের ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাব-১’র একটি দল আব্দুল মালেককে গ্রেফতার করে। তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কর্মচারী হয়েও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে ড্রাইভার মালেক (৬৩)। জাল টাকার ব্যবসা ছাড়াও তিনি এলাকায় চাঁদাবাজিতে জড়িত। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারের পর বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন