সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির ৪% করার প্রস্তাব
৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:২১
ঢাকা: করোনাভাইরাসের প্রভাবে বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ায় সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিরা যাতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ঢুকতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে যত দ্রুত সম্ভব একটি ডাটাবেজ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন তারা।
শনিবার (৩০ জানুয়ারি) ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ডিজেএফবি) ও বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) আয়োজিত অনলাইন সেমিনারে বক্তারা আরও বলেন, ‘প্রতিবছর বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বড় একটি অংশই চলে যায় সরকারি চাকুরেদের পেনশনের পেছনে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দের পরিমাণ খুব কম পৌছে। তাই বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট জিডিপির চার শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন বিশেষজ্ঞরা।’
‘কোভিড ১৯: সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য অধিকার’ শিরোনামের সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মফিদুল ইসলাম, অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এর নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী, ডিজেএফবির সভাপতি হুমায়ুন কবীর, এনজিও সংগঠক শাহ মবিন জিন্নাহ, মমতাজ আরা বেগম, এসএম হারুন আর রশিদ লাল, ড. জাহিদ মাসুদ, শিক্ষক রাবেয়া বিনতে করিমসহ অন্যরা। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন ডিজেএফবির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সুশান্ত সিনহা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিজেও স্বীকার করেন যে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে একসময় ভুলত্রুটি ছিল। অবশ্য সেটি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। জনপ্রতিনিধিরা এখন দরিদ্র মানুষ বাছাইয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার বলে আমিও মনে করি। সেই চেষ্টা অবশ্য চলছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে। আমি দেখেছি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকৃত হয়। কোভিড এর কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। এটি ঠিক। আমি মনে করি, ভাতার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। এখন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এটাকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি। ভাতা বাড়াতে আমার চেষ্টা থাকবে।’
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন,‘দারিদ্র্য নিরসনে বর্তমান সরকার কাজ করছে। নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে দারিদ্র্যকে আরও বেশি করে আক্রমণ করা হবে।’ কোভিডের সময় যারা বিধবা হয়েছেন, তাদেরকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে নিজ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
মূল প্রবন্ধে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘কোভিড ১৯ এর কারণে নতুন করে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাদেরকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সেটি করতে হলে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’
নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘করোনার সময়ে অর্থনীতির যে বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে সেটি হলো কর্মসংস্থান। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। আয় কমে গেছে। বৈশ্বিক বাজারে সংকট চলছে। তাই রপ্তানি আয়ও কমে গেছে। কর্মসংস্থানের সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক রয়েছে। করোনার সময় দেশে আয় বৈষম্য ও দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। এটা চিন্তার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। যার মধ্যে বড় একটি অংশ চলে যাবে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশনের পেছনে। তাছাড়া এই খাতে সুশাসনের মারাত্মক ঘাটতি আছে। যারা যোগ্য নন, তারা সামাজিক সুরক্ষা থেকে সুফল পাচ্ছে। আবার যারা সামাজিক সুরক্ষা খাতে অন্তর্ভূক্ত হওয়া জরুরি, তারা ঢুকতে পারছে না। এই খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সেটি করতে হলে একটা ডাটাবেজ থাকতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ধনী-দরিদ্র্যের একটি ডাটাবেজ করছে। কিন্তু অনেক বছর হয়ে গেলেও সেটি এখনও শেষ হয়নি।’ কেন শেষ হয়নি তা খুঁজে বের করতে সাংবাদিকদের আহ্বান জানান তিনি।
সেমিনারে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান (অতিরিক্তি সচিব) মফিদুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সেটি বাস্তবায়নে সরকার চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে বিভিন্ন কর্মপন্থা ঠিক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কোভিড ১৯ কে মোকাবিলায় সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ, কভিডের কারণে নতুন করে অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। অনেকে কাজ হারিয়েছে।’
অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এর নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর মার্চে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পর বহু মানুষ ঋণ করে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটিয়েছে। সরকারের অনেক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে। তবে সেটি গ্রামকেন্দ্রিক। শহরকেন্দ্রিক কর্মসূচি নেই। কোভিডের সময় দেশের স্বাস্থ্য সেবা কতটা নাজুক সেটা ফুটে উঠেছে। কতজন দরিদ্র মানুষ নিজেদের কোভিড পরীক্ষা করিয়েছেন আমরা জানি না। নিম্ন আয়ের মানুষরা টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে কতটা অগ্রাধিকার পাবে, সেখানেও আছে দুশ্চিন্তা।’
স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ তাকে অপ্রতুল উল্লেখ করে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি। একই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান জামিল এইচ চৌধুরী।
সেমিনারে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ। মোট জিডিপির তিন শতাংশ। অবশ্য এর মধ্যে বড় একটি অংশ চলে যায় পেনশনের পেছনে। সত্যিকারের দরিদ্র মানুষের কাছে বরাদ্দ পৌছে মোট জিডিপির মাত্র ১.২৪ শতাংশ।
সারাবাংলা/জেজে/একে