বিমানবন্দরে করোনা ল্যাব স্থাপনে দীর্ঘসূত্রিতার দায় নিচ্ছে না কেউ
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:২৩
ঢাকা: সংযুক্ত আরব আমিরাতের শর্ত মেনে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমনিতেই আমিরাতের চাহিদা র্যাপিড পিসিআরের বদলে সরকার আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপনে সাত প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। তার ওপর আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপনের যে প্রক্রিয়া, সেটিও পড়েছে চরম দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে। সাত প্রতিষ্ঠান অনুমতি পাওয়ার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলেও ল্যাব স্থাপনের জায়গাই এখনো বুঝে পায়নি তারা। এ অবস্থায় কবে নাগাদ বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা হবে, সেটি স্পষ্ট নয়। আর এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য দায় নিচ্ছে না কেউ। মন্ত্রণালয়গুলো একে অন্যকে দোষারোপ করছে প্রকাশ্যেই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে তার মন্ত্রণালয় বাছাই করে দিলেও তারা প্রয়োজনীয় জায়গা বুঝে পায়নি। সেই স্থান তারা আজ (মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলছেন, ল্যাব স্থাপন নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছুটা অনীহা ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ল্যাব স্থাপনে দেরি লাগছে।
মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে বিমানবন্দরে নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাব স্থাপনের সংকট সমাধান ও স্থান নির্ধারণের জন্য সরেজমিনে পরিদর্শন করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমেদ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমানসহ অন্যরা।
এদিন বিমানবন্দরে স্থান নির্বাচনের পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, দ্রুত প্রবাসীদের নমুনা পরীক্ষার কাজ শুরুর জন্য বিমানবন্দরের ভেতরে একটি জায়গা দেওয়া হয়েছে। সেখানে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। যারা ল্যাব স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে, তাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে কাজ ছিল, সেটি আমাদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন:
- বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব চায় আমিরাত প্রবাসীরা
- খোলা মাঠে কি ল্যাব তৈরি করা যায়?— প্রশ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
- ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ল্যাব স্থাপনে দেরি’
- বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর টেস্টের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
- বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর মেশিন বসবে ‘বেসরকারিভাবে’
- আরটি পিসিআর ল্যাবে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে বিমানবন্দর
- বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অনুমোদন পেল ৭ কোম্পানি
- বিমানবন্দরে আরটি পিসিআর ল্যাবে আমিরাতের শর্ত পূরণ নিয়ে প্রশ্ন
- বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনে যে পরামর্শ দিলো কারিগরি কমিটি
- বিমানবন্দরে পিসিআর পরীক্ষার দায়িত্ব একটি ল্যাবকে দেওয়ার পাঁয়তারা
- ‘বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিংয়ের ছাদে স্টিলের কাঠামো তৈরি করে ল্যাব হবে’
একই দিন তিনি রাজধানীর শ্যামলীতে ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বলেন, আজ (মঙ্গলবার) আমরা বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে এখনো ল্যাব বসানো হয়নি। কারণ জায়গা দিতে পারেনি। আমি আজ নিজে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছি। আমাদের গিয়ে গিয়ে সেখানে জায়গা দেখিয়ে দিয়ে আসতে হলো।
এর আগে, সাত প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়ার পর ল্যাব স্থাপনের জন্য বিমানবন্দরের কার পার্কিংয়ের জায়গাটি দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, খোলা মাঠে কি কখনো ল্যাব তৈরি করা যায়? আমি বলেছি, খোলা মাঠে ল্যাব করা যাবে না। বিমানবন্দরের ভেতরে আমাদের জায়গা দিতে হবে। সেখানে ল্যাব বসানো হবে।
বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটুকু তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেওয়া। কারা কাজ করতে পারবে, সেটি আমরা বলে দিয়েছি। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের নিয়োজিত করবে এবং সিভিল এভিয়েশন জায়গা দেবে— এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে জায়গাটি এতদিনেও নির্ধারণ হয়নি, আজ হলো। আশা করি (ল্যাব স্থাপনের কাজ) খুব দ্রুত শুরু হবে।
বিমানবন্দর পরিদর্শনের পর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমেদও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ল্যাব তো এক সপ্তাহ আগে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকায় একটু সময় লাগছে। এই সমস্যার আজ মোটামুটি একটি সমাধান হয়েছে।
ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছুটা অনীহা ছিল জানিয়ে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, আগের সিদ্ধান্ত ছিল যে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারিগরি কমিটি আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। সেগুলো আমরা সিভিল এভিয়েশনের কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছি। আরও কিছু প্রস্তাবনা ছিল। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক্ষেত্রে কিছুটা অনীহা ছিল।
আমিরাতের চাহিদা অনুযায়ী র্যাপিড পিসিআরের ব্যবস্থাও পরবর্তী সময়ে করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত চেয়েছে র্যাপিড পিসিআর। কিন্তু আমাদের দেশে আছে আরটি-পিসিআর। আরটি-পিসিআরে সময় বেশি লাগে। র্যাপিড পিসিআরে সময় কম লাগে। কিন্তু র্যাপিড পিসিআর মেশিন আমাদের দেশে নেই। তাই মেশিন আনতে ও বসাতে কিন্তু সময় লাগবে। আপাতত আরটি-পিসিআর ল্যাবের কাজ দিচ্ছি, পরে র্যাপিড পরীক্ষাও আমরা বিবেচনায় নেব। এটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, আমি এখনো বলতে পারছি না।
ল্যাব স্থাপনের জায়গা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সিভিল এভিয়েশন তথা বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক)। এ ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, আমিরাত কর্তৃপক্ষের কাছে একটি এসওপি পাঠানো হয়েছে। এই এসওপি প্রবাসীকল্যাণ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেখার বিষয় নয়। এর ক্লিয়ারেন্সের ভিত্তিতে সিভিল এভিয়েশন কাজ করে যাবে।
তবে এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, করোনার পরীক্ষাগার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে হয়েছে। এ কারণে নতুন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষকে এসওপি আবার দিতে হবে কি না, আমি নিশ্চিত না।
ল্যাব স্থাপনের জায়গা পরিবর্তন হওয়া বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ভেতরের জায়গা ছোট। পরীক্ষাগার বসানো হলে আমরা বুঝতে পারব কয়টি বুথ বসিয়ে কত জনের নমুনা পরীক্ষা একসঙ্গে করা যাবে।
এর আগে, আগস্টের শেষে বাংলাদেশসহ ১০টি দেশ থেকে আগতদের জন্য ফ্লাইটের ছয় ঘণ্টা আগে বিমানবন্দর থেকেই র্যাপিড পিসিআর পদ্ধতিতে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষার শর্ত আরোপ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ। এই শর্ত পূরণে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের জন্য গত ১ সেপ্টেম্বর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমেদের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে ল্যাব স্থাপনের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কারিগরি বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর অবকাঠামোগত বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় বেবিচককে।
এ বিষয়টি বাস্তবায়নে একটি কারিগরি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়। কারিগরি কমিটির বৈঠকের পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাতটি প্রতিষ্ঠানকে আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের পরিকল্পনা জানিয়ে আরব আমিরাতের দূতাবাসে এসওপি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে একবার বিমানবন্দরের পার্কিং লটে, একবার বিমানবন্দরের ছাদে ল্যাব স্থাপনের জায়গা ওই সাত প্রতিষ্ঠানকে দেখিয়ে দিয়েছে বেবিচক। কিন্তু মঙ্গলবার পর্যন্ত সেই ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরুই হয়নি।
এদিন দুই মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের পরিদর্শনের পর বিমানবন্দরের ভেতরে ল্যাব স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হলেও এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো মন্তব্য করেননি কেউই। ফলে আমিরাত প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফেরার প্রক্রিয়াটিও এখনো ঝুলে রইল।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
আরটি-পিসিআর ল্যাব করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব র্যাপিড পিসিআর সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বাস্থ্যমন্ত্রী