ইভানার স্বামীর দেশ ছাড়ার আশঙ্কা, সব ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি পুলিশের
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৪৩
ঢাকা: স্কলাসটিকা স্কুলের ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর ইভানার মৃত্যুর ১০ দিন পর আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। সে মামলা তদন্তও শুরু করেছে পুলিশ। তবে ইভানার পরিবারসহ আইনজীবীর আশঙ্কা, মামলার আসামি ইভানার স্বামী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান রুম্মান দেশ ছাড়তে পারেন। তারা বলছেন, পুলিশের উচিত আদালতের মাধ্যমে রুম্মানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার অনুমতি নেওয়া। আর পুলিশ বলছে, মামলার তদন্তের স্বার্থে যা কিছু করা দরকার, সে ধরনের পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পরীবাগে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনে) নকশী প্যালেসের দুই ভবনের মাঝখান থেকে ইভানা লায়লা চৌধুরীর নিথর দেহ উদ্ধার হয়। সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের কাছ থেকে ক্রমাগত মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিলেন ইভানা।ইভানার পরিবার ও বন্ধু-সহকর্মীদের অভিযোগ, স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সদস্যরা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছিলেন। ইভানার বন্ধু-সহকর্মীরা এ সংক্রান্ত কিছু তথ্যপ্রমাণসহ এক আবেদনে ইভানার মৃত্যুরহস্য সুষ্ঠুভাবে তদন্তের আবেদন জানিয়েছিলেন। শুরুতে কিছু দ্যোদুল্যমানতার মধ্যে থাকলেও পরে এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে থানায় মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয় ইভানার পরিবার।
গত শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ইভানার মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার আবেদন করা হয় শাহবাগ থানায়। সেদিন থানা থেকে মামলাটি গ্রহণ করা হয়নি। পরদিন পুলিশ ইভানার বাবাকে ডেকে নিয়ে মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ। মামলাটি গ্রহণ করার পর থেকেই ইভানার পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন, ইভানার স্বামী রুম্মান দেশ ছাড়তে পারেন।
ইভানার বাবার দায়ের করা মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন সে আশঙ্কার কথা জানিয়ে রোববার (২৬ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলাকে বলেন, মামলার এক নম্বর আসামি ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান রুম্মান দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন— এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি একজন আইনজীবী। তার বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি রয়েছে। তিনি বিশ্বের যেকোনো দেশেই ব্যারিস্টার হিসেবে প্র্যাকটিস করতে পারবেন। দেশে যেহেতু তার নামে মামলা হয়েছে, তাই আইনি জটিলতা এড়াতে তিনি দেশ ছাড়ার পথকেই বেছে নিতে পারেন।
আরও পড়ুন
- ইভানার মৃত্যুর দায় কার
- অবশেষে মামলার সিদ্ধান্ত ইভানার পরিবারের
- ইভানার জন্য বন্ধু-সহকর্মীরা কালো ব্যাজ পরে থানায়
- স্কলাসটিকা কর্মকর্তা ইভানার মৃত্যুর নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
- মামলা নেয়নি শাহবাগ থানা, আদালতে যাবে ইভানার পরিবার
- ইভানার মৃত্যুরহস্য: মামলা নিয়ে পরিবারের রহস্যময় আচরণ
- ইভানাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ‘প্রেমিকা’র সঙ্গে কথা বলতেন রুম্মান
- ইভানার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে থানায় আবেদন
- ইভানার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে থানায় আইনজীবীরা
ব্যারিস্টার রুম্মানের দেশত্যাগ ঠেকাতে পুলিশকে আদালতের শরণাপন্ন হতে বলছেন ব্যারিস্টার সরোয়ার। তিনি বলেন, আদালতে আবেদন করে পুলিশ রুম্মানের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারে। এটি পুলিশের প্রথম কাজ হওয়া উচিত। আমরা এ বিষয়টি আবেদন আকারে পুলিশকে জানিয়েছি। বাকি কাজটি তাদের। তদন্তের শুরুতেই এটি করা প্রয়োজন। কারণ আসামি দেশে না থাকলে সেই মামলায় অনেক সমস্যা ও জটিলতা তৈরি হয়।
রুম্মানের দেশত্যাগ ঠেকাতে পুলিশ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না— জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্বাস আলী সারাবাংলাকে বলেন, ইভানার মৃত্যুর ঘটনায় একটি অপমৃত্যু ও আরেকটি নিয়মিত মামলা হয়েছে। দুইটি মামলাই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা এতটুকু বলতে পারি— পুলিশ সব ব্যবস্থা নিয়েছে। তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন বলেন, মামলাটিতে আমরা ব্যারিস্টার রুম্মানের সঙ্গে তার কথিত প্রেমিকা নারী ব্যারিস্টারকেও আমাদি করেছিলেন। পুলিশ আপাতত তাকে (নারী ব্যারিস্টার) বাদ দিয়ে মামলা রুজু করেছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ওই নারীর (রুম্মানের প্রেমিকা) বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার প্রমাণ মিললে তাকেও আসামি করা হবে।
ইভানার পরিবারের দাবি, তাদের পক্ষ থেকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি যেন না নেওয়া হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য রুম্মান অনেক জায়গায় তদবির করেছেন। এমনকি তাদেরও অনেককে দিয়ে ফোন করিয়েছেন যেন ইভানার দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে মামলা না করা হয়। কিন্তু ইভানার মতো আরও অনেকেই যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে, এ ঘটনায় ন্যায় বিচার মিললে হয়তো কিছুটা হলেও সচেতনতা তৈরি হবে। তাতে অনেক ইভানাকেই হয়তো আর আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে না। সে কারণেই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায় বিচার চেয়ে তারা মামলাটি দায়ের করেছেন। এখন পুলিশ সুষ্ঠু তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেবে— এটুকুই প্রত্যাশা ইভানার পরিবারের।
এদিকে, ইভানার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে পরিবারের দায়ের করা মামলাটির এজাহার রোববার আদালতে আসে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া শাহবাগ থানা পুলিশকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ৭ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ ইভানার মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে যায়। ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ময়নাতদন্ত হয়। এরপর মরদেহ তার শ্বশুর গ্রহণ করে বারডেমের হিমঘরে রাখেন। ১৭ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের পর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় ইভানার মরদেহ।
পুলিশ বলছে, হত্যা-আত্মহত্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঘটনা তারা দেখেছেন। কিন্তু দুই সন্তানের জননী একজন নারীর মৃত্যুর পর হাসপাতাল, মর্গ, হিমঘর বা দাফনের গোটা প্রক্রিয়ায় স্বামীর কোনো উপস্থিতি বা ভূমিকা নেই— এমন অভিজ্ঞতা তাদের নেই!
সারাবাংলার অনুসন্ধানেও ইভানার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের নির্মম আচরণের তথ্য বেরিয়ে আসে। জানা যায়, স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির আচরণও ইভানাকে সার্বক্ষণিক মানসিক চাপে রাখত। রুম্মান বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় শ্বশুর-শাশুড়ি চাইতেন, ইভানা ডিভোর্স নিয়ে চলে যাক। এমনকি ইভানার মৃত্যু হলেও তাদের কিছু যায় আসে না— এমন ইঙ্গিতও দিতেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মরদেহ উদ্ধারের একদিন আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর হাত কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ইভানা। সে খবর জানতে পেরেছিলেন তার শ্বশুর বাড়ির সদস্যরাও। ইভানার মরদেহ যেদিন উদ্ধার করা হয়, সেদিনও ওই প্রসঙ্গ টেনে শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা ইভানাকে বলেছিলেন— ‘তুই মরতে চাস? হাত কাটলেই কেউ মরে নাকি? মরা কি এতই সহজ?’ মানসিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা ইভানা এমন কথায় আরও আহত হন। এমন নির্মম আচরণ তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে তাৎক্ষণিকভাবে প্ররোচিত করে বলে অভিযোগ তার বন্ধু-সহকর্মীদের। তারা বলছেন, ওই কথোপকথনের পরপরই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ৯ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলেন ইভানা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইভানার স্বামী ব্যারিস্টার রুম্মান বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন একজন নারী ব্যারিস্টারের সঙ্গে। সেই সম্পর্ক চালিয়ে নিতেই ইভানাকে ‘পথের কাঁটা’ মনে করেছিলেন রুম্মান। সে কারণেই ইভানাকে প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়াতেন। পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ইভানাকে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ওষুধও খাওয়ানো হতো। ইমপালস হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক মোল্লা সেই ব্যবস্থাপত্র লিখেছিলেন, যদিও তাতে রোগের কোনো বিবরণ ছিল না। অন্যদিকে সেই ইমপালস হাসপাতালেরই আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন ব্যারিস্টার রুম্মান। ওই চিকিৎসকের এমন ব্যবস্থাপত্র নিয়ে খোদ চিকিৎসকরাই প্রশ্ন তুলেছেন।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলা ইভানা লায়লা চৌধুরী ইভানার মৃত্যুরহস্য ব্যারিস্টার রুম্মান