পুনঃতদন্ত নয়, বাবুলের মামলার অধিকতর তদন্ত হবে
৪ নভেম্বর ২০২১ ২১:১০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের প্রথম মামলায় তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং বাবুলের নারাজি আবেদনের বিষয়ে লিখিত আদেশ দিয়েছেন আদালত। বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন দাখিলের কোনো আইনি ভিত্তি নেই বলে আদালত আদেশে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া পিবিআইয়ের তদন্তকে ‘সফল’ বললেও ‘টেকনিক্যাল ত্রুটি’ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেননি আদালত। অধিকতর তদন্ত করে পুনরায় প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন।
বুধবার (০৩ নভেম্বর) পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর বাবুল আক্তারের দাখিল করা নারাজি আবেদনের বিষয়ে এজলাসে আদেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমান। মৌখিক আদেশের ভিত্তিতে পুলিশের প্রসিকিউশন শাখা ও বাবুল আক্তারের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলা পুনঃতদন্তের আদেশ দিয়েছেন। বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদনও নামঞ্জুর করেছেন বলে জানানো হয়েছিল।
কিন্তু আদালতের লিখিত আদেশ প্রকাশ হওয়ার পর এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) প্রসিকিউশন শাখায় আদেশটি পৌঁছেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলা পুনঃতদন্তের কোনো আদেশ আদালত দেননি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন যেটি দাখিল হয়েছে, তাতে কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটি আছে বলে আদালত উল্লেখ করেছেন। তবে আদেশটি অনেক বড়। চিহ্নিত ত্রুটির বিষয়ে আমরা এখনো ধারণা পাইনি। সেই ত্রুটি সংশোধন করে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ১২ ডিসেম্বর দাখিলের জন্য আদালত আদেশ দিয়েছেন। বাবুল আক্তার যে নারাজি আবেদন দাখিল করেছিলেন, শুনানি শেষে আদালত আদেশে বলেছেন— এ ধরনের আবেদন করার আইনি সুযোগ নেই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশে পর্যালোচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন— ‘তদন্তকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় এজাহারকারী বাবুল আক্তার মূল আসামি হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বাবুল আক্তারকে আসামি করে নতুন একটি মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাবুল আক্তার আসামি হিসেবে শনাক্ত হওয়ায় তাকে মিথ্যাভাবে জড়িত করা হয়েছে বা সঠিকভাবে তদন্ত না করায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে— এসব কারণ উল্লেখ করে নারাজি দরখাস্ত দাখিল করার বা অধিকতর তদন্তের কোনো সুযোগ বাবুল আক্তারের নেই মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
আরও পড়ুন-
- মিতু হত্যা মামলা কোন পথে?
- মিতু হত্যার আসামি ভোলা গ্রেফতার
- মিতু হত্যা মামলার আসামি সাক্কু গ্রেফতার
- মিতু হত্যা মামলা: হাইকোর্টে ভোলার ৪ সপ্তাহের জামিন
- মিতু হত্যা: বাবুলের নারাজি আবেদনের আদেশ ৩ নভেম্বর
- মিতু হত্যায় স্বামী বাবুলকে আসামি করে ৫ বছর পর মামলা
- মিতু হত্যা: জবানবন্দির পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় মুসার স্ত্রী
- বাবুলকে ‘বাঁচিয়ে’ দাখিল হচ্ছে মিতু হত্যা মামলার অভিযোগপত্র
চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালত পর্যালোচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘এই মামলায় একটি সফল তদন্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে খুনের মোটিভ ও আসামি শনাক্ত হয়েছে। তদন্তে দু’জন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, দু’জন সাক্ষীর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, সিসিটিভি ফুটেজ ও কার্তুজসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ হয়েছে। একটি সফল তদন্তের পরিসমাপ্তি কেবল টেকনিক্যাল একটি তুচ্ছ কারণে ব্যর্থ করে দেওয়া উচিত হবে না। বরং এ মামলায় অধিকতর তদন্ত করে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে এবং পরবর্তী আইনি জটিলতাও এড়ানো সম্ভব হবে।’
আগামী ১২ ডিসেম্বর অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন আদালত।
টেকনিক্যাল ত্রুটির বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুল আক্তার। তদন্তে যখন খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রকাশ হয়েছে, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে বাদীকে অভিযুক্ত করার বিষয়ে আবেদন করতে পারতেন। অথবা তার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করতে পারতেন। তৃতীয় কাউকে মামলার বাদী করার সুযোগ আইনত নেই।’
উল্লেখ্য, বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলাটিও তদন্ত করছে পিবিআই। গত ১৪ অক্টোবর কারাবন্দি বাবুল আক্তার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দাখিল করেন। ২৭ অক্টোবর ওই আবেদনের ওপর শুনানি হয় বাবুল আক্তারের উপস্থিতিতে।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে।
স্ত্রী খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ২০১৬ সালের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় তৈরি করা চাঞ্চল্যকর এই মামলার।
চলতি বছরের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তদন্তে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের লক্ষ্যে ১২ মে ওই মামলার ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পিবিআই।
আগের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাখিলের পর গত ১২ মে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আট জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়া।
ওই দিনই (১২ মে) বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে আদালতে জবানবন্দি দেননি বাবুল আক্তার।
এর মধ্যে গত ২৩ অক্টোবর মামলার এক আসামি এহতেশামুল হক ভোলা আদালতে জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছেন, বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করান তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এসপি বাবুল আক্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার মাহমুদা খানম মিতু মিতু হত্যা মামলা