আইভীর হ্যাটট্রিক নিয়ে প্রত্যয়ী আ.লীগ, আশা ছাড়ছেন না তৈমুর
১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০০:২১
নারায়ণগঞ্জ: প্রচারণা শেষ। সপ্তাহ দুয়েকে গরম হয়ে ওঠা নির্বাচনের মাঠ এখন কিছুটা শান্ত। মাঝে একদিনের বিরতি। তারপর দিনভর ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটাধিকার প্রয়োগ। তারপর ফলের অপেক্ষা। কে হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নগরপিতা? হ্যাটট্রিক জয়ে ফের নাসিকের চেয়ারে আসবেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী? নাকি প্রথমবারের মতো আইভীকে হারিয়ে নাসিকের দায়িত্বে আসবেন তৈমুর আলম খন্দকার?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও কৌশলে তৈমুর আলম খন্দকারকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয়দের মধ্যেও আইভীর বিরোধী বলয়ের সমর্থন পেতে পারেন তিনি। ফলে এই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল তৈমুরই নন, ‘অদৃশ্য ছায়াশক্তি’ও কাজ করছে তার বিপক্ষে। তবে সবকিছু পেরিয়েই আইভীর হ্যাটট্রিক জয়ে শতভাগ আশাবাদী আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। কেননা নৌকার বিজয় ঠেকাতে পারে— এমন কোনো প্রকাশ্য শক্তি নেই।
জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য বলছে, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সিটি করপোরেশনে এবার মেয়র পদে লড়ছেন সাত জন প্রার্থী। তারা হলেন— আওয়ামী লীগের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী (নৌকা), খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়াল ঘড়ি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মোহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ (হাত পাখা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন (বটগাছ), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মোহাম্মদ রাশেদ ফেরদৌস (হাত ঘড়ি) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার (হাতি) ও কামরুল ইসলাম বাবু (ঘোড়া)। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আইভী আর তৈমুরের মধ্যেই। এছাড়া ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন ১৪৮ জন। সংরক্ষিত ৯ ওয়ার্ডে ৩৪ জন নারী প্রার্থীসহ সব মিলে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৮২ জন।
আরও পড়ুন- বাবার মতো আপনাদের খেদমত করার সুযোগ দিন: আইভী
নাসিকে ভোটের আগে নির্বাচনি প্রচারণার শেষ দিনে নারায়ণগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, গোটা নগরে ভোটের হাওয়া। পাড়া-মহল্লা, অলি-গলি ও চায়ের দোকানে সব আলোচনা ভোট ঘিরেই। স্থানীয়রা বলছেন, ভোটের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থীদের জনসংযোগের মাত্রাও বাড়ছে। অলিগলিতে ছুটে বেড়াচ্ছেন তারা। ভোটারদের সমর্থন আদায়ে দোকানপাট ও বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতি।
এলাকাবাসী বলছেন, এলাকার রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেবেন— এমন ব্যক্তিকেই ভোট দিতে চান ভোটাররা। সিটির শিমরাইল এলাকার নাজমুল হোসেন, মুক্তিনগর এলাকার ইমাম হাসানসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো এ বিষয়ে। তারা বলছেন, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকেই তারা বেছে নেবেন জনপ্রতিনিধি হিসেবে। সেক্ষেত্রে প্রতীক হিসেবে এগিয়ে থাকবে নৌকা নাকি হাতি— এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই এগিয়ে রাখতে চান আইভীকে।
সিটি করপোরেশন বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের তুলনায় নানা কারণে এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ব্যক্তি আইভীই দলমত নির্বিশেষে ভোট পাবেন। তাই নির্বাচনি সমীকরণে তিনি অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন।
গত কয়েকদিনের প্রচারণায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার তার সমর্থকদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। তবে বরাবরই নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভি।
নির্বাচনি প্রচারণার শেষ দিন শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) আইভী নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার বিপক্ষে ‘ঘর ও বাইরের’ অনেক শক্তিই একজোট হয়েছে। তবে তিনি নিজেকে মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন বলে জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত রয়েছেন।
আরও পড়ুন- সরকারি দলের নেতারা ভোট প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন: তৈমুর
অন্যদিকে এদিন নির্বাচনি ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন। একদিন আগে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের বৈঠক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। নিজের নেতাকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ তো ছিলই।
নির্বাচনি পরিবেশসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে খেলাফত মজলিসের মেয়র প্রার্থী এ বি এম সিরাজুল মামুন বলেন, নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই শঙ্কা বাড়ছে এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্ষমতাসীন দলের ঘোষিত ও অঘোষিত প্রার্থীদের বক্তব্যে মানুষ ভীত হয়ে পড়ছে। নৌকা ও হাতি প্রতীক এরই মধ্যে মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ এখন বিকল্প হিসেবে উন্নয়নের স্বার্থে দেয়াল ঘড়িকে বেছে নিচ্ছে।
আধুনিক নগরীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাতি প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, এই সিটি করপোরেশনকে আমরা গণমুখী করব। এই নগরী হবে একটা নিরাপদ নগরী। তোলা হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। এটি হবে একটি আধুনিক নগরী, যেখানে সব ধরনের সেবা ও সুযোগ-সুবিধা থাকবে। অসম্প্রদায়িক নগরী হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে গড়ে তোলা হবে।
অন্যদিকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, আমি জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চাচ্ছি। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে মন জয় করে ভোট আনা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সেই চ্যালেঞ্জে জিতব বলে আশা করি। সারাদেশ জানে, আমি অর্থনৈতিকভাবে গরিব। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করি। এই বিষয়টি আমার শত্রুপক্ষও যেমন জানে, তেমনই আমার কাকা তৈমুর আলম খন্দকারও জানেন। আমি জীবনে কখনোই টাকার রাজনীতি করিনি এবং ভবিষ্যতেও করব না।
নির্বাচনে প্রচারের সময় শেষে এখন ভোটের অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত মেয়র পদে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কর্মী-সমর্থক-নেতারা। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীর নির্বাচন পরিচালনায় সহযোগিতার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা শুক্রবারও নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছেন। শেষ দিনের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক আহমদ হোসেন, সম্পাদক মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেনসহ ২৭টি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও আজকের শেষ গণসংযোগে অংশ নিয়েছেন।
আরও পড়ুন- অনেক পক্ষ মিলেমিশে গেছে, তবু জয় সুনিশ্চিত: আইভী
আশাবাদী আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটির এই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে দলের হাইকমান্ড। এজন্য শুরুতেই কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন পরিচালনায় সমন্বয় টিম গঠন করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে সমন্বয় করে টিম বণ্টন করে দিয়েছেন। নেতারা প্রতিদিনই নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় থেকে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করেছেন।
দলীয় সূত্র আরও বলছে, নির্বাচনে জয় হোক পরাজয় হোক— নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সার্বিক পরিস্থিতি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হবে। এজন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবেন, যা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জে দলের মধ্যেই বিভক্তির আওয়াজ পুরনো। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানান, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ নিয়ে বাইরে থেকে এতদিন যা শুনেছেন, তার বিপরীত চিত্র দেখছেন এই নির্বাচন ঘিরে। এখানে ব্যক্তিবিশেষের কাছে দলকে খোলসবন্দি করে রাখা হয়েছে। অদৃশ্য চাপে দলের নেতাকর্মীরা শঙ্কিত। অনেকে নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করতেও দ্বিধায় ভুগেছেন। এটি কোনোভাবেই সমীচীন নয় বলে মত দেন তারা।
তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে কেন্দ্রীয়ভাবে নাসিক নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, একটি মাল্টিক্লাস পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। না থাকাটাই অস্বাভাবিক। নারায়ণগঞ্জেও হয়তো কারও কারও মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু আমরা আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে কোনো বিভেদ নেই।
তিনি বলেন, এই নির্বাচনটিকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষকে ভোটকেন্দ্র বিমুখ করার অপচেষ্টা রয়েছে। আমি ভোটার ভাই-বোনদের কাছে অনুরোধ করব— আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন, নির্বিঘ্নে ভোট দিন, যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিন।
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ একসময় ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে খ্যাত ছিল। ১৮৭৬ সালে পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় ২০১১ সালে। সেবারে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে শামীম ওসমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। আর আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়ে না পেয়েও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে আইভী ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
২০১৬ সালে এই সিটিতে ভোট হয় দলীয় প্রতীকে। সেবারে নৌকা নিয়ে আইভী ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ ভোট পেয়ে ফের মেয়র নির্বাচিত হন। সেবার তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপি নেতা আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন।
এবারে আইভীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর, যাকে তিনি চাচা বলেই ডাকেন। কেননা রাজনীতিতে আইভীর বাবা আহম্মেদ আলী চুনকার অনুসারী ছিলেন তৈমুর। সেই সুবাদে চাচা-ভাতিজির ভোটযুদ্ধে যে বিজয়ী হিসেবে শেষ হাসি হাসবেন— সেটি দেখার অপেক্ষাতেই তাকিয়ে আছে নারায়ণগঞ্জসহ দেশবাসী।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
টপ নিউজ ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী তৈমুর আলম খন্দকার নাসিক নির্বাচন