ভিসি ফরিদের বক্তব্যে অনেক মেয়ের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে
২০ জানুয়ারি ২০২২ ২১:৫৯
ঢাকা: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। মেয়েদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার দায়িত্বও উপাচার্যের ওপরই বর্তায়। সেখানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভীষণ আপত্তিকর ও নারীবিদ্বেষী এই বক্তব্য উপাচার্যের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। তার এই বক্তব্য বরং অনেক মেয়ের উচ্চ শিক্ষার পথেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শাবিপ্রবিতে যখন হল প্রশাসনের অনিয়ম-নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আন্দোলনের সূত্র ধরে এক পর্যায়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে, এমন সময় মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে একটি অডিও ক্লিপ। তাতে কথা বলতে শোনা যায় শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে। ওই অডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়— ‘এখানে আমাদের ছাত্রনেতারা বলছেন যে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ সারারাত এরা ঘোরাফেরা করে। বাট আমি চাই না যে আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, এ রকম একটা কালিমা লেপুক তাদের কপালে।’
ওই অডিও ক্লিপটি যে শাবিপ্রবি উপাচার্যেরই, সেটি নিশ্চিত করেছেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকরা। ওই অডিওতেই তাকে নারীদের নিয়ে অবমাননাকর আরও কথা বলতে শোনা যায়। তা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকেই এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার অপসারণ ও শাস্তিও দাবি করেছেন।
শাবিপ্রবি উপাচার্যের এমন মন্তব্য মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. পারভীন জলী। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশের মা-বাবারা মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান না। অনেক মেয়েকেই রীতিমতো লড়াই করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অন্য আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সম্পর্কে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের পর অনেক মা-বাবাই হয়তো ভবিষ্যতে তাদের মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে সাহস পাবেন না।
আরও পড়ুন-
- শাবিপ্রবিতে অনশনকারী কয়েক শিক্ষার্থী অসুস্থ
- শাবিপ্রবিতে অনশনরত এক শিক্ষার্থী হাসপাতালে
- অনশনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গেলেন শাবিপ্রবি শিক্ষকরা
- তদন্ত করে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, মেনে নেব: শাবিপ্রবি উপাচার্য
- জাবি ছাত্রীদের নিয়ে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য, শাবি ভিসিকে উকিল নোটিশ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বরং দেশের অন্য অনেক স্থানের চেয়ে অনেক বেশি নারীবান্ধব জানিয়ে ড. পারভীন বলেন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে ১৮ বছর জাবিতে আছি। এই সময়ে দেখেছি, এখানে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি পরিবেশ গড়ে উঠেছে। দিন বা রাত— এখানে ছাত্রীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারেন। কাউকে যদি জরুরি কোনো কাজে রাত ২টা পর্যন্তও বাইরে থাকতে হয়, কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। শাবিপ্রবি উপাচার্য কখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে বা এখানে না এসেই এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে মেয়েদের চরিত্রে কালিমা লেপনের সেই চিরাচরিত চেষ্টাই করেছেন তিনি। কিন্তু নারীকে কলঙ্কিত করা যত সহজ তারা মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে তত সহজ নয়।
জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের রাত ১০টা পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগরের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনও তেমনি এখানকার মেয়দের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাহাঙ্গীরনগর সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক চিন্তাকে উসকে দেওয়ার পাশাপাশি তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও যেন এমন দাবি না করেন— সেই পথে রূদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ টিউশনি, পড়ালেখা, চাকরিসহ নানা কাজেই কোনো মেয়ের সন্ধ্যার পর বাইরে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘সান্ধ্য আইন’ দিয়ে মেয়েদের হলে আটকে রাখা হচ্ছে, সেটিকেই অযৌক্তিক বলে মনে করেন ড. পারভীন জলী।
উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের এমন মন্তব্য শাবিপ্রবিতে চলমান আন্দোলন থেকে নজর অন্যদিকে ঘুরানোর প্রয়াস হতে পারে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এ কে এম জাকারিয়া। সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী আরও মনে করেন, উপাচার্য ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকে এমন আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, সেখানকার নারী শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে থামাতে ও অভিভাবকদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য বিয়ের যোগ্যতার প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের বিয়ের যোগ্য করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব না। এই কথা বলার মাধ্যমে উপাচার্য কেবল অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই ছোট করার চেষ্টা করেননি, এর মাধ্যমে মেয়েদের প্রতি তার মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
শাবিপ্রবি উপাচার্যের মন্তব্যকে আপত্তিকর উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, আমাদের সমাজ এখনো মেয়েদের সমান চোখে দেখে না। এখানে নারী নির্যাতনই বাস্তবতা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যদি তার নিজ ক্যাম্পাসেই নিরাপদ বোধ না করেন, তবে আর কোথায় নিরাপদ বোধ করবেন? উপাচার্যের দায়িত্ব নিজ ক্যাম্পাসকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করা। মেয়েদের প্রয়োজন হলে রাত ১০টার পর প্রয়োজনে গার্ড দিয়ে তাকে নিরাপদে হলে পৌঁছে দেওয়া তার কর্তব্য। কিন্তু তা না করে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রকাশ। দায়িত্বপূর্ণ জায়গা থেকে একজন উপাচার্য এমন মন্তব্য করতে পারেন না। এ ধরনের মন্তব্য চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়।
আরও পড়ুন-
- অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ শাবিপ্রবি
- আমরণ অনশনে ২৪ শাবিপ্রবি শিক্ষার্থী
- এবার উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল শাবিপ্রবি
- শাবিপ্রবিতে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, ২ ঘণ্টা পর ভিসি মুক্ত
- আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার খরচ দেবে শাবিপ্রবি প্রশাসন
- শাবিপ্রবি— মামলা প্রত্যাহারে রাত ১০টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম
- এবার তিন দফা দাবিতে ভিসি ভবনের সামনে শাবিপ্রবি ছাত্রীরা
- শাবিপ্রবি আন্দোলন: পুলিশের মামলায় আসামি কয়েকশ শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামশাদ নওরীন কর্মজীবনের শুরুর দিকে কিছুদিন চাকরি করেছেন শাবিপ্রবিতে। তিনি বলছেন, উপাচার্য যদি মেয়েদের নিরাপত্তা পরিস্থিতির খাতিরে রাতে বাইরে না যাওয়ার কথা বলতেন, সেটিও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন, সেটি মেনে নেওয়ার মতো নয়। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের কথা চিন্তা করে আমরা অনেকসময় ছাত্রীদের অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে নিরুৎসাহিত করি। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে সমান বিবেচনা করতে হবে। এভাবে ভেদাভেদ না করে সব শিক্ষার্থীকে সমাজে অবদান রাখতে পারার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য তাদের পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ ও মুক্তভাবে চলাচলের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরি করতে হবে।
এই ঢাবি শিক্ষক মনে করেন, মেয়েদের জীবনের একটি সময় একা একা বাড়ির বাইরে কাটানো উচিত। তাতে তার নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে এবং নিজেকে একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে শাবিপ্রবি থেকে ঢাবি হয়ে পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা যাওয়ার ফলে আমি নিজেই শিখেছি কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকা যায়। এই অভিজ্ঞতা সব মেয়ের অর্জন করা দরকার। আর নারী যেন সেই সুবিধা পায়, সেটি নিশ্চিত করা সমাজ, পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সহযোগী অধ্যাপক সামশাদ নওরীন চান, উপচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বোধদয় হোক। নারীর সমঅধিকার মুখেই নয়, মনেও ধারণ করুন তিনি। পাবলিক কমেন্ট করার আগে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি এভাবে জাজমেন্টাল হওয়া মেনে নেওয়া যায় না বলে মন্তব্য তার।
শাবিপ্রবি উপাচার্যকে শাস্তির আওতায় আনার দাবিও জানান ড. পারভীন জলী। তিনি বলেন, এমন নারীবিদ্বেষী ব্যক্তি কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, সেটিই আমার বোধগম্য নয়। এমন ব্যক্তিকে পদ থেকে অপসারণ করার পাশাপাশি তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তার এই মন্তব্য রীতিমতো যৌন হয়রানিমূলক।
শাবিপ্রবি উপাচার্যের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে অবশ্য রাজনৈতিক দিকটিও খতিয়ে দেখার পক্ষে মত দিচ্ছেন অধ্যাপক শাইখ ইমতিয়াজ। এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নারী-পুরুষ সাম্যের অগ্রগতির অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনকে উসকে দিতেও ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, আজকাল এক ধরনের ট্রেন্ড চলছে— কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সময় এলেই কথোপকথন ভাইরাল করা হয় বা কুৎসা রটিয়ে ক্ষমতাচ্যুতির চেষ্টা করা হয়। ক্ষমতায় রেখে বলুক— আপনি ভুল করেছেন বা ভুল কথা বলেছেন। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিক। তা না করে এভাবে জেন্ডার ইস্যুকে পলিটিক্যাল স্বার্থে ব্যবহার করে সাম্যের আন্দোলনকেই বারবার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে কারা কেন এই অডিওকে ভাইরাল করল, তাদের স্বার্থ কী— সেই চিন্তাও আমাদের করতে হবে এবং তা নিয়ে কথা বলতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নারীবিদ্বেষী মন্তব্য শাবিপ্রবি শাবিপ্রবি আন্দোলন শাবিপ্রবি উপাচার্য