ন্যাটো কী এবং কখন কাজ করে
২৮ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:৫২
উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটোর বিস্তারিত অর্থ—শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং সদস্যদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর প্রতিষ্ঠিত একটি অনাক্রমনাত্মক জোট।
স্নায়ুযুদ্ধের প্রাক্বালে ন্যাটোর জন্ম। সংস্থাটির সদর দফতর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিতি। ন্যাটো তৈরির উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি থেকে রক্ষা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের বিস্তার রোধ করা।
১৯৪৯ সালের এপ্রিলে—যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং আরও আটটি ইউরোপীয় দেশসহ ১২ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য একে অপরকে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উত্তর আটলান্টিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে কয়েক দশক ধরে জোটটি বড় হতে থাকে। আজকে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। দেশগুলো হলো—আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মন্টিনেগ্রো, নেদারল্যান্ডস, উত্তর মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর তিনটি প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসহ পূর্ব ব্লকের এক ডজনেরও বেশি দেশ ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও রাশিয়া এখনও ন্যাটোকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সাম্প্রতিক উত্তেজনার অন্যতম কারণ হলো—ন্যাটো জোটের সীমা আরও বাড়ানো হবে না—এমন নিশ্চয়তা চায় দেশটি।
ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর উল্লেখযোগ্য বহু ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও জোটটির উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে। ন্যাটোর মূলনীতি হলো—‘ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় জোটের এক বা একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে জোটের সকল সদস্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’
বাস্তবে এ মূলনীতির অর্থ কী
নর্থ আটলান্টিক চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে যৌথ প্রতিরক্ষা নীতির উল্লেখ আছে। এ অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করে— যেকোনো এক সদস্যকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে জোটের সকল সদস্যের সম্পদ ব্যবহার করা যাবে। বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র আছে যাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল। এসব সদস্যদের জন্য ন্যাটোর এই যৌথ প্রতিরক্ষা নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, আইসল্যান্ডের কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী নেই।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাধর সদস্য, তাই জোটের যেকোনো দুর্বল সদস্য মার্কিন সুরক্ষা বলয়ের অধীনে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ন্যাটোর ৫ম অনুচ্ছেদের মাত্র একবার প্রয়োগ হয়েছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গি হামলার পর এ অনুচ্ছেদের আওতায় আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যোগ দেয় ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যরা।
তবে এর বাইরেও ন্যাটো অন্যান্য ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়, ২০০৩ সালে ইরাক সংকটের সময় এবং ২০১২ সালে সিরিয়া পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে ন্যাটো প্যাট্রিয়ট মিসাইল মোতায়েনের মাধ্যমে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করেছিল। এই তিনবারই ন্যাটো তুরস্কের অনুরোধের ভিত্তিতে প্যাট্রিয়ট মিসাইল মোতায়েন করে।
ন্যাটোর কি নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে
ন্যাটোর কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই। জোটটি সদস্য দেশগুলো থেকে পাঠানো বাহিনীর উপর নির্ভর করে থাকে। এর অর্থ হলো—প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের নিজস্ব সেনাবাহিনীর শক্তিমত্তাই ন্যাটোর শক্তি। জোটের স্বার্থে প্রতিটি সদস্য তাদের প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে শক্তি ন্যাটোতে পাঠায়। অবশ্য অন্যান্য সদস্যরা ন্যাটোতে ন্যায্য অবদান রাখছে না বলে প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে আসছে আমেরিকা। ন্যাটোতে সামরিক বাজেট সরবরাহের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল মিত্ররা আমেরিকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর ন্যাটোর জন্য আমেরিকার ব্যয় আরও বহুলাংশে বেড়ে যায়।
ন্যাটোর গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতিটি দেশ জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ সদস্য দেশ এ লক্ষ্য এ লক্ষ্য পূরণ করছে না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রায়ই কঠোর সমালোচনা করতেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে ন্যাটোতে খরচ বাড়ানোর চাপ দিতেন এবং এক পর্যায়ে অতীতে তাদের ঘাটতি মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রকে টাকা ফেরত দেওয়ারও দাবি তুলেছিলেন।
ন্যাটোর সাম্প্রতিক এক হিসাবে, ২০২১ সালে সাতটি সদস্য রাষ্ট্র ন্যাটোর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা খাতের বাজেটে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে। দেশগুলো হলো—গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, ক্রোয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া এবং ফ্রান্স।
আরও পড়ুন-
- ইউরোপের যেসব জায়গায় ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন
- রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় পূর্ব ইউরোপে শক্তি বাড়াচ্ছে ন্যাটো
- ইউক্রেনে সামরিক টুপি সহায়তা দিচ্ছে জার্মানি, মেয়র বাকরুদ্ধ
- রুশ হামলার সম্ভাব্য তারিখ জানালেন ইউক্রেনের শীর্ষ জেনারেল
অর্ধেকেরও কম সদস্য এ লক্ষ্য পূরণ করলেও এটিকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ ২০১৪ সালে মাত্র তিনটি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং গ্রিস) সামরিক খাতে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছিল। সে সময় যেসকল সদস্য লক্ষ্যমাত্রার নিচে ব্যয় করত তারা এক দশকের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখনও অধিকাংশ দেশ প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। তবে বেশিরভাগ দেশ প্রতিশ্রুতি পূরণে অটল রয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো বিকশিত ও প্রসারিত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ন্যাটোর সদস্যরা বসনিয়ায় শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করেছে। মানবপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ভূমধ্যসাগরে উদ্বাস্তুদের ঠেকাতে সেনা মোতায়েন করেছে। নতুন উপায়ের আক্রমণ ঠেকাতেও ন্যাটো কাজ করছে। যেমন, এস্তোনিয়ায় সাইবার প্রতিরক্ষা হাব স্থাপনের মাধ্যমে সাইবার হামলা প্রতিরোধে কাজ করছে ন্যাটো।
ইউক্রেনে কী করতে পারে ন্যাটো
রাশিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির আগেও পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
ন্যাটো জানিয়েছে, বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডে চারটি বহুজাতিক ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এসব যুদ্ধদলের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র। গত ৭ জানুয়ারি ন্যাটোর তরফ থেকে জানানো হয়, এসব যুদ্ধদলের শক্তি আরও বাড়ানো হয়েছে এবং যুদ্ধের জন্য তারা পূর্ণপ্রস্তুত।
আরও পড়ুন
- ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা বাল্টিক দেশগুলোর
- রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা
- চীন-তাইওয়ান, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত— ২ ফ্রন্টে যুদ্ধ করবে আমেরিকা?
ন্যাটোর মহাসচিব জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ সম্প্রতি জানিয়েছেন, পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণের মাধ্যমে সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনকে শক্তিশালী করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ইতিমধ্যে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, পূর্ব ইউরোপে সংঘাতে জড়াতে প্রায় সাড়ে আট হাজার মার্কিন সেনাকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ৩০০ জ্যাভেলিন অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল, ৮০০ বাংকার বিধ্বংসী বোমা ও কয়েক হাজার কেজি প্রাণঘাতী গোলাবারুদ পাঠিয়েছে ইউক্রেনে। যুক্তরাজ্যে ইউক্রেনে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক অস্ত্র পাঠিয়েছে। গত বুধবার চেক প্রজাতন্ত্রের সরকার জানিয়েছে। ইউক্রেনে ১৫২ মিলিমিটার ক্যালিবারের ৪ হাজার আর্টিলারি শেল পাঠানো হবে।
– সিএনএন অবলম্বনে
সারাবাংলা/আইই