Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাইরাল ব্যালে বালিকা নওগাঁর ইরা

আব্দুর রউফ পাভেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৫৩

মোবাশ্বিরা কামাল ইরার ব্যালে আর্ট, ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁ: প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এক বালিকা হাত-পা ছুড়ে শূন্যে ভেসে চলছে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্যসহ কয়েকটি স্থান। এ ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্ষরিক অর্থেই এখন প্রশংসার হাওয়ায় ভাসছে ছবিগুলো। এ ছবিগুলো এক ধরনের নাচ। নাচের এ ধরনকে বলা হয় ব্যালে। ব্যালে-জিমনেস্টির সমন্বয়ে এ নাচ। এটি এক ধরনের নৃত্যকলা। এখানে নাচের সঙ্গে অভিনয় এবং সংগীতের অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। ছবির বালিকাটির নাম মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। নাচ নিয়ে পড়াশুনা করতে চান তিনি।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে পোস্টার থাকায় অনেকে ইরার ব্যালেকে আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে ছবিগুলোর ক্যাপশনে জুড়ে দিচ্ছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার পংক্তিমালা।

নওগাঁ শহরের জগৎসিংহপুর মহল্লার বটতলা মোড় সংলগ্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল ও ফাহমিদা আক্তার দম্পত্তি চার মেয়ের মধ্যে তৃতীয় মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। বাবা একজন স্থানীয় ফার্নিচার ব্যবসায়ী ও মা গৃহিনী। বড় দুই বোন আলাদা প্রতিভার অধিকারী। নওগাঁ সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে বাণিজ্য শাখায় পড়ছেন তিনি। ২০২০ সালে নওগাঁ সীমান্ত পাবলিক স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। দেশের সীমান্তবর্তী মফস্বল নওগাঁ শহর থেকে পড়ালেখা ও অনুশীলন করে সাফল্য এনেছেন অনেক। ছোট থেকেই ছিলেন অদম্য মেধাবী ও চঞ্চল প্রকৃতির। বরাবরই নাচ করতে ভালোবাসেন ইরা। শৈশবে নাচের শিক্ষক সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছেন ইরা। পরে ঢাকায় ভরতনাট্যম নাচ শেখেন। তবে ব্যালে নৃত্যের ভাবনা মনে ঠাঁই নেয় ২০২০ সালে লকডাউনের সময়। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিখতে শুরু করেন ব্যালে। ব্যালে-জিমন্যাস্টিক মিলিয়ে পারফর্ম করেন। এজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এরপর ২০২১ থেকে সাধনা সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন।

জয়িতা আফরিন একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। থাকেন ঢাকার ধানমন্ডিতে। মোবাশ্বিরা কামাল ইরা ঢাকায় গিয়েছিলেন শিল্পকলার ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি নৃত্য উৎসবে। ফটোগ্রাফির আলাদা একটা অর্থ তৈরি করার চিন্তা করছিলেন তিনি। গত ২৩ জানুয়ারি সকালে ইরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এমন সময় চোখে পড়ে রাজু ভাস্কর্যে পাশে চলমান বিভিন্ন আন্দোলনের প্লাকার্ড সাঁটানো। সেখানে কয়েকটি ফটোশুট করেন। পরে ২৫ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে ফেসবুকে আপলোড করা হয়। সে ছবিগুলো অসংখ্য মানুষ শেয়ার দিচ্ছেন। তার সেই ফটোগ্রাফি মুহূর্তে ভাইরাল হয় ফেসবুকে।

ব্যালে বালিকা মোবাশ্বিরা কামাল ইরা বলেন, ৫-৬ বছর বয়স থেকেই সুলতান মাহমুদের কাছে নাচ শিখেছি। ২০২০ সালে এসএসসি পাশ করলাম। ওই সময় শাস্ত্রীয় নৃত্য ও ভরতনাট্যম নিয়ে ভারতে গিয়ে কিছু শিখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে দেশে লকডাউন শুরু হয়। এতে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন ভাবলাম আমার দ্বারা কিছু হবে না বা কিছুই করতে পারবো না- এমন চিন্তাধারা মনের মধ্যে আসে। তখন মা পরামর্শ দিলেন ইন্টারনেট থেকে ইউটিউব দেখে ঘরে বসে নাচ করতে। বলা যায় ইন্টারনেট দেখেই ‘ব্যালে’ শেখা। সবসময় ইচ্ছা ছিল নতুন কিছু শেখার। বাংলাদেশে ব্যালে করে এমন শিল্পী খুবই কম আছে। কিন্তু দেশের বাহিরে ব্যালের ব্যাপক ব্যবহার আছে। আমার ইচ্ছা আছে ব্যালে নিয়ে কাজ করা।

গ্রামে থেকে ব্যালে শেখার প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে ইরা বলেন, গ্রাম থেকে কাজ করাটা অনেক কঠিন ছিল। ঢাকার মতো জায়গাতেও ব্যালে খুব একটা নাই। বাসায় প্যাকটিস করার মতো জায়গা ছিল না। মা ড্রয়িং রুম ফাঁকা করে সেখানে প্যাকটিসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে মেঝেতে প্যাকটিস শুরু করলাম। পরে ইয়োগো ম্যাটসের ব্যবস্থা করা হলো। আস্তে আস্তে প্যাকটিস করতে গিয়ে এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হলো। তবে অনেকেই আমার নাচ ভাল ভাবে নিতো না। আবার অনেকেই উৎসাহ জুগিয়েছেন। তবে বলা চলে সব মিলিয়ে পুরো যাত্রা ভাল হচ্ছে। সবক্ষেত্রেই মা আমাকে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়েছেন ও সহযোগিতা করছেন এবং পাশে থেকেছেন। বাবা-মা সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যালের ছবি এতো ভাইরাল হবে যা ছিল কল্পনাতিত ও প্রশংসনীয়। ইরা বলেন, লকডাউনের সময়ে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে আপলোড করতাম। সেখান থেকে সাগর দেবনাথ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার ইচ্ছা ছিল এ ধরনের (ব্যালে) ফটোশুট নিয়ে কাজ করার। আমিও সমর্থন দিলাম। তারপর ঢাকায় যমুনা ফিউচার পার্কে কিছু ফটোশুট করলাম। তারপর জয়িতা আফরিন আপু ছবিগুলো দেখেন এবং তিনিও এ ধরনের ছবি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। গত বছরের ২ নভেম্বর ধানমন্ডির লেকের পাড়ে ফটোশুট করা হয়। সেই ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোডের পর মোটামুটি ভাল একটা সাড়া পাওয়া যায়। তারপর থেকে ঢাকার বিখ্যাত বিভিন্ন জায়গায় ফটোশুট করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর বিষয়ে ইরা বলেন, ইচ্ছা ছিল আমরা যেহেতু স্বাধীন দেশের নাগরিক সেহেতু স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করার। আমার কাছে রাজু ভাস্কর্য মনে হয়েছিল স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতীক। সেই চেতনা থেকেই সেখানে ফটোশুট করা। ছবিগুলো ভাইরাল হবে এমন কোন চিন্তা মাথায় ছিল না। ২৩ জানুয়ারি ফটোশুট করা হলেও ২৫ জানুয়ারি সেগুলো আপলোড করা হয়। ফটোশুটের আগে এবং পরে ভয়ে ছিলাম। ছবি ফেসবুকে আপলোড করার ২ ঘণ্টা পরও দুশ্চিন্তায় ছিলাম আগের মতো সাড়া পাব কি না। এরপর বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন পেজে শেয়ার হতে থাকে। আমার ম্যাসেনজারে বিভিন্ন মিডিয়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করে। তখন আসলে বুঝতে পারিনি ছবিগুলো এতো সাড়া পড়বে। সবাই আমাকে সমর্থন জুগিয়েছে। এটা আমার কাছে বড় একটা প্রাপ্তি মনে করি। যা সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা যোগাবে।

নৃত্য গবেষক ও বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী সাধনা সংগঠনের লুবনা মরিয়ম আদর্শ হিসেবে মানেন মোবাশ্বিরা কামাল ইরা। তিনি বলেন, লুবনা মরিয়মকে খালা বলে সম্মোধন করি। তার সঙ্গে ২০২১ থেকে কাজ করছি। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করেন। ওনার কাজ আমার খুবই ভাল লাগে। ওনাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি যেমন নাচ নিয়ে পড়াশুনা করেছেন, আমিও নাচ নিয়ে পড়াশুনা করে রিসার্চ করতে চাই।

ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে ইরা বলেন, ভালভাবে পড়াশুনা করে এইচএসসি পাশ করতে চাই, যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে নাচ নিয়ে পড়াশুনা করতে চাই। যেন নাচের মাধ্যমে কথা বুঝাতে পারি। কথা দিয়ে নাচ না। আমাদের চলার অঙ্গভঙ্গি সবখানেই নাচের ব্যবহার আছে। নাচকে সমৃদ্ধ করে মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমাদের নাচের সংস্কৃতিকে বাহিরের দেশে এবং বাহিরের নাচের সংস্কৃতিকে দেশে পরিচিত করতে চাই। এ দুইয়ের সংমিশ্রণে নতুন একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে চাই।

ইরার মেঝ বোন জুয়াইয়া কামাল অর্ক। পড়াশুনা করছেন রাজশাহী হোমিও কলেজে। তিনি বলেন, আমরা অনেকেই চেষ্টা করেছি ছোট বোন ইরার মতো ব্যালে দিতে। কিন্ত তা না পারায় আফসোস থেকে গেছে। আশা করছি সে আরও ভাল করবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। আরও পরিচিতি লাভ করবে।

 

ইরার মা ফাহমিদা আক্তার বলেন, শুরু থেকে পারিবারিক তেমন সাপোর্ট পাওয়া যায়নি। মেয়ের ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকায় আমি চেষ্টা করেছি এ পর্যন্ত। ২০১৭ সাল থেকে তার নাচের হাতেখড়ি। মেয়ের একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে। কোথাও তাকে থেমে থাকতে হয়নি। এজন্য তার প্রতিভা দেখে আমারও আগ্রহ বাড়তে থাকে যদি একটু সহযোগিতা করা যায় তাহলে মেয়ে হয়তো আরও ভাল করতে পারবে। মেয়ের এই শখের নাচের বিশেষ ধরনের জুতা এখনো কিনে দিতে পারিনি। বাংলাদেশে সচরাচর এই জুতা পাওয়া যায় না। তাইতো খালি পায়ে অনেক কষ্টে ব্যালে নাচ করতে হয়।

মেয়ে শৈশব থেকে বিভিন্ন খেলায় পারদর্শিতা দেখিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাচের পাশাপাশি ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্রিকেট ও টেনিস খেলতো। এখনো নাচের পাশাপাশি জিম ও স্কেটিং খেলে। বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিল কিন্তু সময় স্বল্পতায় আর এগোনো সম্ভব হয়নি। তার নাচের শিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন- ‘মেয়ে নাচ ভাল করে সে সামনে এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে ভাল কিছু করবে বলে আশাবাদী।’ ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে তুরস্ক যায় ইরা। যেখানে বিশ্বের ৪৫টি দেশ নিয়ে শিশু সমাবেশ হয়। সেখানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির দলনেতা হিসেবে পুরুস্কার পায় সে। মেয়ে যেন প্রকৃত মানুষ হয় এবং পড়াশুনার পাশাপাশি সে যা করছে তা চালিয়ে যাবে। মেয়েকে নিয়ে অনেক আশা। দেশের পাশাপাশি বিদেশে সুনাম পাবে। এটাই আমার কাম্য।

নিজ বাড়িতে মোবাশ্বিরা কামাল ইরা, ছবি: সারাবাংলা

নিজ বাড়িতে মোবাশ্বিরা কামাল ইরা, ছবি: সারাবাংলা

ইরার বাবা আবু হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল বলেন, প্রথম চাওয়া হিসেবে মেয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষিত হবে এবং চাকরি করবে। আর দ্বিতীয়ত এ নাচকে সারাবিশ্বে পরিচিত করাসহ দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসবে। মেয়ে যতটুকু সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে সবটুকু চেষ্টা তার মায়ের। মেয়ের জন্য সে অনেক চেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।

নৃত্য রং একাডেমির নওগাঁর প্রশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, ইরা ছোট থেকেই আমার কাছে নাচ শিখেছে। সব শিক্ষার্থীকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালবাসি। হাতে গোনা যে কয়জন প্রথম সারির শিক্ষার্থী রয়েছে সে তাদের মধ্যে একজন। সে খ্যাতি অর্জন করে নওগাঁবাসীর মুখ উজ্জ্বল করবে এটাই আমার চাওয়া। তার জন্য অনেক শুভ কামনা রইল।

সারাবাংলা/এনএস

টপ নিউজ ব্যালে মোবাশ্বিরা কামাল ইরা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর