নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
৩০ মার্চ ২০২২ ২২:২১
ঢাকা: পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর, লোহালিয়া, ইটবাড়িয়া ইউনিয়নগুলো নদীবেষ্টিত। এর মধ্যে কমলাপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রাম ধরান্দী। বর্ষাকালে যাতায়াতের মাধ্যম নৌকা আর শুকনো সময়ে জমির আইল ধরেই ঘরে ফেরে এখানকার মানুষ। কৃষিপ্রধান যে গ্রামটিতে দিনের আলো ফুরতেই নেমে আসতো পিনপতন নীরবতা সেই গ্রামে এখন রাত অবধি চলে গল্প-আড্ডা, আসর বসে নাটক-সিনেমা দেখার। বিদ্যুতের আলো পৌঁছানোয় দেড় বছরেই বদলে গেছে এখানকার জনজীবন।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে থাকা রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ, বাইশখালী, নাটরের সুলতানপুর, পদ্মার চর থেকে শুরু করে পাহাড়, সমতল সবখানেই বিদ্যুতের আলো জ্বালিয়েছে সরকার। যেসব এলাকায় গ্রিড সুবিধা দেওয়া সম্ভব না, সেসব স্থানে সাগর ও নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল লাইন টেনে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর যেখানে এ উদ্যোগও কাজে দেয়নি সেখানে বসানো হয়েছে সৌর বিদ্যুৎ। এভাবেই প্রতিটি জনপদে পৌঁছানো হয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধা।
ইতোমধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে সফলতার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ভূষিত হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’-এ। এখন সামনের দিনগুলোতে সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করাই বিদ্যুৎ বিভাগের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নীতি নির্ধারকরা।
যেভাবে শতভাগে পৌঁছালো বিদ্যুৎ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। আর কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এবং পিছিয়ে থাকা জনপদে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে ছুটতে থাকে বিদ্যুতের বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের মোট ৪৯২ উপজেলার ৪৬২টিতেই বিদ্যুৎ সেবা দিতে পেরেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।
জানা গেছে, দেশের দুর্গম ১ হাজার ১৪৬ গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে নদীর তলদেশ থেকে সাবমেরিন ক্যাবল টেনে নেওয়া হয়েছে। এমন কঠিন কাজ বাস্তবায়নে ৯০টি জায়গায় ১৮২ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। আর যেসব স্থানে এই পদ্ধতিও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি সেসব জায়গায় দেওয়া হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ।
আরইবি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্রিড নেই এমন এক হাজার ৫৯টি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছেন তারা। যে কারণে মূল ভূ-খণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম এলাকার দুই লাখেরও বেশি পরিবারের ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আরইবি, পিডিবিসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ করেছে। গত তিন বছরে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মোট ১ হাজার ১৪৬টি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
১৩ বছরে যা পেয়েছে বিদ্যুৎ খাত
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ১৩ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যেখানে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ছিল, সেখানে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট। এছাড়া নির্মাণাধীন রয়েছে ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর বাইরে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। লাইন সঞ্চালন করা হয়েছে ৫ হাজার ২১৩ সার্কিট কিলোমিটার। ৩ লাখ ৬১ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
বর্তমানে বিদ্যুতের নতুন গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ১৩ লাখ। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ ভাগ থেকে শতভাগে উন্নীত। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ কিলোওয়াট থেকে ৫৬০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। সিস্টেম লসও কমিয়ে আনতে পেরেছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এছাড়া ইতোমধ্যে ৪৬ লাখ ৭৭ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
যাদের জীবন বদলে দিয়েছে বিদ্যুৎ
দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর চর মোন্তাজ একটি ইউনিয়ন। আরও আছে বড় বাইশ খালি, ছোট বাইশখালি, চালিতাবুনিয়া নিয়ে রাঙাবালী উপজেলা। উপজেলার সঙ্গে এসব ইউনিয়নে সরাসরি যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। জেলে আর মুটে-মজুরদের এইসব গ্রামে রাষ্ট্রীয় খবর পৌঁছাতেও লেগে যেত তিন দিন সময়। এখানকার মানুষদের কাছে বিদ্যুৎ ছিল স্বপ্নের মতো। সেই দুর্গম চর এলাকার ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুতের আলো। পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট ব্যবসা, মোবাইল টাওয়ারসহ আরও অনেক কিছু।
বাইশদির মুদি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি মুদি ব্যবসা ছেড়ে কম্পিউটার, ফটোস্ট্যাটের দোকান খুলেছেন। একই ইউনিয়নের খোকন মাঝি ধান চাষের পাশাপাশি কৃষিতেও পরিবর্তন এনেছেন। কারণ কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে পারেন তিনি।
পটুখালীর কমলাপুরের সুমন ব্যাপারীর দোকানে ফ্রিজ এসেছে। ফ্রিজে সে অনেক সামগ্রী রেখে বিক্রি করতে পারছেন। বিকাশের ব্যবসাটাও জমে উঠেছে। বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে এইসব চরাঞ্চল, দ্বীপের মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। কৃষিতে আধুনিকতা এসেছে, গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎচালিত ছোট ছোট কল কারখানা, হাঁস-মুরগির খামার। বিদ্যুৎ পাওয়াতে সবাই মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে সরকারের নানাধরনের সেবার পাশাপাশি কৃষি, ব্যবসা, স্বাস্থ্য, পড়াশুনার বিষয়ে তথ্য জানতে পারছেন অনেকে।
শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা
গত ২১ মার্চ পটুখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ওয়াদা পূরণ করেছে আওয়ামীলীগ সরকার। এখন প্রতিটি মানুষ আলোকিত হবে। আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। যা ইতোমধ্যে সফল হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের এই সফলতার স্বীকৃতি মেলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননায়। এবার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয় বিদ্যুৎ বিভাগকে।
এখনও লোডশেডিং
শুধু কাগজে-কলমেই নয়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা রয়েছে শতভাগ বিদ্যুতায়নের। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্রাহকরা বিদ্যুৎসেবা পাচ্ছেন না বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই কম-বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। এই গরমে লোডশেডিং আরও বাড়তে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ সংকট রয়েছে রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকায়ও। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় এখনো ক্যাপটিভ বিদ্যুতের (নিজস্ব ব্যবস্থা) ওপর নির্ভরশীল অনেক কলকারখানা।
বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারাও এই সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, বিদ্যুতের উৎপাদনে জোর দেওয়া হলেও এ খাতে অর্থ সংকট থাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বর্তমানে জ্বালানির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু ভর্তুকি কম। সব মিলিয়ে এবার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে বিদ্যুৎ বিভাগকে বেশ বেগ পেতে হবে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী যা বললেন
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শতভাগ বিদ্যুতায়নের সবটুকু কৃতিত্ব তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদুৎ। আজকের এই সাফল্যের কৃত্বিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার দূরদৃষ্টি সিদ্ধান্ত, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বিদ্যুৎ বিভাগ তার পেছনে থেকে এই সাফল্য নিয়ে এসেছে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে পাওয়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বিশাল অর্জন।’ সব কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘গ্রাহকরাও এই কৃতিত্বের অংশীদার।’ এই পুরস্কার বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এই সম্মান রক্ষা করা এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। আগামীতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিকল্পনা নিতে হবে।
নসরুল হামিদ বলেন, ‘সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতই এখন বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়তি। এ কারণে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও আশা করছি, আমরা সামলাতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘এখনও আমরা বড়ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমি মনে করি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে এখন যে প্রকল্পগুলো রয়েছে সেগুলো ক্ষেত্র তৈরি করবে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে নির্মিত পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া রামপাল ও মাতারবাড়ি যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে।’
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৬ সালে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শীর্ষক কর্মসূচি নেওয়া হয়। ওই উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি ভ্যান নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চালু করেছিল ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। সে উদ্যোগে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সারা ফেলেছিল। এবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে শতভাগ বিদ্যুতায়ন বাস্তবায়ন করল বিদ্যুৎ বিভাগ।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম