ভারতে পি কে হালদারের ২২ বাড়ি, দিনভর অভিযান ১০ জায়গায়
১৩ মে ২০২২ ২৩:১১
ঢাকা: এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর অর্থ লোপাট মামলার মূল অভিযুক্ত ও পলাতক আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের খোঁজে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে অভিযান চালানো হয়েছে।
শুক্রবার (১৩ মে) দিনভর কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার অন্তত ১০টি স্থানে তল্লাশি চালিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। অভিযানে পি কে হালদারের ২২টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। বাড়িগুলো থেকে জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি জব্দ করা হয়েছে।
কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অশোকনগর পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধার বিশাল বিলাসী বাড়ির সন্ধান পেয়েছে ভারতের ইডি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মৃধাকে তারা মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে চিনতেন। পি কে হালদার ও সুকুমার মৃধা অশোকনগরে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী। ইডি ধারণা করছে, এই দুজনের দীর্ঘদিনের যোগসাজশে এনআরবির বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ভারতী পল্লি এলাকার পাশে নবজীবন পল্লিতে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি পাওয়া গেছে পি কে হালদারের আত্মীয় প্রণব কুমার হালদারের। ঠিক তার পাশেই আরেক বিলাসবহুল বাগানবাড়ি সুকুমার মৃধার। মাছ ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও এলাকাবাসী সুকুমার মৃধার বিলাসী জীবন দেখে সব সময়ই সন্দেহ করত।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর তদন্তে জানা যায়, এই এলাকাতেই একাধিক সম্পত্তি ক্রয় করেছে হালদার-মৃধা জুটি। এর মধ্যে শুক্রবার শুধু অশোকনগরেই তিন বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। যার একটিতে এতদিন একাই থাকতেন সুকুমার মৃধার জামাতা সঞ্জীব হালদার।
সঞ্জীব জানান, প্রায় দুই বছর আগে শেষবার সুকুমার মৃধা অশোকনগরের এই বাড়িতে এসেছিলেন। মৃধার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা শুনেছি। তবে স্পষ্টভাবে কিছু জানি না।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সঞ্জীব হালদার নিজেও বাংলাদেশি নাগরিক। তিনি সুকুমার মৃধার যে বাড়িতে থাকছিলেন, সেটি মূলত পি কে হালদারের ভাই এনআরবিকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত প্রীতিশ হালদারের। স্থানীয়দের কাছে তিনি প্রাণেশ হালদার নামে পরিচিত ছিলেন। তিন থেকে চার বছর আগে প্রীতিশ হালদার তার বাড়িটি সুকুমার মৃধার নামে হস্তান্তর করেন।
পি কে হালদারের আরেক সহযোগী স্বপন মিত্রের বাড়িতেও অভিযোন চালিয়েছে ইডি। অশোকনগরের একই এলাকার বাসিন্দা স্বপন মিত্র অর্থ পাচারের কাজে অন্যতম অভিযুক্ত। তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে একাধিক নথি পাওয়া গেছে বলে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এরপর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আটক করে ইডি।
অশোকনগরের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলকাতার বাইপাস সংলগ্ন এলাকা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অভিজাত এলাকায় পিকে হালদার চক্রের একাধিক বাড়ি ও অফিস রয়েছে। সেখানেও তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। এখন পর্যন্ত অশোকনগরে শুধু একটি বিলাসবহুল বাড়িতে সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধার স্বামী সঞ্জীবকে পাওয়া গেছে। অন্যগুলো ফাঁকা ছিল। সঞ্জীবকে জেরা করছে ইডি। এ ছাড়া পি কে হালদারের আত্মীয় প্রণব কুমার হালদার এবং তার দুই ছেলে মিঠুন হালদার ও বিশ্বজিৎ হালদারকেও জেরা শুরু করেছে ইডি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রণব কুমার হালদার ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তার বড় ছেলে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এবং ছোট ছেলে মিঠুন হালদার বিএসএফ জওয়ান হিসেবে কর্মরত। আয় ও সম্পত্তি সঙ্গতিহীন হওয়ায় তারাও ইডির নজরে রয়েছেন। তাদের চার বিঘা জমির ওপর বিলাসবহুল বাড়িটি সব সময় এলাকাসীর মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। পিকে হালদারের পাচার করা টাকা ‘হাওলা’র মাধ্যমে ভারতে ঢুকেছে বলে ইডি ধারণা করছে।
কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, মুম্বাই ও ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে হালদার-মৃধা জুটির বিনিয়োগ রয়েছে বলে অনুমান করছে ইডি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশি হয়েও হালদার-মৃধা জুটির ভারতে প্রভাবের অন্যতম বড় কারণ ছিল স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।
শুক্রবার সকাল ৮টায় সুকুকামার মৃধার বাড়িয়ে তল্লাশি শুরু করে ইডি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অর্থ পাচার আইনের আওতায় বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। এরপর ইডির দল যায় অশোকনগরের একটি ব্যাংকের শাখায়।
সূত্র জানায়, এই ব্যাংকের মাধ্যমেই একাধিক সম্পত্তির লেনদেন করেছিলেন হালদার-মৃধা। ভরতে ৫০ হাজার রুপির বেশি জমা করতে গেলে অর্থের উৎস জানানো বাধ্যতামূলক, সেখানে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কেনার জন্য কীভাবে ব্যাংকে লেনদেন করা হলো, তা জানার চেষ্টা করছে ইডি। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে নামে-বেনামে পিকে হালদারের কোনো অর্থ আছে কিনা তাও জানার চেষ্টা করছে সংস্থাটি।
অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডি ডব্লিউ বলছে, মৃধার একটি বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করেছে ইডি। তবে এই অর্থ কোথায় থেকে এসেছে সেই বিষয়ে তারা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি।
ইডি সূত্র বলছে, তদন্ত শেষে জব্দকৃত অর্থের উৎস সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারবেন। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থ পাচার মামলার আসামি পি কে হালদার জড়িত কি-না তাও তদন্ত রিপোর্ট এলে জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সুকুমার মৃধা বাংলাদেশে বসবাস করলেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তার অনেক মাছের ভেড়ি আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে ইডি। সুকুমার মৃধার অবৈধ সম্পদ বা অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য দিয়েছিল কি-না সেটি ইডি সূত্র নিশ্চিত করেনি।
বহুল আলোচিত অর্থ পাচার মামলার আসামি পি কে হালদার বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পালিয়ে গেছেন। তাকে প্রত্যর্পণের জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাঝে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানতে পারে পলাতক পি কে হালদারের বিপুল সম্পদ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অশেকনগরে আছে পি কে হালদারের বাড়ি। এ ছাড়া ভারতের আরও কয়েকটি রাজ্যে তার বাড়ি আছে।
এর পরেই দুদক পি কে হালদারের বিষয়ে তথ্য পাঠায় ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এর কাছে। ভারতীয় একটি গণমাধ্যম বলছে, সেই তথ্য নিয়ে শুক্রবার অশোকনগরে অভিযান পরিচালনা করেছেন ইডি কর্মকর্তারা।
এই অভিযানের বিষয়ে জানতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ডি ডব্লিউকে তিনি বলেন, ‘আমিও সংবাদমাধ্যম থেকে এই বিষয়ে খবর পেয়েছি। বিস্তারিত কোনো তথ্য এখনও আমার জানা নেই।’
সুকুমার মৃধা বা পি কে হালদারের পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ সম্পত্তির বিষয়ে দুদক বা বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল কি-না তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তবে ‘মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসেসমেন্টের’ মাধ্যমে সহায়তা চাওয়ার সুযোগ আছে বলে তিনি জানান।
পি কে হালদার বা সুকুমার মৃধা বাংলাদেশ থেকে ভারতে অর্থ পাচার করলে সেটি ফেরত আনা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি। দুদকের এই আইনজীবী বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যদি নিশ্চিত করে এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে, তাহলে আদালতের মাধ্যমে আমরা সেটা জব্দ করতে পারব।
দুদক বলছে, হাজার কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করে দেশত্যাগী প্রশান্ত কুমার হালদারের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা।
পি কে হালদারের ক্ষমতার উৎস ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিভিন্ন সময়ে পি কে হালদার আর্থিক সুবিধা ও মূল্যবান উপহার দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের ওই দুই কর্মকর্তাকে বশে রেখে দুর্নীতির মাধ্যমে অবাধে অর্থ লোপাট করেছে।
পলাতক পি কে হালদারের আরেক সহযোগী সুকুমার মৃধাও বাংলাদেশ ত্যাগ করে। তার একটি বাড়ি আছে পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরে। পি কে হালদার ও সুকুমার মৃধার অবৈধ লেনদেন ছড়িয়ে আছে ঢাকা কলকাতা, হাওড়া, চেন্নাই, মুম্বাইয়ে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ টাকা ভারতে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় পি কে হালদার সম্পত্তি কিনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বরিশালের পিরোজপুরে বাসিন্দা পি কে হালদার। তার বাবা প্রয়াত প্রণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন গ্রাম্য বাজারের দর্জি। মা শিক্ষিকা। ছেলের এমন দুর্নীতির পর পি কে হালদারের মা ভারতের অশোকনগরে আরেক ছেলে প্রাণেশ হালদারের বাড়িতে চলে গেছেন।
পিকে হালদারের আয়কর আইনজীবী ছিলেন সুকুমার মৃধা। পিকে হালদারের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সুকুমার মৃধাকে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে। দুদক তাকে গ্রেফতার করেছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
আরও পুড়ন
পি কে হালদারের কাছে পাওনা ২৫৪ কোটি টাকা
জামিন পাননি পি কে হালদারের বান্ধবী নাহিদা
বেনাপোল দিয়ে দেশত্যাগ করেন পি কে হালদার
পি কে হালদারসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
আবারও পি কে হালদারসহ ১২৯ খেলাপিকে হাইকোর্টে তলব
‘পাসপোর্ট জব্দের আদেশের পরও পি কে হালদার কিভাবে বিদেশে’
পি কে হালদার ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ
টাকা ছাড়া পাঁচতারকা হোটেলের অংশীদার, পি কে হালদারের নামে মামলা
ঘুষে মিলত ভালো অডিট রিপোর্ট— পি কে হালদারের সহযোগীর জবানবন্দি
ইন্টারপোল শিগগিরই পি কে হালদারকে গ্রেফতার করবে: দুদক আইনজীবী
সারাবাংলা/একে