‘ধুমধাম করে বিবাহবার্ষিকী পালন করতে চেয়েছিল, মানুষটাই এখন নাই’
৩০ জুন ২০২২ ০০:০৫
সিরাজগঞ্জ: উৎপল কুমার সরকার। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। পেশায় শিক্ষক। কর্মসূত্রে থাকতেন রাজধানীর অদূরে সাভার এলাকায়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিউটি রানী নন্দীর সঙ্গে। পরের বছর মার্চ থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দেশে। মহামারি পরিস্থিতির কারণে দুই বছরের কোনোবারই বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান তেমন সাড়ম্বরে পালন করতে পারেননি।
এবার তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী সামনে রেখে বড় উদযাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন উৎপল। স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, ধুমধাম করে পালন করবেন। বড় করে অনুষ্ঠান করবেন। স্বজনদের নিমন্ত্রণ করবেন বাড়িতে। সে পরিকল্পনায় স্ত্রী বিউটি রানী নন্দীও ছিলেন উচ্ছ্বসিত। চলছিল নানা ধরনের পরিকল্পনা।
এই সব আয়োজনের পরিকল্পনা, সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস ভুলে যে শোকের সাগরে ভাসতে হবে, কেই বা তা ভেবেছিল! অথচ হলো ঠিক তাই। বয়োবৃদ্ধ মা গীতা রানী আর স্ত্রী বিউটি রানী নন্দীর দুই চোখে আজ কেবলই জল। ছাত্রের হাতে খুন হয়ে যে উৎপল আজ তাদের সবাইকে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
আরও পড়ুন-
- শিক্ষক উৎপল হত্যা: জিতুর বাবা ৫ দিনের রিমান্ডে
- শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা: অভিযুক্ত ছাত্র জিতু গ্রেফতার
- ‘উৎপলকে এনে দাও, আমার ছেলে এভাবে মরতে পারে না’
- সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা: অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা আটক
২৫ জুন আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে শিক্ষক উৎপলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ওই প্রতিষ্ঠানেরই দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল আহসান জিতু। ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে উৎপলকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন ভোরে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বামীকে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবেই পাগলপ্রায় স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী। বিশেষ করে ধুমধাম করে তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের যে পরিকল্পনা, তার মাত্র চার দিন আগে স্বামীকে হারানোর ঘটনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না মানুষটি নেই।
বুধবার (২৯ জুন) বিকেল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ীমোহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামে উৎপলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিলাপ করছেন স্ত্রী বিউটি রানী। অশ্রুসজল বিউটি বারবার শুধু বলছিলেন, ‘কয়েকদিন ধরেই বলছিল, আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীতে বড় করে অনুষ্ঠান করবে। মানুষটাই তো আর নাই।’
বিউটি রানী বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন) আমাদের বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হবে। ২০১৯ সালে ৩০ জুন আমাদের বিয়ে হয়েছিল। মানুষটার (উৎপল) খুব ইচ্ছা ছিল, আমাদের বিবাহবার্ষিকী বড় করে পালন করবে। করোনার কারণে গত দুই বছর পারেনি। এবার চেয়েছিল বড় অনুষ্ঠান করার। আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করার কথা বলেছিল। কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল!
স্বামীকে আর ফিরে পাবেন না— রূঢ় এ বাস্তবতা মেনে নিতেই হচ্ছে বিউটি রানী নন্দীকে। তবে যার কারণে স্বামীকে হারিয়েছেন, সেই আশরাফুল আহসান জিতুর উপযুক্ত শাস্তি চান তিনি।
বিবাহবার্ষিকী ঘিরে উৎপলের এই আয়োজনের কথা জানতেন পরিবারের বাকি সদস্যরাও। উৎপলের বাড়িতেই কথা হয় বড় ভাই অসীম কুমারের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, উৎপল আমার ছোট ভাই। খুব সাদাসিধে ছিল। ওর বিয়ে হয় তিন বছর আগে। কিছুদিন আগেই জানিয়েছিল, এবার ওর বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করবে বড় করে। আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করবে। কাল ওর বিবাহবার্ষিকী। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। শুধু আমার ভাইটাই নেই।
বলতে বলতে গলা ধরে আসে অসীম কুমারের। কান্নায় কথা বলতে পারেন না। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলেন, ভাইকে তো ফিরে পাব না। কিন্তু যারা ষড়য়ন্ত্র করে আমার ছোট ভাইকে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সমাজকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার ভাইয়ের। যারা ওর স্বপ্ন নষ্ট করেছে, তাদের ন্যায্য বিচার হোক— শুধু এইটাই চাওয়া।
উৎপলের শাশুড়ি ছবি রানী নন্দীও এসেছেন মেয়ের কাছে। কিন্তু মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার কণ্ঠেও। বললেন, মেয়েটার বিয়ে হয়েছে তিন বছর। স্বামী বাইরে থাকে। সংসার কী, সেইটাই এখনো ঠিকমতো বুঝতে পারল না। এর মধ্যেই আবার মেয়েটা বিধবা হয়ে গেল। যারা আমার মেয়েকে বিধবা করেছে, আমার মেয়ের জামাই উৎপলকে হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।
উৎপলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তার ভাই অসীম কুমার সরকার হত্যা মামলা করেন। মামলায় জিতুকে আসামি করা হয়। তবে ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিল জিতু। এর মধ্যে বুধবার জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে জিতুকেও। আদালতের মাধ্যমে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সারাবাংলা/টিআর