Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক ঝড়েই স্তব্ধ খন্দকিয়া

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩০ জুলাই ২০২২ ২০:০০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একেবারে ছায়াশীতল গ্রাম বলতে যা বোঝায়, গ্রামটি তেমন নয়। মানুষের কোলাহলে মুখর দোকান-বাজার, পুকুরের পাড়ে শান বাধানো ঘাট, গ্রামীণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসার পাকা আসন। চলতি পথে আরও দেখা মেলে পাকা সড়কের পাশে সারি সারি পাকা দালান। স্কুল, কলেজ মাদরাসা, বাজার- কমতি নেই কিছুর। মাঝে মাঝে সবুজ ক্ষেত, জলাশয়, সাদা বকের সারি। গাছের শাখায় পাখির আনাগোনা।

চট্টগ্রাম শহরের উত্তর প্রান্ত যেখানে শেষ, সেখানে হাটহাজারী উপজেলার শুরু। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয় ফেলে অল্প কিছুদূর এগোলেই উত্তর-পূর্বদিকে সড়কের প্রবেশপথে কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের গেট। সেই পথ দিয়ে মাইলখানেক এগোলে চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের ইউনূস নগর খন্দকিয়া গ্রাম।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে মীরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে চলন্ত মহানগর প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের আরোহী যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই খন্দকিয়া ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা। সকলেই কিশোর-তরুণ। অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্র। খন্দকিয়া যুগীরহাট এলাকার আরএনজে কোচিং সেন্টারের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের নিয়ে চার শিক্ষক পিকনিকের উদ্দেশে মীরসরাইয়ে গিয়েছিলেন।

তাদের হারানোর শোকে এখন মুহ্যমান পুরো গ্রাম। গ্রামটিকে এখন দেখে মনে হয়, যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে এর ওপর দিয়ে। মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনাটি গ্রামটির ওপর ঝড় হয়ে বয়ে গেছে। কোলাহলপূর্ণ একটি গ্রামকে পুরো স্তব্ধ করে দিয়েছে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি। ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। হাসি নেই চলতি পথের মানুষগুলোর কারো মুখে। চেহারায় বেদনার ছাপ, স্বজন হারানোর বেদনা।

বিজ্ঞাপন

হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রুহুল আমীন সবুজের দেয়া তথ্যমতে, দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জন হলেন- সামিরুল ইসলাম হাসান (১৬), মুসাব আহমেদ হিশাম (১৬), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৬), জিয়াউল হক সজীব (২১), ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৪), রিদওয়ানুল চৌধুরী (২২), মোস্তফা মাসুদ রাকিব (২০), আসিফুল ইসলাম আশিক (১৯), শান্ত শীল (১৯), সাজ্জাদ হোসেন (২০) এবং গোলাম মোস্তফা নীরু (২২)।

একই দুর্ঘটনায় আহত ছয়জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এরা হলেন- তছমির হাসান পাবেল (১৬), মহিবুল ইসলাম মাহিম (১৮), মো. সৈকত হোসেন (১৬), তানভীর আলম হৃদয় (১৮), আয়াতুল ইসলাম (১৬) এবং মাইক্রোবাসের চালকের সহকারী তৌকিদ ইবনে শাওন (২০)।

নিহতদের মধ্যে সাতজনের বাড়ি চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামে। নিহত রাকিবের বাড়ি একই উপজেলার শিকারপুর, সাজ্জাদের মাদার্শা, শান্ত শীলের সরকারহাট এবং আশিকের বাড়ি ফতেপুর গ্রামে।

আহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি খন্দকিয়া গ্রামে। শুধুমাত্র মাইক্রোবাসের চালকের সহকারী শাওনের বাসা চট্টগ্রাম নগরীর শেরশাহ এলাকায়।

জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে তিনজন স্কুলছাত্র ও ছয়জন কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সামিরুল, হিশাম ও মারুফ খন্দকিয়া গ্রামের কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সজীব ওমরগণি এমইএস কলেজের গণিত প্রথম বর্ষের ছাত্র। জিসান ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। রিদওয়ানুল চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রাকিব হাটহাজারী কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে অনার্সে ভর্তির জন্য অপেক্ষমাণ আছেন। আশিক ও শান্ত শীল কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

নিহত সজীব, রিদওয়ানুল, রাকিব ও জিসান যুগীরহাটের আরএনজে কোচিং সেন্টারের পরিচালক ছিলেন। সামিরুল, হিশাম, মারুফ, আশিক ও শান্ত ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহত সাজ্জাদ পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত নন। সজীবের বন্ধু হিসেবে তিনিও পিকনিকে গিয়েছিলেন। নিহত গোলাম মোস্তফা নীরুও সজীবের বন্ধু এবং মাইক্রোবাসটির চালক ছিলেন।

আহতদের মধ্যে তছমির, আয়াতুল ও সৈকত কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মাহিম ও হৃদয় কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

একইসঙ্গে যাওয়া কে সি শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. ইমন (১৯) অক্ষত আছেন। তাকে চমেক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।

আরএনজে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আরিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাইক্রোবাসের চালক ও সহকারীসহ মোট ১৮ জন মীরসরাই গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১১ জন কোচিং সেন্টারের ছাত্র। পাঁচজন ছাত্র মারা গেছে। ছয়জন আহত হয়েছে। কোচিং সেন্টারের চারজন পরিচালকের সবাই মারা গেছে। আমাদের বন্ধু সাজ্জাদ এবং মাইক্রোবাসের চালকও মারা গেছে।’

মারুফের সঙ্গে চলে গেল তার মায়ের স্বপ্নও

ইকবাল হোসেন মারুফের বাবার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা এলাকায়। শুরু থেকেই মা কামরুন নাহারের সঙ্গে স্বামীর বনিবনা ছিল না। মারুফ প্রথম সন্তান। এরপর যমজ ছেলে-মেয়ের জন্ম। তিন সন্তান জন্ম দিয়ে মারুফের বাবা আরেকজনকে বিয়ে করে ঘরে এনে কামরুন নাহারকে তাড়িয়ে দেন। তিন সন্তান দিয়ে কামরুনের ঠাঁই হয় খন্দকিয়া গ্রামের বাবার বাড়িতে। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলেকে বড় করছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার পর মারুফ সেনাবাহিনীকে সৈনিক হিসেবে যোগ দেবে, এমন একটি প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্তও হয়েছিল। কামরুনের বড় আশা ছিল, বড় ছেলে উপার্জন শুরু করলে অভাব ঘুচবে, ছোট দুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু মারুফের কবরের সঙ্গে কামরুনের স্বপ্নেরও কবর হয়েছে।

শনিবার (৩০ জুলাই) সকালে মারুফের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা কামরুন নাহার ও নানী নুরুন নাহার বিলাপ করছেন। তাদের সান্ত্বনা দিতে আসা মানুষগুলোর চোখেও অঝোর ধারায় ঝরছে পানি। কামরুন কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আল্লাহ আমার এত বড় সর্বনাশ কেন হল ?’ এই বলে বারবার মায়ের বুকে পড়ছিল।

নানী নুরুন নাহার বলেন, ‘আজ ১৩ বছর হয়েছে আমার মেয়েকে স্বামী তালাক দিয়েছে। আমরা মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ছেলে মারুফ বলল- আমার মাকে বিয়ে দিও না, আমি আমার মাকে খাওয়াব। মারুফ তো চলে গেল, এই মেয়েকে কে দেখবে, খাবে কিভাবে ? পিকনিকে যাবে বলে টাকা চেয়েছিল। আমরা টাকা দিতে পারিনি। তখন মারুফ মন খারাপ করেছিল। কোচিং সেন্টারের মাস্টাররা টাকা দিয়ে তাকে পিকনিকে নিয়ে যায়। সেই মাস্টাররাও মারা গেছে।’

একসঙ্গে পাঁচজনের জানাজা, ২০ হাত দূরত্বে কবর

খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কালো সামিয়ানা টানিয়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় পাঁচটি খাটিয়া। খাটিয়াগুলোতে চিরঘুমে আছে ওয়াহিদুল আলম জিসান, জিয়াউল হক সজীব, ইকবাল হোসেন মারুফ, গোলাম মোস্তফা নীরু ও সামিরুল ইসলাম হাসান।

সকাল থেকেই মাঠে লোকজনের আনাগোনা। ঘর ছেড়ে সকল পুরুষ, তরুণ, যুবক, কিশোর এসেছেন সেই মাঠে। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ। কেউ কাঁদছেন, কেউ স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। অঘোষিতভাবে বন্ধ স্কুল। মাঠ পেরিয়ে মানুষ জমে যায় সড়কেও। নিহতদের স্বজনরা কেউ আহাজারি করতে করতে, কেউ চোখের পানি নিয়ে হাজির হন জানাজার মাঠে।

সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় জানাজা। জানাজায় অংশ নেন হাটহাজারী থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম, নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শহীদুল আলম, হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রুহুল আমীনসহ হাজারো মানুষ।

জানাজাস্থলের অদূরেই বাড়ি পাঁচজনের। সজীব ও মারুফের কবর মাত্র হাত বিশেক দূরত্বে। কবরের আশপাশে নারীপুরুষের ঢল, সবাই শোকার্ত। বাকি তিনজনের খাটিয়া নিয়ে মানুষ এগিয়ে চলে তাদের বাড়ির দিকে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন হয়েছে।

নিহত শান্ত শীলকে তার বাড়িতে পারিবারিক শ্মশানে শনিবার সকাল ৭টায় দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমীন।

একসঙ্গে এত মৃত্যু আর দেখেনি খন্দকিয়াবাসী

জিয়াউল হক সজীবের লাশ যখন দাফন হচ্ছিল, তখনও তার ঘরের সামনে পড়ে ছিল রক্তমাখা তুলা, গজ-ব্যান্ডেজ। ঘরের ভেতরে স্বজনদের আর্তচিৎকার। প্রতিবেশিরা জড়ো হয়েছেন ঘরের উঠোনে। কয়েক হাত ব্যবধানে মারুফের নানার বাড়ি। সেখানেও মানুষের সমাগম।

খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দা গৃহবধূ রোখসানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত বড় ঘটনা কিভাবে ঘটে গেল ! মনকে কোনোমতে বোঝাতে পারছি না। আমার বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি সব এই গ্রামে। এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমরা কখনো দেখিনি।

মারুফের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশি বৃদ্ধা আতরজান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেটা (মারুফ) চোখের সামনে বড় হয়েছে। রাস্তায় দেখলে আদাব-সালাম দিত। নাতি হিসেবে ঠাট্টা করত। দোকানের সামনে বসে থাকত। কারও সঙ্গে কখনও বেয়াদবি করতে দেখিনি। সজীব, মারুফ দু’জনই ঘরের ছেলের মতোই ছিল। চোখের সামনে দু’টা ছেলে মারা যাবে এটাও দেখতে হল !’

কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাধন চন্দ্র নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই স্কুলে ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। আমার বাড়িও এখানে। আরও কখনও একসঙ্গে এত মৃত্যু, এত লাশ আমরা দেখিনি। আমার স্কুলের তিনটা মেধাবী ছাত্র এভাবে অকালে ঝরে গেছে, এটা ভাবতেও পারছি না।’

হাটহাজারীর বাসিন্দা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিহত হিশাম আমার স্ত্রীর বড় বোনের ছেলে। একটা দুর্ঘটনায় পুরো পরিবারটা বড় ধরনের ধাক্কা খেল। পুরো গ্রামের মানুষ শোক পালন করছে। আমরা হাটহাজারীতে এত বড় মৃত্যুর ঘটনা অতীতে শুনিনি।’

মাদার্শা এলাকার বাসিন্দা সাংবাদিক আমিন মুন্না সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে ক্রিকেট খেলতে আসা ১০ কিশোর-তরুণ একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল হাটহাজারীতে। এরপর হাটহাজারীর মানুষ এবার এত মৃত্যু একসঙ্গে দেখেছে। নিহতরা সবাই কিশোর-তরুণ। স্বাভাবিকভাবেই এই মৃত্যু মানুষের মনে দাগ কেটেছে। এই বেদনা খন্দকিয়ার মানুষ অনেকদিন ভুলতে পারবে না।’

স্কুলে তিনদিনের শোক

সাবেক বর্তমান ছাত্রদের মৃত্যুর ঘটনায় কে এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনদিনের শোক কর্মসূচি শনিবার থেকে শুরু হয়েছে। উত্তোলন করা হয়েছে কালো পতাকা।

নিহত তিন ছাত্র সামিরুল ইসলাম হাসান (১৬), মুসাব আহমেদ হিশাম (১৬), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৬) এই স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিশামের রোল নম্বর ছিল ১৭। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্র সামিরুলের রোল নম্বর ২৮ ও মারুফের ছিল ২৫। মারুফ ও হিশাম স্কুলের বিএনসিসি সেনা শাখার ক্যাডেট ছিলেন।

কোচিং সেন্টারের চার পরিচালক নিহত সজীব, রিদোয়ান, রাকিব ও জিসান এবং নিহত সাজ্জাদ ২০১৬ সালে এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। মাইক্রোবাসের চালক নীরু ২০১৩ সালে একই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন বলে জানান শিক্ষক সাধন চন্দ্র নাথ।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ শফিউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনটা মেধাবী ছাত্র চলে গেল। এই শোক আমরা সহ্য করতে পারছি না। সকল শিক্ষকরা মিলে বৈঠক করে তিনদিনের শোক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সোমবার পর্যন্ত পাঠদান বন্ধ থাকবে। মঙ্গলবার শোকসভা হবে। রোববার আমরা সকল শিক্ষকরা মিলে নিহত সবার বাড়িতে সমবেদনা জানাতে যাব।’

দুই মাসেই ‘ঝড়ের কবলে’ আরএনজে কোচিং সেন্টার

খন্দকিয়া যুগীরহাটে তিনটি কোচিং সেন্টার। আরসিএইচ, আরসিএইচ প্লাস এবং আরএনজে। নিহত চারজন সজীব, রিদোয়ান, রাকিব ও জিসান একসময় আরসিএইচ কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান আরসিএইচ প্লাসে। এরপর দরিদ্র পরিবারের সন্তান সজীবের উদ্যোগে তারা চারজন নিজেরাই গড়ে তোলেন আরএনবি কোচিং সেন্টার।

বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ভাড়া নিয়ে তারা চালু করেছিলেন এই কোচিং সেন্টার। এর সঙ্গে লাগোয়া এস আর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি স্টেশনারি দোকানের মালিক মোহাম্মদ মিজান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চারজন আগে অন্য কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। সেখানে মনোমালিন্য হওয়ার পর চারজন বেরিয়ে আসেন। এরপর নিজেরাই কোচিং সেন্টার খোলেন। মাত্র দুইমাস আগে এটি চালু হয়।’

আরএনবি’র চার পরিচালকের কেউ আর বেঁচে নেই। পিকনিকে না যাওয়ায় প্রাণে বেঁচেছেন দুই শিক্ষক। এদের মধ্যে একজন নিহত জিসানের বোন।

আরএনজে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আরিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আমি সিউর ছিলাম যে পিকনিকে যাব। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আর মন টানছিল না। আমি জানিয়ে দিই যে যাব না। মেয়ে হওয়ায় জিসানের বোনকে পিকনিকে নেয়া হয়নি। সকাল ১১টার দিকে আমি রিদোয়ান ভাইকে ফোন করি। উনি বললেন, আমরা খৈয়াছড়া দেখে সীতাকুণ্ডে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে যাব। সেখানে যাবার পথেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। আমি প্রথমে খবর পাইনি। ফেসবুকে ঘটনাটা ভাইরাল হওয়ার পর আমার চোখে পড়ে।’

কোচিং সেন্টারের ছাত্র সাকিব হোসেনেরও পিকনিকে যাবার কথা ছিল। সাকিব কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু বাবা নিষেধ করায় সাকিব আর যাননি।

সাকিব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাবার চায়ের দোকান আছে। বাবা বলেছে- সকালে দোকান খুলতে হবে, পিকনিকে যাওয়া যাবে না। আমি পিকনিকে যাবার জন্য ৫০০ টাকা চেয়েছিলাম। সেই টাকাও আমাকে দেয়া হয়নি। বাবার ওপর রাগ করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে বাবা যেতে না দেয়ায় প্রাণটা রক্ষা পেয়েছে।’

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা।

আরও পড়ুন
রাজবাড়ীতে বেআইনিভাবে রেলের ট্রলি তৈরির অভিযোগ, শেষে দুর্ঘটনা
রেলের গেটম্যান সাদ্দামকে আসামি করে মামলা
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা: রেলের ২ তদন্ত কমিটি
রেল দুর্ঘটনা এড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি
রেলের প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা, সংসদীয় কমিটির অসন্তোষ
শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী ট্রেন দুর্ঘটনায়, ‘মাগনা’ তেল নিতে বাড়ছে ভিড়
‘ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে চক্রান্ত আছে কি না, তা তদন্ত হবে’
সিগনালে ভুল বোঝাবুঝি থেকে দুর্ঘটনা, প্রাথমিক ধারণা

সারাবাংলা/আরডি/একে

খন্দকিয়া গ্রাম রেল দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর