যানজটে নাকাল নগরীতে মুক্তির আনন্দ দেবে মেট্রোরেল
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৪৪
ঢাকা: আগামী ২৮ ডিসেম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে রাজধানীতে চলবে দেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন মেট্রোরেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সেই স্বপ্নযাত্রার শুভ সূচনা করবেন। এমন তথ্যই জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ চালু হলে মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছানো যাবে গন্তব্যে। সেদিক থেকে এই পরিমান পথে নিঃসন্দেহে সময় কমে আসবে প্রায় দুই ঘণ্টা।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলেও এখনি যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলছে না। তবে এটুকু পথ যে দ্রুত গতিতে আসতে পারছেন তাতেই আপাতত খুশি সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, যানজটে নাকাল থাকা নগরীতে কিছুটা হলে স্বস্তি দেবে মেট্রোরেল।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পুরো চাপ রাজধানীতে নিতে না হলেও বাংলাদেশের পুরো চাপ ঢাকাকেই বহন করতে হচ্ছে। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। নামি-দামী স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, শিল্প কারখানা, আদালত সবকিছু ঢাকাতে থাকায় প্রতিনিয়ত জীবিকার তাগিদে শত শত মানুষ ঢাকামুখী হোন। এ কারণে সঠিক নগর ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু তার বাস্তবায়ন তো হয়ইনি বরং দিনকে দিন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ঢাকার রাস্তা হয়ে গেছে সংকুচিত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি।
অন্যদিকে কমে গেছে গণপরিবহন। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে রাজধানীতে নানা পরিকল্পনা নেয় সরকার। সেই পরিকল্পনার এক বিশেষ সংযোজন ছিলো মেট্রোরেল। মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগে ২০১২ সালে সায় দেয় সরকার। এরপর গবেষণা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সরকার। পরের বছর প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ শুরু করে।
উড়াল ও পাতাল মিলিয়ে মোট ৬ ধাপে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এরমধ্যে এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫ এ দুই রুট রয়েছে নর্দান ও সাউদার্ন, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪। উত্তরা এলাকার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল ডিপো নির্মাণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এমআরটি লাইন-৬ এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আর দ্বিতীয় ধাপে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চালুর কথা রয়েছে। আর তার পরে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত চালু করা হবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানসিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মাসিক প্রতিবেদন বলছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেলপথের অগ্রগতি ৯৭ শতাংশের বেশি। এই অংশই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। উদ্বোধনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, প্রায় ৯০ ভাগ প্রস্তুতি শেষ। স্টেশন এবং এ সম্পর্কিত সব কাজ প্রায় শেষ। বাকি কাজ উদ্বোধনের আগে শেষ হয়ে যাবে।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার সংবাদে খুশি সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ঘণ্টার পর ঘন্টা বাসে বসে জ্যামে আটকে থাকতেন। গাজীপুর-যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচল করে গণপরিবহন তুরাগ। মতিঝিলমুখি অনেক যাত্রীই এই পরিবহনে এসে কমলাপুর নেমে মতিঝিল চলে যান। এমন একজন যাত্রী মাইনুল ইসলাম কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। উত্তরা বাসা হওয়াতে প্রতিদিন সকাল সাতটায় তাকে বাস ধরতে হয়। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হলে তিনি ওই রুটে চলাচল করবেন। কারণ ২০ মিনিটে যদি আগারগাও পৌঁছাতে পারেন তাহলে এখন যে সময় লাগে তার থেকে অন্তত এক ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে পারবেন।’
আরও বেশি খুশি পল্লবী মিরপুর দশ নম্বরের যাত্রীরা। বিকল্প গাড়িতে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পল্লবী থেকে বাসে মতিঝিল কিংবা শাহবাগ যেতে বিশাল জ্যামের রাস্তা পার হতে হতো। তার ওপরে দীর্ঘ সময় মেট্রোরেলের কাজ চলায় জ্যাম আরও বেড়েছে। একে তো জ্যাম তার ওপরে বাসগুলো যাত্রী নেওয়ার জন্য একেকটি স্টপিজে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। এটা অনেক অসহ্য একটা বিষয়। মেট্রোরেল চালু হলে আমাদের জন্য খুব উপকার না হলেও অন্তত দশ মিনিটে দশ কিলোমিটার পথ তো পার হওয়া যাবে। এটাও অনেক স্বস্তির।’
এই পথের রিকশাচালক মো. মোছলেম বলেন, ‘মেট্রোরেল শুনছি বিদেশে চলে, এখন দেশে চালু হচ্ছে এটা গর্বের। চড়তে না পারি গর্বতো করতে পারবো। মানুষ যখন ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবে তখন জ্যাম কমে যাবে।’
এদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে মেট্রোরেল চালু হলেও এখনি যানজট কমে যাবে তা ভাবা ঠিক নয়। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে পথে মেট্রো চালু হচ্ছে সে এলাকায় যারা বসবাস করেন, মেট্রো চালু হলে তাদের যাত্রা হবে আরামদায়ক ও নিরবচ্ছিন্ন। যাত্রীরা নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। এখন যে ব্যবস্থা তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে সবাইকে মেট্রো সুবিধা পেতে আরও সময় লাগবে। পুরোপুরি মেট্রোরেল চালু হলেই কেবল যানজট থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।’
জাপান সরকারের অর্থায়নে রাজধানীবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএল। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মেট্ররেল চলবে ১০০ কিলোমিটার গতিতে। তবে উদ্বোধনের পরপরই পুরোদমে চলবেনা। প্রথম সপ্তাহে শুধু সকাল ও বিকাল চলবে। ধীরে ধীরে সময় বাড়তে থাকবে। প্রথম দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার এই রেল পথে সময় লাগবে ২০ মিনিট। পূর্ণমাত্রায় চালু হলে তা নেমে আসবে ১৬ থেকে ১৭ মিনিটে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত যুক্ত হওয়ায় এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল সংক্রান্ত আরও সংবাদ:
মেট্রোরেলের ভাড়া কিলোমিটারে ৫ টাকা
চট্টগ্রামেও চলবে মেট্রোরেল, হচ্ছে ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান
মেট্রোরেলের যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাবে বিআরটিসি’র বাস
মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহন এ মাসেই, চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
মেট্রোরেলের টিকিট সংগ্রহ এবং যাতায়াত যেভাবে
মেট্রোরেলে যাতায়াতের নিয়ম জানা যাবে এমইআইসি থেকে
মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা
সড়ক থেকে সরছে মেট্রোর নির্মাণসামগ্রী, স্বস্তিতে নগরবাসী
রাত বারোটা পর্যন্ত ১০ মিনিট পর পর চলবে মেট্রোরেল
মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও পথে অগ্রগতি ৯৭.৬০ শতাংশ
যাত্রীদের মেট্রোরেলে চলাচলের ধারণা দিতে ‘মেট্রোগার্ল’ উদ্যোগ
২০৩০ সালের মধ্যে প্রস্তুত হচ্ছে আরও তিন মেট্রোলাইন
১০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটবে বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল
সারাবাংলা/জেআর/এমও