Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সেপ্টেম্বরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছাড়িয়ে গেল আগস্টকেও

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:০৩

ঢাকা: এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ পর্যন্ত বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ জন। সেখানে চলতি বছরের আগস্ট মাসেই মারা যান ৩৪২ জন। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগস্ট মাসের ভয়াবহতাকেও।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের প্রথম ১৫ দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৪৩ জন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে আগস্টের তুলনায় ১১৩ জন বেশি অর্থাৎ ৩৮ হাজার ১৫৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যাও সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে আগস্টের তুলনায় বেশি। আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭৫ জন মারা গেলেও সেপ্টেম্বরে ১৯৭ জন মারা গেছেন।

বিজ্ঞাপন

দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুর প্রকোপ পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। ফলে চলতি সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে গভীর শঙ্কার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি ভয়াবহ

সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৬ জন। এর মাঝে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১৩ হাজার ৪৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে এই সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে দেশের অন্য এলাকায় ২৪ হাজার ৬৭৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলো থেকে সুস্থ হয়ে ১২ হাজার ৭২৪ জন ডেঙ্গু রোগী ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকে ২৩ হাজার ২৭২ জন ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

বিজ্ঞাপন

সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৯ জন মারা গেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৮ জন।

১০ সেপ্টেম্বর দেশে দুই হাজার ৯৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় যা দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাসে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ।

১৫ হাজার ২২২ জন মহিলা সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্যদিকে ২২ হাজার ৯৩৪ জন পুরুষ সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে নারীদের সংখ্যা বেশি। সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে দেশে ১১২ জন নারী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন। অন্যদিকে এই ১৫ দিনে ৮৫ জন পুরুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবার এখন রোগীর যে সংখ্যা দেখা গেছে তা উদ্বেগজনক। তাই সামনের দিনগুলোতে সতর্ক না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশা নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’

এমন পরিস্থিতি কেন?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা, তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তো ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটবেই। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের জন্য সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত অভিযান দরকার। সেই পরিকল্পনাও করা হয়নি, শুরুও করা হয়নি। মশা নিধনের  ওষুধ, মাঠপর্যায়ে কতখানি কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা, সেটি দমন বা নির্মূলের ব্যর্থতার জন্যই মূলত ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমাদের ডেঙ্গুর উৎস ধ্বংস করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রজনন হচ্ছে তা যদি আমরা ধ্বংস করতে না পারি, তাহলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমাদের সবাইকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রতিটি বাড়ির মালিককে নিশ্চিত করতে হবে তার বাড়ির কোথাও পানি জমে থাকবে না। এটি যদি যার যার অবস্থান থেকে আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এডিস মশার বংশবিস্তার কমে যাবে। মশার বংশবিস্তার কমে গেলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তা না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন।

ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে। যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, সংক্রমণ আগস্টে শীর্ষে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এবারের সংক্রমণকে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। কারণ গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর একটু কম ছিল। চলতি বছর মার্চ থেকে বাড়তে শুরু করে।’

‘মশা মারতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন’

সারাদেশে এডিস মশা মারতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, ডেঙ্গু যতটি মেডিকেল প্রবলেম, তার থেকে বেশি এনভায়রনমেন্টাল প্রবলেম। সে জায়গায় পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বেশি জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘প্রাইমারি হেলথ এবং পাবলিক হেলথ এক নয়। পাবলিক হেলথ হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা। এগুলো যদি আমরা বৃদ্ধি করতে না পারি, ডেঙ্গু রোগী যদি এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, আমাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হবে। জরুরি ভিত্তিতে মশা নিয়ন্ত্রণে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম, যারা এই সমস্ত কাজ (মশা নিয়ন্ত্রণ) করছেন, তারা যদি এই কাজগুলো আরও বেশি বৃদ্ধি করেন; যেভাবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটি কমানো যাবে এবং ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাও ভালোভাবে দেওয়া যাবে।’

অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর আরও বলেন, ‘সারাদেশেই বর্তমানে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এখন ঢাকা সিটির পাশাপাশি ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বেশি। এডিস মশা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে।’

আরও পড়ুন
সেপ্টেম্বর মানেই ডেঙ্গু আতঙ্ক
আক্রান্ত হয়েই ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’, কী বলছেন চিকিৎসকরা
‘নির্বাচিত সরকার থাকলে ডেঙ্গুতে এত প্রাণহানি ঘটত না’
সরকার ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়ঙ্কর: মির্জা ফখরুল
ডেঙ্গুতে আর মৃত্যু দেখতে চাই না: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ডেঙ্গুর চেয়েও বিএনপি মারাত্মক : তথ্যমন্ত্রী
‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে’
বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে মহামারি আকারে: ডব্লিউএইচও

 

 

 

সারাবাংলা/এসবি/একে

এডিস মশা ডেঙ্গু ডেঙ্গু রোগী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর