বিজ্ঞাপন

সেপ্টেম্বর মানেই ডেঙ্গু আতঙ্ক

September 1, 2023 | 10:53 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ পর্যন্ত বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ জন। সেখানে চলতি বছরের আগস্ট মাসেই মারা গেছেন ৩৪২ জন। এদিকে দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুর প্রকোপ পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। ফলে এ বছরের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে গভীর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বিজ্ঞাপন

দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রথম আলোচনায় আসে ২০০০ সালে। এরপর থেকে ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসেই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এর পরের বছরগুলোতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রভাবে কিছুটা নজরদারির অভাবে ২০২০ ও ২০২১ সালের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে ২০২২ সালেও সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রভাব ছিল বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়ানো সেপ্টেম্বর

স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিল তিন হাজার ১৬২ জন। ওই বছরে জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলেও ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে।

২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬০ জনে। ওই বছর মে মাস থেকে দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। জুন, জুলাই, আগস্ট পেরিয়ে সে বছরও সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ডেঙ্গু: আগস্ট ছিল ভয়াবহ

২০১৭ সালে জানুয়ারি মাস থেকেই পাওয়া যায় ডেঙ্গুর রোগী। তবে জুন মাস থেকে প্রকোপ বাড়তে থাকে। আগের বছরের মতোই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে ৩৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই বছরে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল এক হাজার ৬৪১ জন।

২০১৮ সালে ছাড়িয়ে যায় আগের সব বছরের রেকর্ড। এ বছরে মোট ১০ হাজার ১৪৮ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে কেবল সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৮৭ জন।

বিজ্ঞাপন

এরপর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ ২০১৮ সালের রেকর্ডও ছাড়ায়। ওই বছর অবশ্য আগস্টে সংক্রমণ ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই এক মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৫২ হাজার ৬৩৬ জন। সেপ্টেম্বর মাসে সেই সংখ্যা কমলেও সংখ্যাটি ছিল ১৬ হাজার ৮৫৬ জন।

সর্বশেষ গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে অবশ্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি ২১ হাজার ৯৩২ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায় অক্টোবর মাসে। পরের মাস নভেম্বরে ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ১৯ হাজার ৩৩৪ জন। আর সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৯১১ জন, যা আগস্ট মাসের প্রায় তিন গুণ। সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ না হলেও আগস্টের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সংক্রমণ সেপ্টেম্বরকে ডেঙ্গুর জন্য ভয়াবহ হিসেবেই প্রমাণ করেছে।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমেণর যে চিত্র, তাকে উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তাহলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের বড় একটি অংশই শিশু। ছবি: হাবিবুর রহমান

এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে ড. কবিরুল বলেন, সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগী সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশা নিধনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এগুলো করতে না পারার কারণেই এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাবিশ্বেই হঠাৎ দাপদাহ বা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। তাই সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। তবে বর্ষার শুরু ও শেষে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে। আগস্টের সংক্রমণই সর্বোচ্চ থাকতে পারে। তবে মশা মারতে না পারলে সেপ্টেম্বরেও এর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

আরও পড়ুন- ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ১৫৩৪

সেপ্টেম্বরে সংক্রমণের প্রকোপ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, সেপ্টেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকবে। হয়তো ডেঙ্গু অনেক বেশি বাড়বে না। আবার অনেক কমে যাবে, তাও নয়। সেপ্টেম্বরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে।

মশা নিধন করতে না পারাকেই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্যবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করতে সংস্থাগুলোকে গুরুত্ব বেশি দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে বলছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। সামনে আরও নগরায়ন হবে, আরও উন্নয়ন হবে। তাই আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।

ডেঙ্গুকে স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশগত সমস্যা হিসেবেও অভিহিত করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, এখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের ভূমিকা জরুরি। প্রাইমারি হেলথ আর পাবলিক হেলথ এক নয়। পাবলিক হেলথ হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা। এরকম উদ্যোগ বাড়াতে না পারলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন