শিক্ষা ব্যবস্থার সমূহ অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রসঙ্গে
২২ আগস্ট ২০২৪ ১৪:০৩
সংস্কারের অগ্রাধিকারে থাকা দরকার শিক্ষা। কারণ একটি দেশের শিক্ষা হলো স্থায়ী উন্নয়নের প্রধান সোপান। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পদে পদে বৈষম্য আর ব্যবধানের চিত্র। বর্তমানে শুরু হওয়া শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের জোর আপত্তি, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় আলাদা আলাদা বেতন কাঠামো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ম্যানেজিং কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা বাণিজ্যে অসহায় অভিভাবকসহ আরও নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের শিক্ষাঙ্গণ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার একটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংস্কার। সেক্ষেত্রে প্রথমেই বেসরকারি স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা পুনর্বিবেচনা করার দাবী জানাই। সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করা সবচাইতে ধুরন্ধর ও নিম্নমানের ব্যক্তিরা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটিতে আসেন। সিংহভাগ পরিচালনা কমিটি নিরক্ষর ও ভিলেজ পলিটিক্সের সাথে জড়িত; ফলে এ সব ব্যক্তিবর্গ কারণে-অকারণে শিক্ষকদের সাথে বিরুপ আচরণ করেন থাকেন। ইএফটিতে বেতন-ভাতা চালু না থাকার কারণে পরিচালনা কমিটির সভাপতির স্বাক্ষরে প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে শিক্ষকদের বেতন উত্তোলন করতে হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি বেতনশীটে স্বাক্ষর করার সময় প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি ফি, রেজিষ্ট্রেশন ফি ও ফরমপূরণবাবদ আদায়কৃত অর্থে জোরপূর্বক ভাগ বসান এসব পরিচালনা কমিটি। বড় একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে। এরকম সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ফলপ্রসূ ও বাস্তবধর্মী নীতিমালা তৈরী করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাই।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে, সিলেবাস নিয়ে সম্প্রতি অনেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক আন্দোলনে নেমেছিলেন। সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনা সময়ের দাবী। ব্যবহারিক শিক্ষাপদ্ধতি চালুসহ তার প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানাই। গাদা গাদা বই শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেবার কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠবিমুখ হয়ে পড়েছে। বইয়ের বোঝা কমানো এবং মানসিক চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। দেশের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ একেবারে শুরু থেকেই মৌলিক জ্ঞান অর্জন করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। ১ম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১২ বছর বাধ্যতামূলক ইংরেজি পড়ার পরেও ৯০% শিক্ষার্থী ইংরেজি বলতে পারে না এমনকি একটি বড় অংশই রিডিং পর্যন্ত পারে না। এমনকি বাংলাও সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। বিভিন্ন সময়ে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিপরীতে যারা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে তারা মাত্র ৩-৬ মাসের স্পোকেন ইংলিশ কোর্স করে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। এতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়- আমাদের সিলেবাসের মধ্যেই যত গণ্ডগোল। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদদের, প্রয়োজনে তৃণমূলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করে বাস্তবমুখী ও ব্যবহারিক সিলেবাস প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার আমূল পরিবর্তন আনতে আপনাদের কাছে জোর দাবী রয়েছে।
বেসরকারি (এমপিও ভুক্ত) শিক্ষকরা শুরু থেকেই বৈষম্যের শিকার। বর্তমান সময়ে এসেও মাধ্যমিকের একজন শিক্ষকের বেতন মাত্র ১১৫০০ টাকা! কলেজ শিক্ষকের ২২০০০ টাকা! অথচ দুই জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা একই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাংলাদেশে একজন শিক্ষক পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে জীবনকে যাপন করেন- এ খোঁজ কোনদিন কোন স্বৈরাচারী সরকার বা আমলারা রাখেননি। ফলে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী না হয়ে মনোযোগী হন প্রাইভেট, টিউশনী অথবা অন্য কোন ব্যবসায়। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের দেয়া হয়- সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা। ফলে তারা তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করেন শিক্ষার্থীদের পেছনে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশে শিক্ষকরা টিউশনি ব্যবসায় জড়িত থাকেন কি না আমার জানা নাই। আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করে তাদের মানের দিকে নজরদারির দাবী জানাই। সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষকরা কোচিং ব্যবসায় যাতে যুক্ত হতে না পারেন- এজন্য আমাদের সবধরনের উদ্যোগ হাতে নিতে হবে।
১০-১২টি বিষয় (বইয়ের) কারণে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন অন্তত ৭-৮টি করে ক্লাস করতে হয়। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করার পরে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা আর লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে পারে না। অথচ প্রতিদিনের ক্লাসের সময়সূচি ৪ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তাদের উপর কিছু বাড়ির কাজ চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলে তারা প্রতিষ্ঠানে ও বাড়িতে লেখাপড়ায় মনোযোগ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্ম- এই ৪টি বই (বিষয়ে) সীমাবদ্ধ রাখা। এবং মাধ্যমিকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্ম, ইতিহাস ও বিজ্ঞান- এই কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে ভালো হয়। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মাধ্যমিকের বিষয়গুলোর সাথে তথ্যপ্রযুক্তি (প্রচলিত নয়, ব্যবহারিক জ্ঞান সম্বলিত প্রযুক্তি) ও ভূগোল বিষয় বাধ্যতামূলক করা জরুরী। উল্লেখ্য, বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির সিলেবাসে মাধ্যমিক স্তরে তথ্য প্রযুক্তিসহ আরও কিছু বিষয় চালু রয়েছে, কিন্তু এ সমস্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম কোন জ্ঞান অর্জন করে না। অযথা সিলেবাসের বোঝা ভারী করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়টি মুখস্ত বিদ্যার চেয়ে ব্যবহারিক কাজ করানো শিখাতে হবে। এছাড়া প্রাথমিকের এই দীর্ঘ সময়সূচি নিয়েও রয়েছে আপত্তি। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা যায় কি না তা পুনরায় বিবেচনার দাবী রাখে। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকদের টিফিন ভাতা মাত্র ২০০ টাকা যা একটি উপহাস ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। তাছাড়া চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও সময়ের সাথে সমতাকরণের দাবী রাখে। প্রাথমিকের শিক্ষকদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন স্কেল প্রদান করার দাবী। একজন মাস্টার্স পাশ শিক্ষকও তৃতীয় শ্রেণির স্কেলে বেতন পায়। এটা অপমানজক এবং সম্ভবত এই উপমহাদেশে আর কয়টি উদাহরণ আছে আমার জানা নাই।
সারাদেশের গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক নেতারা নিয়োগ-বাণিজ্যসহ অশুভ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৩-৪টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং প্রভাব খাটিয়ে এমপিও ভুক্ত করেছেন। অথচ কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ২০ জন শিক্ষার্থীও ভর্তি হয় এবং ওই ২০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৫ জন। সরকার পুরোটাই ভর্তুকি দিয়ে এসমস্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সঠিক মনিটরিং এর মাধ্যমে সারাদেশের অকার্যকর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে পার্শ্ববর্তী বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করার ব্যবস্থা করা গেলে বিপুল পরিমাণে অর্থ অপচয়ের হাত থেকে আমরা মুক্তি পাব। অন্য স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অবস্থা রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সেসব খবর পাওয়া যায়। দেখা যায়, কোনো কলেজে ছাত্রছাত্রীর তুলনায় শিক্ষক বেশি! এসব অপচয় বন্ধ করা প্রয়োজন এবং কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদ বন্ধ করতে হবে।
বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতায় কিশোর গ্যাং ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ামহল্লায়। গ্রামগঞ্জের অনেক মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থী ভার্চুয়াল ভাইরাসসহ মাদকে আসক্ত। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের, অন্যদিকে তারা বিভিন্নপ্রকার কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের কোমলমতি শিশুদের রক্ষায় সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে রাষ্ট্র। অভিভাবকরা ইদানীং তাদের সন্তানদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাই তারা ফেরাতে পারবেন না। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলেই নতুন কিছু প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে আমাদের শিশু-কিশোরদের সুপথে আনতে পারেন। এ জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে গোঁড়ায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটর বাইক চালানো ও শিশু-কিশোরদের অবাধে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম যেমন, বইপড়া, আবৃত্তি, অভিনয়, স্কাউট, গার্লস গাইড, বিজ্ঞান ক্লাবের ব্যবস্থা করতে হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা ৪ শ্রেণিতে বিভক্ত। ২০% শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। বাকিদের মধ্যে ২০% সারাদিন মোটরবাইক নিয়ে সর্পিল ভংগিতে রাজপথ কাঁপায়। ২০% রাজনৈতিক নেতাদের মুঠির মধ্যে ঢুকে চাঁদাবাজীসহ কিশোর গ্যাং এ যুক্ত। আর ৪০% শিক্ষার্থী মোবাইল গেম ও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত।
দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক/সহকারী গ্রহন্থারিক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, অথচ সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানে কার্যকরী গ্রন্থাগার নাই। বয়স উপযোগী গল্পের বই/সৃজনশীল বই নাই। ফলে শিক্ষার্থী বইপড়া কার্যক্রম থেকে অনেক দূরে রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাধ্যতামূলক বইপড়া কর্মসূচি চালু করতে হবে।
শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক ও যুগোপযোগী প্রচুর কার্যকর ট্রেনিং করাতে হবে। বিশ্বে প্রতিযোগিতা করার মতো যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন জরুরী। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা আনন্দময় করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক, ধর্মীয়, জাতীয় কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এই ত্রিমুখী সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণে শিক্ষকদের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। শতভাগ পাশের কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন বিভাজন যেমন প্রাথমিক বাংলা মাধ্যম, কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সনকে সমন্বয় করা যায় কি না ভাবতে হবে।
সর্বোপরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখাসহ শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত প্রদানের সুযোগ থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি রাজনৈতিক ভাষণ প্রদান করতে পারবেন না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য মুক্তমত শিক্ষা ব্যবস্থার সমূহ অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রসঙ্গে