Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিশন ২০৪১: আমিই সল্যুশন— কেমন হতে পারে আগামীর স্মার্ট কৃষি?

মানিক মাহমুদ
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৫২

২০৪১ সালের স্মার্ট কৃষি কেমন হবে? কৃষকরা কোন তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন? তথ্যগুলো কোথা থেকে আসবে? মাটি, ড্রোন, নাকি স্যাটেলাইট থেকে? ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে আমরা দুই দশক পর আগামী কৃষি কেমন হতে পারে তা নিয়ে যে স্বপ্ন দেখি তা হলো— চিরাচরিত কৃষক চরিত্র গণি মিয়া ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন দিয়ে ড্রোন চালাবেন। ড্রোন উড়বে ফসলের মাঠজুড়ে। ছবি তুলবে ফসলের, মাটির। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সঙ্গে সঙ্গে গণি মিয়া জানবেন মাটির পুষ্টিগুণ। চোখের সামনে দেখতে পাবেন মাঠের কোন অংশে কতটুকু সার দিতে হবে; কোথায় কোথায় কোন কোন বালাইনাশক কী পরিমাণে লাগবে, দেখতে পাবেন সেই তথ্যও।

বিজ্ঞাপন

গণি মিয়ার কৃষি জমির মতোই মাছের ঘের, গবাদি পশু ও পোলট্রি খামারে থাকবে উন্নত প্রযুক্তি ও ডাটা বিশ্লেষণভিত্তিক আইওটি সুবিধা। কৃষকরা প্রতি মুহূর্তে জানতে পারবেন তাদের স্বপ্ন ও ভালোবাসার খামারের খুঁটিনাটি সব বিষয়। প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে জানবেন বাজারের খবরাখবর। প্রথাগত শ্রমঘন কৃষি পরিণত হবে প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট কৃষিতে। কৃষকেরা নিজেরাই করবেন নিজেদের সমস্যার সমাধান।

বিজ্ঞাপন

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি হতে হবে আরও বেশি টেকসই। এ জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য ও বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনী সব জ্ঞানের তথ্যকে একযোগে কাজে লাগানো যেতে পারে। কম্বাইন্ড হারভেস্টিংয়ের প্রযুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে কৃষিতে শ্রমিক সংকটের সমাধান করা যায়। বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে কম আবাদযোগ্য জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। আবার ফ্যাক্টরিতে থ্রিডি প্রিন্টেড প্রযুক্তিতে উদ্ভিজ উপাদান থেকে মাংস ও মাছ উৎপাদন করা যেতে পারে, যা ক্রমেই বাড়তে থাকা আমিষের চাহিদা পূরণ করে বিশ্ব বাজারে রফতানিও করা যাবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভাসমান পদ্ধতিতে চাষের মতো নিত্যনতুন সব উদ্ভাবন এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশের স্মার্ট কৃষিকে।

ময়মনসিংহের এক স্থানীয় সরকারের কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মালেক। এলাকার কৃষকদের ফসল-ফলনে ব্যর্থতা ও কষ্ট দেখে তিনি চিন্তিত ছিলেন। তিনি কৃষকদের সমর্থনে পাশে থাকতে না পারার বিষয়টি বুঝতে পারেন। ২০১৪ সালে তিনি সরকারের ‘এমপ্যাথি ট্রেনিং প্রোগ্রামে’ যোগ দিয়ে শেখেন কীভাবে প্রযুক্তি সহযোগিতা নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা যায়। এভাবেই ‘কৃষকের জানালা’ নামে একটি উদ্ভাবনী অ্যাপের জন্ম হয়। এই অ্যাপের সহযোগিতায় ফসলের ছবি দেখেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে শস্যের রোগ-বালাই শনাক্ত করতে পারেন। অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাপের পরীক্ষামূলক এই কার্যক্রম জনপ্রিয় হতে থাকে। কৃষকদের উপকারে আসতে থাকা এই অ্যাপ পাইলটিংয়ের পর এখন সরকারের কৃষি সহায়তা সংস্থা (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর) দ্বারা গৃহীত হয়েছে।

দেশের প্রধান ফসলগুলোর সমস্যার ছবি সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তা ডাটাবেজে সাজানো হয়েছে। এতে রয়েছে ১২০টিরও বেশি ফসলের এক হাজারেরও বেশি সমস্যার সমাধান। অনলাইন কিংবা অফলাইন উভয়ভাবেই কৃষকের জানালা থেকে সেবা নেওয়া যায়। কৃষকের জানালার মতো উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো অশোকের মতো ‘গভপ্রেনিউর’ (সরকারি কর্মকর্তারা উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন) তৈরি করবে। স্মার্ট বাংলাদেশে এটাই নিয়মে পরিণত হবে। সরকারি কর্মকর্তা উদ্যোক্তা হয়ে নাগরিক সেবার নীতিগুলো পুনর্লিখনের জায়গা তৈরি করবে। আর এতে সরকারের প্রতি আস্থা বাড়বে।

সময়মতো মাছের খাবার দেওয়া, পানির গুণগতমান পরীক্ষা, মাছের পুষ্টি ও বৃদ্ধি তদারকিসহ রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ ঠেকাতে নিয়মিত দেখভাল করছেন মাত্র একজন মানুষই। তিনিই চাষি, তিনিই উদ্যোক্তা। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব হতে পারে প্রযুক্তির কল্যাণে। আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তিই একটি মাছের খামার চালাতে পারেন। এমনটি করে দেখিয়েছেন উদ্ভাবক ড. মো. তানভীর হোসেন চৌধুরী। আবার একজন কৃষক ফসলের পরিচর্যার জন্য ব্যবহার করছেন মোবাইল অ্যাপ। এর মাধ্যমে কৃষক ফসলের ছবি তোলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই এআই এবং মেশিন লার্নিং পদ্ধতিতে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে ওই ফসলের পরিচর্যা করতে হবে।

এরই মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট কৃষির দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পরিশ্রম কমিয়ে কৃষি কাজকে সহজসাধ্য করা এবং স্মার্ট কৃষি ও কৃষক তৈরিতে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। এক ‘কৃষি বাতায়ন’ প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে কৃষকরা এখন তাদের ফসল সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি জানতে পারছেন, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নিতে পারেন পরামর্শ। সরকারের বিভিন্ন কৃষি-সম্পর্কিত সেবাও পেয়ে থাকেন। খোঁজখবর পান সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি হাট-বাজারের।

বাংলাদেশের কৃষি এখন উত্তরণের পথে আছে। বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর কাজ শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু জমি কমে যাচ্ছে, সেখানে দেশের কৃষির সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। প্রথমত, ক্রমবর্ধমান মানুষের খাবার জোগাড় করা, বিশ্ব বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের নতুন নতুন কৃষি শস্যের উৎপাদনের হার বাড়ানো এবং পণ্যের সঙ্গে উৎপাদনের অনুপাতকে দক্ষতার জায়গায় নেওয়া। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের সংকট মোকাবিলা, এরই মধ্যে সেটি আমরা শুরুও করে ফেলেছি। আগে কৃষক নিড়ানি দিতেন, আগাছা ছেঁটে দিতেন। এখন ওষুধ ব্যবহার করে শ্রমিকের সংকট কমানো যাচ্ছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টর এসে গেছে। যান্ত্রিকীকরণ এখন নতুন মুখ। এ ছাড়া হাটে বাজারে নতুন নতুন খাবার এসে যাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে নিত্যনতুন খাবারের চাষ হচ্ছে।

এই তিনটি মিলিয়ে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কৃষি হবে। কারিগর হিসেবে এই তাসটা খেলতে হবে আমাদের। নানা ধরনের উদ্ভাবনী আইডিয়া আসবে। ফসল হাইব্রিড হবে সেটা ঠিক, কিন্তু আমাদের জমির পরিমাণও কিন্তু কমে যাবে। আমাদের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। তাছাড়া জলবায়ুর বিভিন্ন ইস্যু তো আছেই। কৃষি তখন জমিতেও হতে পারে, আবার ভাসমানও হতে পারে। কৃষকের কাছে তথ্য সেবার সুযোগ থাকলে সে উৎপাদন বাড়ানোর কথা চিন্তা করবে। উদ্ভাবনী হবে।

এখন রাজধানী ছেড়ে অনেকেই গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করছেন। বিদেশ থেকেও অনেকে আসছেন। ২০৪১ সালের কৃষকরা শিক্ষিত হবেন। তথ্যগতভাবে সমৃদ্ধ হবেন। নিউ ব্রিড অব ফারমার হবেন তারা। সম্মান পাবেন কৃষকরা। সেজন্য গ্রামে থেকে স্মার্ট কৃষির স্পর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষকদের সময়োপযোগী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ড্রোন বা ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিগুলো দিয়ে ওই শ্রমিকের শূন্য জায়গাটা পূরণ করতে হবে। কিছু জায়গায় চাষ হচ্ছে না। বরেন্দ্র ভূমির মতো অনেক জায়গায় আগে চাষাবাদ হতো না। কিন্তু এখন সেখানেও চাষ হচ্ছে। আগামী দিনের স্মার্ট কৃষি ত্রিমাত্রিক পদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে যাবে।

আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ সেই চিরাচরিত কৃষক চরিত্র গণি মিয়ার আমূল বদলে যাবে। তিনি আর অন্যের জমিতে কাজ করবেন না। নিজেই হবেন একাধারে কৃষক ও উদ্যোক্তা। আকাশের পানে চেয়ে অদৃষ্টের ওপর ভরসা করবেন না। সমস্যার মুখোমুখি হলে পথ হাতড়ে বেড়াবেন না, নিজেই পথ খুঁজে নেবেন নিজের। দেশ-বিদেশের উচ্চ শিক্ষা শেষে হাজারও কৃষক শুধু সেই কৃষক গণি মিয়া হবেন না, হবেন স্মার্ট বাংলাদেশের একেকজন স্মার্ট কৃষক গণি মিয়া, যিনি নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করেন। প্রযুক্তির আশীর্বাদের আওতায় আসবেন প্রতিটি কৃষক, আসবে প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি জেলা। স্মার্ট কৃষি হবে স্মার্ট বাংলাদেশের আরেক নাম।

লেখক: প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট (ইনোভেশন), অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)

সারাবাংলা/টিআর

অ্যাসপায়ার টু ইনোভেশন এটুআই স্মার্ট কৃষি স্মার্ট কৃষিব্যবস্থা

বিজ্ঞাপন

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর