‘রেহানা’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হলিউড রিপোর্টে‍র

‘রেহানা মরিয়ম নূর’— এ মুহূর্তে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের ‘টক অব দ্য টাউন’। দেশের চলচ্চিত্রে এক গর্ব, নতুন এক মাইলফলক। প্রথমবারের মতো আমাদের দেশের কোনো ছবি বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সার্তেঁ রিগা’ বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে। বুধবার (৭ জুলাই) স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় দুপুর ৩টা ১৫ মিনিট) কানের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সাল দুবুসি প্রেক্ষাগৃহে এটি প্রদর্শিত হয়। সেখানে উপস্থিত দর্শকদের ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ও পেয়েছে।

বিশ্বের চলচ্চিত্র বিষয়ক অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা ‘হলিউড রিপোর্টার’ এরই মধ্যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ পরিচালিত ছবিটি নিয়ে রিভিউ ছাপিয়েছে। সেই রিভিউয়ে প্রশংসার ছড়াছড়ি। সাদের পরিচালনা কেবল নয়, ‘রেহানা’ অর্থাৎ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ফুটিয়ে তোলা শিল্পী বাঁধনের অভিনয়েরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন হলিউড রিপোর্টারের রিভিউয়ার দেবরা ইয়ং। বাঁধন সম্পর্কে তিনি বলছেন, অসাধারণ শক্তি নিয়ে অভিনয় করেছেন। ছবিতে নীল রঙের ব্যবহার ও এর ক্যামেরার কাজেরও প্রশংসা করেছেন তিনি।

হলিউড রিপোর্টারের করা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর রিভিউটি সারাবাংলার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আহমেদ জামান শিমুল

রেহানা মরিয়ম নূর। শুধু ছবির নাম নয়, ছবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামও এটিই। এই চরিত্রটির যে অন্তর্নিহিত শক্তি, সেটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ছবির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। এর আগ পর্যন্ত মেডিসিনের একজন সহকারী তরুণ অধ্যাপক, প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া কন্যার মা ও একজন বিধবা নারী হিসেবে রেহানাকে দেখা যাবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মাথানত না করে অনড় থাকতে। ছবির শুরুর দিকেই মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে নকলের দায়ে বহিষ্কার করার মাধ্যমে রেহানা তার নৈতিক অবস্থানের জানান দেন।

তবে এই ঘটনাটি রেহানার পরিচয় তুলে ধরার শুরু মাত্র। তিনি কতটা শক্তিশালী একটি চরিত্র, সেটি বোঝা যাবে তখনই যখন এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে একজন অধ্যাপকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান তিনি। নিজের সহকর্মী এবং পদাধিকারবলে তার চেয়ে উচ্চ পদে আসীন একজন ব্যক্তিকে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর যে চ্যালেঞ্জ রেহানা নেন, সেই লড়াই-ই এই ছবির উপজীব্য। একটুকরো হাড়ের জন্য ক্ষুধার্ত একটি কুকর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রেহানা যেন ঠিক তেমনই তাড়না নিয়ে লড়াই করে যান।

‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’-র পর লেখক-নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি শুধু একজন অস্থির প্রকৃতির নারীর উত্তেজনায় ভরপুর আখ্যানই নয়, একজন নবাগত হিসেবে আজমেরী হক বাঁধনের দৃঢ়তাপূর্ণ অভিনয়ের এক অসামান্য প্রদর্শনীও। একজন নারী যিনি তার নৈতিক বিশ্বাসে দৃঢ়, বিশেষ করে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যেভাবে একাগ্রচিত্তে লড়াই করে গেছেন— সেটিও কুর্নিশ পাওয়ার যোগ্য। রেহানার অপরিসীম মানসিক দৃঢ়তা একইসঙ্গে মানুষের কাছে তাকে নায়ক ও করুণার পাত্রে পরিণত করেছে। রেহানার এই একরোখা স্বভাব একদিকে নারীবাদীদের জন্য যেমন তাকে শতভাগ সমর্থনপ্রাপ্তিকে কঠিন করে তুলেছে, তার চেয়েও এই চরিত্রটি আরও অনেক বেশি অস্বস্তিকর তাদের জন্য যারা যৌন নির্যাতকদের পক্ষে কথা বলেন।

ছবিতে রেহানা বাংলাদেশের যে মেডিকেল কলেজে কাজ করেন, সেখানে যৌন নিপীড়ন নির্লজ্জ ও ভয়াবহভাবে ঝেঁকে বসেছে। সেখানেই রেহানার সহকর্মী অধ্যাপক আরেফিন (কাজী সামী হাসান), যিনি ছাত্রদের অনেক গুরুতর অপরাধকেও সহজভাবে নেন এবং নামমাত্র শাস্তি দেন; যেখানে রেহানা পারলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তি প্রয়োগ করেন। রেহানার মাথার সাদা স্কার্ফ তার আত্মিক বিশুদ্ধতারই যেন প্রতিরূপ। কিন্তু তিনি যখন অধ্যাপক আরেফিনের রুম থেকে ওই কলেজেরই শিক্ষার্থী অ্যানিকে ক্রন্দনরত অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখেন, তার নিজের চোখে মুখেই অশুভ শক্তির ছায়া যেন। রেহানা বুঝতে পারেন ভয়াবহ কিছু ঘটেছে অ্যানির সঙ্গে, যা আরও বিস্তারিত জানতে চান তিনি।

কাহিনি যতই সামনে এগিয়েছে, পুরো বিষয়টির সঙ্গে রেহানার জড়িয়ে যাওয়াটা অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ‘আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং কোনোভাবেই আমি চুপ থাকতে পারি না’— এই ভাবনা থেকে রেহানা ঘটনাটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। ঘটনাটি নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে যেন অ্যানি অভিযোগ করে, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান রেহানা। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও শেষ পর্যন্ত অ্যানিকে অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে রাজি করাতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করবেন। রেহানার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, অধ্যাপক আরেফিন যেন ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং এর মাধ্যমে কলেজের আর কোনো শিক্ষার্থীকে যেন তার শিকার না হতে হয়।

কাউকে জনসম্মুখে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি করাতে রেহানার যে প্রয়াস, সেটি নিয়ে রক্ষণশীলতা থাকলেও ছবির কাহিনির এ পর্যন্ত বেশিরভাগ দর্শকই রেহানার সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু এ তরুণীর মনের গহীন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা যে আবেগ, সেটি ছবির দ্বিতীয়ার্ধকে একজন নারীর অবদমন, উদ্বেগ ও সহিংসতার এক শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রায় পরিণত করে।

‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নিয়ে সারাবাংলায় আরও পড়ুন-

‘এ অর্জন পুরোপুরি আমার টিমের’

কিসের দরজায় কড়া নাড়লেন সাদ?

বিভাগের প্রথম ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’

কানে স্ট্যান্ডিং ওভেশন: বাঁধনের কান্না, সাদের স্যালুট

প্রথমবারের মতো কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের ছবি

রেহানার জীবনের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে তার মেয়ে ইমু (অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছে আফিয়া জাহিন যাইমা), যে প্রায়ই উপেক্ষিত। রেহানা মেয়েকে আদর করে ডাকে ‘মাম্মি’, অন্যদিকে ইমু তার মা’কে ডাকে ‘মাম্মা’ বলে। ইমুর মধ্যেও রয়েছে প্রবল জেদ, যা অনেকাংশে তার ‘মাম্মা’র কাছ থেকেই উৎসরিত। আর তাদের মধ্যেও সবসময় নিজেকে অনড় রেখে পরস্পরকে হারিয়ে দেওয়ার এক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে, যা একদিকে যেমন হৃদয় বিদারক অন্যদিকে তেমনই নিষ্পত্তিহীন। ক্রমেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, রেহানা তার সন্তানের মধ্যেও নিজের সত্তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পান এবং তাদের দু’জনের মধ্যেকার মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।

এ পর্যায়ে এসে এটি বলা যায়, এই চলচ্চিত্রটিতে মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক অবস্থান পরিবর্তন প্রসঙ্গে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নেই যা দর্শকদের একই সময়ে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিষয় বিবেচনা করার চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দেবে। ঠিক যেমন রেহানার ভাই যখন ইমুকে তার কাছে রেখে যাচ্ছিলেন, তিনি জানতেন যে তার বোন ইমুর আশাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। তারপরও তিনি বোনের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘এটা কি তুমি মেয়ের জন্য করছ নাকি তোমার নিজের জন্যই?’

ছবির কাহিনি যখন একের পর এক নাটকীয় মোড় নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়গুলোতে বাঁধনকে তার অভিনয়ের উচ্চগ্রামে চড়ার ক্ষেত্রে সাদ চমৎকারভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। কারিগরি বিষয়গুলোও সাদ ও তার সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তমিজুল বেশ দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। বিশেষ করে প্রতিটি দৃশ্যে যে গাঢ় ও উজ্জ্বল নীল রঙের ব্যবহার, হিমশীতল ও অস্বস্তিকর সেই রঙ যেন জীবনের দৃশ্যগুলোকেই ছিনিয়ে নিয়েছে। রেহানার যে একরৈখিক ভাবনা এবং আবিষ্টতা, সেটি যেন ফুটে উঠেছে দৃশ্যগুলোর পশ্চাৎপটে সবকিছুকে অস্পষ্ট রেখে সম্মুখপটে কেবল তার চেহারাটিই কেন্দ্রীভূত রাখার মাধ্যমে। ছবিতে ক্যামেরার কাজও করা হয়েছে হাতে, যা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং কখনোই সম্পূর্ণ স্থির ছিল না।

এক নজরে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’—

পরিচালক: আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ

অভিনয়ে: আজমেরী হক বাঁধন, আফিয়া জাহিন জাইমা, কাজী সামি হাসান, আফিয়া তাবাসসুম বর্ন, ইয়াছির আল হক, সাবেরী আলম

চিত্রগ্রাহক: তুহিন তমিজুল

প্রোডাকশন ডিজাইন: আলী আফজাল উজ্জল

সাউন্ড ডিজাইন: শৈব তালুকদার

প্রযোজনা সংস্থা: প্রোটোকল, মেট্রো ভিডিও

সহ-প্রযোজনা সংস্থা: সেন্সমেকারস প্রোডাকশন

প্রযোজক: জেরেমী চুয়া (সিঙ্গাপুর)

সহ-প্রযোজক: রাজীব মহাজন, আদনান হাবিব, সাঈদুল হক খন্দকার

পরিবেশক: ফিল্মস বুটিক (জার্মানি)

সারাবাংলা/এজেডএস/টিআর

আঁ সার্তেঁ রিগা আজমেরি হক বাঁধন আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ কান চলচ্চিত্র উৎসব রিভিউ রেহানা মরিয়ম নূর হলিউড রিপোর্টার