ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন ও কথাসাহিত্যিক শওকত আলী
২২ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৩৩
প্রদোষে প্রাকৃতজন আমার প্রিয় প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক শওকত আলী রচিত একটি বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৮৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে। ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় প্রদোষে প্রাকৃতজন প্রকাশিত হয়েছিল এবং ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দুষ্কালের দিবানিশি। ১৯৮৪ সালেই প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল দুখন্ড একত্রিত করে প্রদোষে প্রাকৃতজন নামে প্রকাশ করে। তুর্কিদের আক্রমণ ও সেন রাজাদের সময়ে বঙ্গদেশের প্রাকৃতজনদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
সংক্ষেপে
সেন রাজাদের রাজত্বকালে দেশের সাধারণ জনগণ সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে কখনো অন্ত্যজ হিন্দুরা, কখনো বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। সে সময়কালে কয়েকজন প্রাকৃতজনের জীবন-সংগ্রামের গল্প প্রদোষে প্রাকৃতজন। আত্রেয়ী নদী তীরের মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ জানে না কেন তার গুরু বসুদেব তার প্রতি রাগান্বিত। মায়াবতী চায় তার স্বামীকে তার বাহুডোরে আগলে রাখতে কিন্তু কোন টানে সে ছুটে যায় মিত্রানন্দের কাছে। স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী কি ফিরে পাবে স্বামী অভিমন্যু দাসকে। কিংবা অন্ত্যজ হিন্দুরা বা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কি পারবে সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচার থেকে দেশকে বাঁচাতে।
চরিত্র: শ্যামাঙ্গ – আত্রেয়ী নদী পাড়ের একজন মৃৎশিল্পী। বসুদেব – শ্যামাঙ্গের গুরু। নীলাম্বর – শ্যামাঙ্গের মিত্র। সুধীমিত্র – কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত। মায়াবতী – উজুবট গ্রামের মেয়ে। লীলাবতী – উজুবট গ্রামের এক স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে, মায়াবতীর সখী। শুকদেব – মায়াবতীর পিতা, উজুবট গ্রামের ক্ষেত্রকর। যোগমায়া – মায়াবতীর মাতা। চন্দ্রদাস – মায়াবতীর ভাই। দীনদাস – মায়াবতীর মামা। বসন্তদাস – মায়াবতীর স্বামী, মিত্রানন্দের শিষ্য।
অভিমন্যু দাস – লীলাবতীর স্বামী।
হরকান্ত – লীলাবতীর পিতা
যোগী সিদ্ধপা / দীননাথ – লীলাবতীর মামা। কমলা – দীননাথের স্ত্রী।
হরিসেন – মহাসামন্ত। বজ্রসেন – হরিসেনের প্রধান অনুচর। কুসুম – প্রতিবাদী ডোমনী। সোমজিৎ উপাধ্যায় – উজুবট গ্রামপতি।
মিত্রানন্দ – ভিক্ষুদের সর্দার।
লেখক শওকত আলীর একটি সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছিলেন তরুণ সরকার।
ছয়/সাতবারের চেষ্টায় রেকর্ডপ্লেয়ারে তার সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়। ২০০৪ সালে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে গৃহীত সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলেখনের কাজ শেষ করা হয়। শ্রুতিলেখনের সাথে তার কিছু কিছু লেখ্য অংশ যুক্ত করা হয়। ২০১১ সালে সুস্থ হয়ে উঠলে শওকত আলী পুরো লেখাটি দু-তিন বছর ধরে নিজে দেখে দেন। একপর্যায়ে লেখাটি কাগজপত্রের ভিড়ে হারিয়ে যায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার সন্তান আসিফ শওকত জানান যে লেখাটি পাওয়া গেছে। পরে লেখাটি সংগ্রহ করে সাপ্তাহিক-এ প্রথমবারের মতো ছাপার উদ্যোগ নেয়া হয়। লেখাটি অসম্পূর্ণ। নানা বিষয়ে শওকত আলীর নতুন চিন্তার আলোকদ্যুতি আছে এই লেখায়। পরবর্তীতে তার সাথে কথা বলে এই লেখার বিস্তারিত এবং পূর্ণাঙ্গ অংশ ছাপা হয়।
কথাসাহিত্যিক শওকত আলী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ছাত্রজীবনে পড়াশোনা এবং কর্মজীবনে শিক্ষকতা করেছেন। প্রাচীন বঙ্গ বিশেষত বঙ্গের ইতিহাস, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে তার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। প্রাচীন বাংলার ধর্ম, দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে শওকত আলীর বক্তব্য গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু শওকত আলীর বক্তব্য শুধু প্রাচীন বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন বাংলার পাশাপাশি এসেছে বিভিন্ন সাম্প্রতিক প্রসঙ্গও।
বিশ্বসভ্যতায় বাঙালিদের কোনো অবদান আছে কি? প্রশ্ন করা হয়েছিল কথাসাহিত্যিক শওকত আলীকে। সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ দিয়েই তিনি শুরু করেন। তিনি বলেন, খুব রিসেন্ট একটা বড় অবদান আছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে একটি বড় অবদান সেটি। ওরস্যালাইন আবিষ্কার-মেডিকেল সাইন্সের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটা হয়েছিল ঢাকায়, কলেরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। আমেরিকান ডাক্তাররা এটা করেছিলেন। ব্যাপার হচ্ছে, কলেরা এবং ডায়রিয়া হলে শরীরের পানি বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে গেলে কি হয়, সবাই ইনজেকশন দেয়। বড় বড় স্যালাইনও দিতে হয়।
বরিশাল, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলে কলেরা ডায়রিয়া আগে হতো বেশি। কলেরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাক্তাররা গিয়েছেনও ওসব জায়গায়, বাংলাদেশি ডাক্তারও ছিলেন। তারা গিয়ে কাউকে কাউকে ওষুধ দিতে চান। তারা গিয়ে ওষুধ বিলাতে চাইলে স্থানীয় জনগণ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে, কলেরা হলে একমুঠো গুড় ও এক চিমটি লবণ পানিতে মিশিয়ে সবটা খাইয়ে দেই। ওরা এমন রিপোর্ট দিল, আর স্থানীয় জনগণ অন্যকিছু খেতে চায় না।
বিশ্বসভ্যতায় বাঙালিদের অবদান বিষয়ে শওকত আলী বলতে থাকেন, গ্রামের লোকদের যে আমরা মূর্খ মনে করি, তারা কি আসলেই মূর্খ? ধানের ক্ষেতে প্রথমে বীজ দিয়ে চারা তৈরি করে, তারপর চারাটা জমিতে রোপণ করে। এই যে টেকনোলজি, এটা গাঙেয় উপত্যকা অথবা মেকং উপত্যকার। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চায়না, মেকং নদী যেসব অঞ্চল দিয়ে গেছে। তবে কোনো কোনো গবেষক বলছেন, বেঙ্গল উপত্যকায় ধানের চাষের টেকনোলজি আরও আগে এসেছিল। এটা আমাদের গর্ব করার বিষয়। বিশ্বসভ্যতায় আমরা একটি টেকনোলজি দিয়েছি।
এবার ঘরের কথা বলি। দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা, পুব দুয়ারি তাহার প্রজা। বাড়িটা যেমন করে দক্ষিণ দুয়ারি হয়- কর্তা গিন্নিরা থাকবেন পূর্ব দুয়ারি নয়তো দক্ষিণ দুয়ারি ঘরে। উত্তরে ও পশ্চিমে গোয়াল, রান্না ঘর। মধ্যখানে হবে উঠান। আর চারদিকে গাছ। এখানে বোঝা যাচ্ছে, উঠানের চারদিকে ঘর। এটা এই অঞ্চলের জিনিস। বিহারে গেলে দেখা যাবে, লম্বা একখানা ঘর পার্টিশনের বারান্দা। আরও পূর্বে গেলে কী পাবে? মধ্যখানে উঠান আর চারদিকে ঘর, সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ভালো ঘর দক্ষিণমুখী। কারণ ওদিক থেকেই বাতাস আসে, ফুরফুরে বাতাস। এই তো ব্যাপারটা। তাহলে আবহাওয়ার সঙ্গে জীবনের সম্পর্কটা কীভাবে হবে, সেই বিবেচনা তারা করেছিল। স্কুলে পড়া, কলেজে পড়া মানুষরা নয়।
বাংলায় কতগুলো সুযোগ আছে। তার কালচারে অবলম্বন করার অনেক বস্তু আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূখণ্ডের মতোই বাংলা ভূখণ্ড খুব প্রাচীন। শুধু পলি মাটির দেশ বলা হয়, এটা কথার কথা। কোনো কোনো অঞ্চলে বিস্তীর্ণ পলি মাটি আছে হয়তো। কিন্তু এখানে প্রাচীনতম ভূখণ্ডও ছিল। না হলে কয়লা, তেল এ ধরনের জিনিস পাওয়া যেত না।
ভূখণ্ড প্রাচীন হলে যেগুলো হয়, এখানে বৃষ্টিপাতের এলাকা। ফসল বা গাছপালা খুব প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। মানব বসতি এখানে খুব প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। কমপক্ষে ২০ হাজার বছর আগেও ছিল বলে অনেকের অনুমান।
কুমিল্লার ময়নামতিতে যে খননকার্য হয়েছে, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পড়ানো হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে এক কি দেড় বছর ছিলেন। ওখানে গবেষণা করে তিনি বলেছেন, ওখানে মানব বসতির বয়স কমপক্ষে ২০ হাজার বছর। বইখানি লিখেছেন ড. দীলিপ কুমার চক্রবর্তী। বইটার নাম ‘এনসিয়েন্ট বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব আর্কিওলোজিক্যাল সোর্সেস। ইউপিএল বের করেছে।
এই বিষয়গুলো আড়ালে থেকে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এটা করেছে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন ছিল তাও সন্দেহের বিষয়। অন্য সাবজেক্টের কথা বলতে পারি না, বাংলা পড়তে গিয়ে যা মনে হয়েছে। যাঁরা আমাদের পড়িয়েছেন, তাদের জ্ঞানভাণ্ডারটা খুব সমৃদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। আমার সাবজেক্টের বাইরে জানাটা আমার সাবজেক্টের সঙ্গে রিলেটেড। আমি জানব না, সাহিত্য বিশেষত ভাষার সঙ্গে যুক্ত নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, প্রাচীন ইতিহাস। এগুলোর সম্পর্কে আমার ধারণা থাকতে হবে। এখন তো মনে হয়, আমাদের এ সমস্ত বিষয় যারা পড়িয়েছেন, তাদের কথা শুনে মনে হয় না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকদের চিন্তাভাবনা এক ঘরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। তারা অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন। তাদের সৃষ্ট যে জগৎ, সেই জায়গাটা আরও বৃহত্তর করা প্রয়োজন নয় কী? সেই গণ্ডি থেকে বেরুনোর ব্যাপারটা? তাদের সামনে সুযোগ ছিল কম। কিন্তু এখন তো সুযোগ হয়েছে। সুতরাং কেন পুরনো গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকবেন?
প্রাচীন বঙ্গ ও বঙ্গের পূর্বাঞ্চল
বঙ্গ বিষয়ে শওকত আলীর বক্তব্য গ্রহণে প্রশ্নকর্তার তেমন ভূমিকা নেই। প্রশ্ন না করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলে যেতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তবে দু’এক সময় আলোচনার সূত্র উল্লেখ করা হতো। প্রাচীন বঙ্গ বিষয়ক আলোচনায় শওকত আলী খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন বৃহৎ বঙ্গের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের সম্পর্ক।
শওকত আলী বলেন, এই কৌতূহলটা জানতে দেয়া হয় না, আমি যে বাংলাদেশে বাস করছি- এর মাটি কত প্রাচীন, ভূমিগঠন কত প্রাচীন, যে ভাষায় কথা বলছি, সে ভাষা কত প্রাচীন। সেই ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার সম্পর্ক কেমন? উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের বাংলা ভাষার সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের ভাষার কি মিল আছে! একেবারে কম্বোডিয়ার খেমার ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে আমাদের বাংলা ভাষার মিল আছে। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ফ্রান্সে পিএইচডি করেছেন, তিনি গবেষণা করেছেন। ঐ এলাকাটা তখন ফ্রান্সের অধীনে ছিল। ওখানে কাজ করার সুবিধা ছিল। করেছেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভাষাতাত্ত্বিক কিন্তু বিষয়টি তেমন গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেননি।
ওখানকার ও ইন্দোনেশিয়ার রূপকথার গল্প একটা সংকলনে বেরিয়েছিল ইউএসএ থেকে। তার মধ্যে ১৮টি গল্প ছিল। তার মধ্যে ৮টি গল্প আমাদের দেশের রাজপুত্র রাজকন্যাদের উপকথার গল্প। রাজকন্যাকে ধরে নিয়ে গেছে রাক্ষস, দৈত্য। রাজকন্যা কাঁদে, রাজা খুঁজে বেড়ান। তারপর প্রিন্স অব বেঙ্গল সেখানে সামনে গেছে। পাখির পিঠে চড়ে। দৈত্যকে সে সংহার করেছে। তারপর রাজকন্যাকে উদ্ধার করে। এই কাহিনী। ১৮টি কাহিনীর মধ্যে ৮টি কাহিনীতে প্রিন্স সব বেঙ্গল আছে।
আর যারা কম্বোডিয়া গেছে, ঘুরে এসেছে, তারা বলল যে, শুঁটকি মাছ দিয়ে মোচার ঘন্ট খেয়ে এসেছে। আমাদের মতো ভাত খেয়ে এসেছে। নরম ভাতও হয়, আবার ঝরঝরে ভাতও হয়। কুয়া আছে, জল তোলার জন্য বাঁশ লাগানো থাকে। এটা দেখেছে। কুয়োতলার কাছে কলাগাছের ঝাড়ও দেখেছে। আম গাছ আছে, কাঁঠাল গাছ আছে সেটাও দেখেছে। আর ছাগল ঘুরে ঘুরে আম-কাঁঠাল পাতা খেয়ে বেড়াচ্ছে। সেটা দেখেছে। এই গল্প শুনেছি প্রয়াত সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর কাছে।
বঙ্গের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের সম্পর্ক বিষয়ে সাম্প্রতিক বাস্তবতা নিয়ে শওকত আলী বলেন, ব্যাপারটা এসেছে কলোনিয়াল রুল থেকে। এই বিষয়টি নিয়ে কেউ চিন্তা করেনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে যে, বাবুকালচার যেটা তৈরি হলো, আধুনিকতা এলো, ইউরোপীয় চিন্তাও কিছু এসেছে। তার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী আভিজাত্য। বোস, গুহ, ঘোষ, মিত্র, কুলিন কায়স্থ, তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে আধুনিক হবে। আর মুখুজ্যে, বাড়–জ্যে এরা তো হবেই। খুব বেশি যদি হয়, তাহলে সেন, গুপ্ত, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত এরা। সরকার, বিশ্বাস এরা কেরানিও হতে পারবে না। এই ছিল সামাজিক প্যাটার্ন। আর মুসলমানরা অনগ্রসর ছিল। ওরা লেখাপড়া শেখেনি। আর যারা শিখেছে, তারাও শাসকদের পদসেবায় নিয়োজিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু আভিজাত্যের বিষয়টি যেমন এস্টাবলিশ করা হয়েছে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমনি আলিগড়, বেনারস ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলিম রাজপরিবারগুলোকে নিয়ে মুসলিম অভিজাত তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে রাজনৈতিকভাবে দুটি ভাগ হয়ে গেল। শেষে একটি পাকিস্তানের দাবি তুলল।
তুমি কয়জন লেখক পাবে দাস-সরকার? কবি পাবে? ২০ শতকের ৩০ দশকের হিসাবটা কর। চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, বসু, মিত্র, ঘোষ এরাই তো। দাস, সরকার, মণ্ডল এরা আছে? এই তো ব্যাপারটা।
পূর্ব থেকে ভারতীয় কালচারে যে ইনফ্লুয়েন্সটা করে, তাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যটা আর থাকে না। ভারতীয়টা আর থাকে না। ব্রাহ্মণ্যবাদের কাঁধে সওয়ার হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানি সারা ভারত জয় করেছে। যদি পূর্ব দিক থেকে এসেছে কালচার, এটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ধর্মচিন্তা, যে বাউল, যে ফকির কিংবা ধরো জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম। সেই সঙ্গে আমাদের এখানে যে একটা ধর্ম আছে, নাথ ধর্ম, যাদের বলা হয় যুগী। যাদের দাহ করা হয় না। মৃতকে বসিয়ে দেয়া হয় কোটা মাটিতে। যাদের দেব-দেবী নাই। এসব ধর্ম তৃণমূলেই পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ ধর্ম পুনর্জন্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বর্গে বিশ্বাস করে না। কী হবে? নির্বাণ লাভ হবে। চীনে যে সমস্ত ধর্মমত আছে। তার সঙ্গে খুব মিলে। খাদ্য রুচির কথা যদি বলো, তাহলে পূর্বাঞ্চলের সবই ভাত, সবই রাইস।
এই যে ব্যাপারগুলো আমাদের দেশে আধুনিক সাহিত্যে-কবিতায় আসেনি। না আসার কারণ আছে। এগুলো লোকসাহিত্যে আছে, লোকগীতিতে আছে, সুরের মধ্যে আছে। কেউ কেউ টেরও পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের গীতিনাট্যে প্রায় সবই মণিপুরী নৃত্যের ওপর কম্পোজ করেছেন। তিনি কত্থক, কথাকলি কেন আর বেশি ব্যবহার করেননি? এই প্রশ্নগুলো আলোচনায় আসে না।
এই দুই কালচারের মিলনস্থল হচ্ছে বেঙ্গল। পূর্বাঞ্চলের যে কালচার এবং পশ্চিমাঞ্চলের যে কালচার তার মিলনস্থল হচ্ছে বেঙ্গল। কিন্তু ঐ বিষয়টাকে আমাদের কল্পনার মধ্যে আসতেই দেয়া হয়নি। চিন্তা করেছ ব্যাপারটা? কেন দেয়া হয়নি? শুধু কলোনিয়াল রুলের কারণে কি? নাকি অন্য কারণও ছিল?
এই যে ব্যাপারটা এটা নিয়ে আমরা কিন্তু কখনো চিন্তা করিনি। শস্য-খাদ্য হচ্ছে। এটা যে পশ্চিম থেকে আগত নয়। চিন্তা করার স্কোপই দেয়া হয়নি। সে কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বল আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই বলো। এ কথাগুলো শুনে অনেকে খুব রেগে যাবে, আমার মনে হয়েছে। আমি ভেবে দেখেছি, ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেকে ঘাঁটাঘাঁটি করবে, সবাই চিন্তা করবে। অবশ্যই গবেষণা হবে, করতে হবেই।
আর্য ও বঙ্গের ধর্ম:
বঙ্গের নিজস্ব ধর্মের পাশাপাশি সাক্ষাৎকারে শওকত আলী আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি, আর্য-অনার্য মিশ্রণ, তপোবন সভ্যতা, বর্ণাশ্রম ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও মতামত দেন। শওকত আলী বলেন, আমাদের দেশে আর্যরা আসেনি। ভারতে এসেছে। বাংলায় তারা আসেনি, মিথিলার পর পূর্বদিকে আর্যরা আসেনি। আর্য কালচারের ব্যাপারটা ঋকবেদ থেকে দেখতে পারি। ঋকবেদের সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১০ হাজার। শ্লোককে বলে সূক্ত। তার মধ্যে এক হাজার সূক্তের মধ্যে এ প্রার্থনা আছে, হে ইন্দ্র আমাদের শক্তি দাও। আমরা যেন গোধনগুলোকে নিয়ে আসতে পারি। আর দস্যুদের গো আর রমণীদের যেন ধরে নিয়ে আসতে পারি।
গরুর বাচ্চাদের মধ্যে কাঠি ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। আর সে রস মানে রক্ত পড়ছে মাটিতে। তাতে বলা হচ্ছে, আহা। ধরণী কত সৌভাগ্যবতী। আর্যদের কাছে সবচেয়ে উপাদেয় ও সুস্বাদু যে রক্ত, তা ধরণী পাচ্ছে। এমন কথা নাকি আছে ঋকবেদেও।
আদিতে আর্যরা এমন এক জাতি, সভ্যতা গড়ায় তাদের কোনো অবদান নেই। মারামারি, খুনোখুনি, সভ্যতা ধ্বংস করা ছাড়া সভ্যতায় তাদের অবদান নেই।
ভারতে তখন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু ও হরপ্পায়। টেকনোলজি তখন ডেভেলপ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ঘর ঠাণ্ডা রাখার জন্যে তলা দিয়ে নালি করা হয়েছিল। আর্যরা এসে এই সভ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছে। ওরা আসার সময় নাকি নিয়ে এসেছিল বেদ গ্রন্থ। কৃষিকাজ ওরা জানত না। বাহন হিসেবে অশ্ব নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল লোহা। লোহার অস্ত্রও ব্যবহার করতে জানত। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা লোহার অস্ত্র ব্যবহার করত না। লোহার অস্ত্র এবং ঘোড়া দিয়েই আর্যরা জয় করে ফেলল গোটা উপমহাদেশ।
তপোবনের সভ্যতা আর্য সভ্যতা। ওদের তপোবন হয়ে এসেছিল দেবদেবী। আর্যদের দেবরাজ ইন্দ্র। ‘ব্রহ্মা, বিশ্ব মহেশ্বর তত্ত্ব’ আর্য ও অনার্য সম্মেলনের ফলে।
মাতৃদেবীর ব্যাপার এই, অন্যরা যখন উৎপাদনের দিকে চলে গেছে, তখন আর্যরা খাদ্য আহরণের দিকেই রয়ে গেছে। লুটপাট করো, মারো আর খাও। আর এখানে আসার পর দেখল, কৃষি একটা উৎপাদনের ব্যাপার। উৎপাদন করতে পারে নারী- প্রকৃতি। পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনেই নতুন সৃষ্টি হয়। এর ফলে নারী দেবতার উদ্ভব হয়। পুরুষ-প্রকৃতি ফিলসফি, নব সৃষ্টির ফিলসফি, সৃষ্টির দ্বার উন্মোচনের ফিলসফি। পুরুষের আধিপত্য একমাত্র ব্যাপার নয়। কৃষিকাজের পর প্রকৃতি ও পুরুষের যে মাধ্যমে পরম পুরুষের আইডিয়া এসেছে।
ব্রহ্মা সৃষ্টি করছেন। তার চেহারাটি কি, তার দাড়ি রয়েছে। ধ্যানস্থ থাকেন। বিষ্ণু পালনকর্তা। ত্রিস্মরণের মানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বরের যে তত্ত্ব, তপোবনের কালচারটা সবে শুরু হচ্ছে- তখন এসেছে। তারপরই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রর প্রসঙ্গগুলো এসেছে। ব্রাহ্মণরা কী করবে? তারা বুদ্ধিদাতা হবে, জ্ঞানদাতা হবে, তারা শিক্ষাদীক্ষা করবে এবং তারা থাকবে তপোবনে। তপোবনের কালচারটা তৈরি হচ্ছে তখন, যখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে। প্রথমে ঋকবেদ, তারপর সামবেদ, যজু এবং অথর্ববেদ। অথর্ববেদ হচ্ছে সংসার জীবনে যা পালন করতে হবে, তার নির্দেশ। ওষুধ খাওয়া, কবিরাজি ইত্যাদি অথর্ববেদ। দেশরক্ষা, পালন ইত্যাদি যজুর্বেদ এবং সা-মানে সমবেত হওয়া। সাম মানে সবাই মিলে উচ্চারণ করি।
১৮ খণ্ডে সমাপ্ত অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি-এর এক খণ্ড পড়ছিলাম। তাতে বারবারিয়ানরা যখন গ্রিক রাষ্ট্র ধ্বংস করল, তার বর্ণনা। বারবারিয়ান্স গ্রিক রাষ্ট্র ধ্বংস করল। তারা নদীর পাশ দিয়ে অসংখ্য সমুদ্রগামী নৌকা, আর বাঁ-দিকে ৩ তলা ৪ তলা বাড়ি, অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর্যরাও একদিকে ৩ তলা ৪ তলা বাড়ি আরেক দিকে সমুদ্রগামী জাহাজের দিকে অবাক হয়ে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিল। আর্যরা যখন এখানে এসেছে, তখন তারা একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। কৃষি ধ্বংস করেছে, সিন্ধু নদীর কৃষ ও জল সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। পরে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে তাদের সংমিশ্রণ হতে শুরু করল। ওদের সঙ্গে মেয়েমানুষ ছিল না। যেখানে মেয়েমানুষ ছিল না, সেখানে স্থানীয় মেয়েমানুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা করতেই হচ্ছে। ওদের সংসার হচ্ছে। ওরাই শাসক, ওরাই প্রাধান্য পাচ্ছে। পুত্রসন্তান লাভ হলে বেশি সম্মানিত হচ্ছে।
ওখানে যে মিশ্রণ হলো। ওদের মিশ্রণের ফলে যা হলো, তাদের সন্তানরা মাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, তা পারছে না। বাপের ঔরসে জন্ম হয়েছে এটা অস্বীকার করতে পারছে না। তাদের অবস্থাটা কী হয়? তাদের কি নতুন ভগবানকে সৃষ্টি করতে হবে? আমার অনুমান তখন থেকেই তপোবনের কালচার সৃষ্টি হয়। এটা আমার ধারণা, আমার বিশ্লেষণ। এটা কোনো পণ্ডিতের ব্যাপার নয়।
এই তপোবনে বসেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রর যে ভাগাভাগিটা- সেই চতুর্বর্ণ তৈরি করা হলো। বর্ণভেদের যে ব্যাপারটা তা ঐ তপোবনে বসেই ঘটেছে। তপোবনের কালচার মিলনের কালচার। তবে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করার জন্যেই ব্রাহ্মণ যারা, ক্ষত্রিয় যারা- তারা এটা করল। মহাভারত অনেক পরের ব্যাপার। তখন অনেক রাজ্য হয়ে গেছে। বিদর্ভ, বঙ্গ, সৌরাষ্ট্র- অনেক কাজ হয়ে গেছে। এমনকি কি তার রেশ, গৌতম বুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত।
সব গুরুই তপোবনে থাকতেন না। গুরুগৃহেও থাকতেন কেউ কেউ। গুরুগৃহের কালচারটা আর্যদের কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, গুরুগৃহে শুধু বর্ণ শিক্ষাই হচ্ছিল না। অন্যান্য টেকনোলজি সেখানে শেখানো হতো। চাষাবাদ করলে তার জ্ঞান লাগবে। ঘরবাড়ি বানাতে হলেও তা লাগবে ইত্যাদি। উপনিষদগুলো কী? উপনিষদগুলো হচ্ছে বেদের ব্যাখ্যা। উপনিষদগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে আরণ্যক। অরণ্যবাসীর কী জীবনযাপন, সেখানে কী আলোচনা, সেখানে কী বিষয়? এগুলো আরণ্যকে উল্লিখিত আছে। অচ্ছুৎ নিয়ে একটি উপনিষদ আছে। নিচু শ্রেণীর যারা তাদের কী কর্তব্য, তারা কীভাবে ধর্ম পালন করবে, কীভাবে ব্রাহ্মণদের সম্মান দেখাবে, কীভাবে রাজপুরুষদের সম্মান দেখাবে ইত্যাদি।
শওকত আলীর মতে, ধর্ম ও ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা না হওয়ায় মৌলবাদের প্রসার ঘটছে। শওকত আলী বলেন, শাস্ত্রগুলো পড়া এবং বোঝা দরকার। মুক্ত দৃষ্টিতে বুঝতে হবে। না হলে হবে না। এখন ইসলামি গোঁড়াপন্থিদের একটা ব্যাপারে আন্দোলন চলছে এখানে। তাদের লেখাপড়ার মধ্যে তো এ বিষয়টা নেই। কোথা থেকে এলো, কেন এটা হলো, এগুলো নেই। এর ব্যাখ্যা নেই, এর বিশ্লেষণ নেই, সামাজিক বিশ্লেষণ তো করাই হয় না।
আমাদের এখানে হিন্দু ও মুসলিম দুদিকেই মৌলবাদিতা টিকিয়ে রাখা হয়েছে, বই যেন বেশি না পড়ে। বেশি পড়াশোনা করতে দিলে তাদের প্রভুত্ব এবং গুরুবাদ থাকবে না।
তেমনি অবস্থান হয়েছে এখানকার ধর্ম সম্পর্কিত লেখাপড়া। সংস্কৃত তুলে দিল। ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল ক্লাস সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত। তার পরিবর্তে চালু করা হয়েছে ধর্ম শিক্ষা।
পোগোজ স্কুলের এক মাস্টার, হিন্দু ভদ্রলোক, আমাদের কলেজে (তখন তিনি জগন্নাথ কলেজেও পার্টটাইম শিক্ষকতা করতেন) আবার এসব বিষয় নিয়ে কয়েকজন মিলে আলাপ করতাম। আমাকে বলা হলো, আপনি তো হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অনেক জানেন, আপনি কি একটা কথা বলবেন? শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব কেন হয়েছিল? বৃন্দাবনলীলার জন্য, না মথুরালীলার জন্য? মথুরালীলায় তিনি তো রাজা। যুদ্ধ করেন। ভগবত গীতা তখনকার সময়। বৃন্দাবনরীলা হচ্ছে প্রেম। ভক্তিবাদ, প্রেম-ভালোবাসা। কোনটার জন্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল?
আমি তাকে বললাম, ভাই, এ রকম পৌরাণিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ঠিক না। এসব আলোচনা করতে এমন সব বিষয় বেরিয়ে যাবে, যাতে কারও কারও খারাপ লাগতে পারে। যজ্ঞ হতে হবে দেবতাকে উদ্দেশ্য করে। মেধ কেন হবে? মেধ কী? মহিলাদের বলা হয় মেধ। অশ্বমেধ যজ্ঞ কখন করে? তার প্রক্রিয়া কী? এটা পেয়েছি ‘ডিকশনারি অব হিন্দুইজম’ থেকে।
তার মধ্যে ছিল, অশ্বকে ঘুরানো হয়। ঘুরে আসার পর খুব বড় করে পুকুরের মতো একটা খাল খনন করা হয়। তার মধ্যে চারকোণে চারজন মহাঋষির ছাউনি থাকে। অশ্বকে বধ করা হয় মধ্যস্থানে, আর চারকোণার চার ঋষির সঙ্গে রাজমহিষী সঙ্গমকার্য করাবেন। আর মৃত অশ্বের সঙ্গে সঙ্গম করবেন প্রধান মহিষী। এটা সেক্স না, এটা রিচুয়াল। উনি গিয়ে উনার গুরু রামকৃষ্ণ মিশনে নালিশ করেছেন। তখন গুরু তাকে বলেন, ওসব কথা শুনবেন না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা প্রচার করা হয়।
যত প্রাচীন ধর্ম আছে, তার মধ্যে আদিম মানসিকতা-আদিম অনুভূতি আছে। এটা আছে। এটা থাকবেই। এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা ভালো বা মন্দ বলা যাবে না। এটা হিউম্যান সিভিলাইজেশনের একটা পথ। এটা এক সময় ছিল। কারণ দ্রাবিড়ভাষী দেবতাদের যে সামান্য পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কৃষির দেবীর সামান্য পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। ঘোড়ার মাথাওয়ালার মতো আরেকজন দেবতা ছিল। তাদের দেবতাদের মূল বিষয়টি ছিল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাবা শরীফের যে গুরুত্ব। সেটা হযরত মুহম্মদের সময় থেকে নয়। অনেক আগে থেকেই ছিল। এখানে যে দেবতার মূর্তিগুলো ছিল। সে মূর্তিগুলোর নাম লাৎ, মানাৎ এগুলো ছিল। গ্রিক গড এবং গডেসের মধ্যে, রোমান গড ও গডেসের মধ্যে এই নামগুলো পাওয়া গেছে। লুতে, মানে-এ নামগুলো পাওয়া গেছে। বেবিলেনিয় সিভিলাইজেশনে এই দেবতা ছিল। ব্যাবিলেনিয় সিভিলাইজেশন যারা তৈরি করেছিল, তারা নগর নির্মাণ করতে জানত।
এইখানে স্থানীয়দের কথা বলছি, এখানে একটি ধর্ম ছিল। যারা পরমাত্মায় বিশ্বাস করে। যারা দেবতায় বিশ্বাসী নয়। নাথপন্থিদের আদি গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, এঁরা দেবতায় বিশ্বাসী না। এদের সমাহিত করা হয় বসানো অবস্থায় মাথাটা উঁচু করে।
আমি বলছি, এখানে একটি স্থানীয় ধর্মমত ছিল। যারা দেবতাকে পূজা করত না। যারা কল্পিত একেশ্বরবাদী। একেশ্বরবাদী ধর্মটা চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, বার্মা অঞ্চলে ছিল। বেঙ্গলেও ছিল। ঐ রকম একটা চেহারা পাচ্ছি জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে। বৌদ্ধধর্মে কোনো দেবতা নেই। তার পরকাল নেই। তারা কি করে? পুনর্জন্ম হয় বার বার। তারপর নির্বাণ লাভ করে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে মিলে যায়। স্বর্গ মর্ত্যরে কোনো ধারণা নেই। আদিকালে আর্য ধর্ম তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে পুনর্জন্ম ছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
মনসা ও নারী দেবতা প্রসঙ্গে:
প্রাচীন বঙ্গ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচলিত মতের সঙ্গে ভিন্নতা রয়েছে শওকত আলীর। এর মধ্যে অন্যতম মনসা ও লখিন্দর কাহিনী। আধুনিক ও প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের কাছে লখিন্দর হচ্ছে উপাখ্যানের নায়ক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এ উপাখ্যান নিয়ে লেখা কবিতা, গান আর নাটকে লখিন্দর হচ্ছে বিদ্রোহী এবং বীর। কিন্তু শওকত আলীর দৃষ্টিতে, মনসা এক অসাধারণ কাহিনী, নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে যে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। মনসা গরিব মানুষের দেবী বলে বণিক লখিন্দর তাকে স্বীকার করতে চান না।
শওকত আলী বলেন, বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যানটি খুব করুণভাবে, খুব মানবিক রস দিয়ে গাওয়া হয়। চাঁদ সওদাগরকে হিরো বানানো হয়। এটা মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকেই এটা শুরু হয়েছে।
চাঁদ সওদাগর যে বিদ্রোহী, আধুনিক মার্কসিস্টরা চাঁদ সওদাগরকে দেবতা বিদ্রোহী বলে এস্টাবলিশ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, চাঁদ সওদাগর তো একজন দেবীর বিদ্রোহী। অন্য দেব-দেবীর প্রতি বিদ্রোহ করেছে? চাঁদ সওদাগর তো ঠিকই শিবপূজা করত।
মনসা কে, তার জন্ম কোথায়- এ নিয়ে আমাদের পণ্ডিতরা গবেষণা করলেন না। কানাহরি দত্তের মনসামঙ্গল কাব্যে একটি কাহিনী আছে। সেটা অবশ্য বিজয় গুপ্তের কাহিনীর মধ্যেও আছে। সেটা হচ্ছে, শিব ঠাকুর প্রমোদ কারণে বিহারে বেরিয়েছেন। তখন বসন্তকাল। তার কামভাব জাগ্রত হয়েছে। তখন তার ঋতু স্খলন হয়। ধরিত্রী তখন বলল, এত শক্তিশালী জিনিস আমি ধারণ করতে পারব না। তখন তা পদ্মবনে ফেলা হয়। সেখানে পড়ার পরই পূর্ণ যৌবনা একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। শিবের ঔরসে জন্ম। কিন্তু জন্ম মাতৃগর্ভে না। জন্ম হয়েছে পদ্মবনে। সেই জন্যে মনসার আরেক নাম হচ্ছে পদ্ম বা পদ্মাবতী। শিব ফিরে আসার সময় দেখে, অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। শিবের তো বদদোষ ছিল। তার কাছে প্রণয় নিবেদন করলে, মনসা খুব রেগে যায় এবং বাপকে খুব বকাবকি করে। তখন বাপ মাফ চেয়ে চলে যেতে শুরু করেন। তখন মনসা দৌড়ে গিয়ে বলে, আমাকে কোথায় রেখে যাচ্ছ? আমাকে যে জন্ম দিলে, আমি তোমার মেয়ে না?
সংক্ষেপে বলছি। ঘরের মধ্যে নিয়ে ফুলের টুকরি দিয়ে চাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে। দুর্গা ভিতরে এসেছেন। মহামায়া দুর্গা বসেছেন। ঐ সময় শোনেন, আমি তোমার মেয়ে। মেয়ে? কোত্থেকে তুই মেয়ে? বের হ এখান থেকে?
না। আমি এখান থেকে যাব না। এটা আমার বাপের বাড়ি।
তখন দুর্গা মারতে শুরু করলেন। মারতে মারতে তার একচোখ কানা করে দিলেন। তখন মনসা আত্মরক্ষার জন্য একটা পাল্টা আঘাত করল। তাতেই দুর্গার অবস্থা কাহিল। যায় যায় অবস্থা। ত্রিভুবনে হাহাকার পড়ে গেল। দেবলোকে হাহাকার পড়ে গেল। সবাই এসে বকাবকি করে। বলে, মাতৃঘাতিনী। গালাগালি চলতেই থাকল। তখন নারদ এসে বিষ সংহরণ করলেন। তার যে আঘাত বিষাক্ত। তার জন্ম কোথায়? জন্ম হচ্ছে মৃত্তিকাগর্ভে।
এরকম একটা বিবাদের ঘটনা ঘটল শিবের সঙ্গেও। মেয়ের সঙ্গে বাপের বিবাদ লাগল। শিবও তাকে খুব মারধর করলেন। মার ঠেকাতে গিয়ে শিবের গায়ে আঘাত লাগল। শিবের অবস্থা কাহিল। তখন আবার দেবলোকে হাহাকার পড়ে গেল। সবাই এসে তাকে গালাগালি করতে লাগল। তখন শিব নিজে সেই বিষ সংহরণ করলেন। তারপর দেবলোকে ভাবা হলো, এ মেয়েকে ঘরে রাখা যায় না। তখন এক মুনি, জরৎকারু মুনি, শিবপূজার ধ্যানে বসেছেন, কিন্তু ধ্যান পৌঁছায় না। সিদ্ধি লাভ হয় না। কেন হয় না? যেহেতু তার পূর্বপুরুষরা শ্রাদ্ধ পায়নি, সে জন্য তারা ত্রিশঙ্কাতে আছে। স্বর্গেও যায় না, নরকেও যায় না। কারণ তিনি শ্রাদ্ধ করতে পারেন না। শ্রাদ্ধ সেই করতে পারে, যে বিয়ে করেছে, সন্তানের পিতা হয়েছে।
তখন ভাবলেন, আমাকে তো বিয়ে করতে হবে। বয়সের তো গাছপাথর নেই। গায়ে তো গাছ গজিয়ে গেছে। মেয়ে কোথায় পাওয়া যায়? তখন শুনলেন, শিবের এক মেয়ে আছে। সেখানে বলা হলে শিব রাজি হয়ে গেলেন দুর্গা রাজি হয়ে গেলেন। তখন বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর রাত্রিবেলায় নিয়ে এসেছেন ঘরে। রাত্রিবেলায় জরৎকারু মুনি বললেন, খবরদার, তুমি শিবের মেয়ে হও, আর যাই হও, সকালবেলা আমার পূজার আয়োজন করে দিতে হবে।
তুমি জানো না, শিবের আমি মেয়ে?
এ নিয়ে বিবাদের একপর্যায়ে মারতে শুরু করল। পাল্টা মার খেয়ে জরৎকারু মুনির অবস্থাও খারাপ। তখন সে হয়ে যাচ্ছে পিতৃঘাতিনী, মাতৃঘাতিনী, স্বামীঘাতিনী। একে তো রাখা যায় না। নির্বাসনে পাঠাতে হয়। বনে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গী মেয়ে দেয়া হলো। তারা নিচু শ্রেণীর। ধোপানিকে দেয়া হলো। ময়লা পরিষ্কারককে দেয়া হলো। শিবের মেয়ে কিন্তু দেবতার সঙ্গিনী কে? একজন ধোপানি। বিজন বনে কেঁদে বেড়ায় মনসা। মা নাই, বাবা নাই, কেউ নাই। তখন মাটির তলার অষ্টনাগ উঠে আসে। বলে- মা, তুমি কাঁদছ কেন?
বলে, আমার কেউ নাই।
নাগ বলে, আমিই তো তোমার সন্তান। তখন সাপের লেজ পায়ের খাড়– হয়, হাতের বালা হয়, গলার মালা হয়, মুকুট হয়। এই অষ্টনাগ নিয়ে ‘সব দেবদেবীর যদি পূজা পাবার অধিকার থাকে, তবে আমিও দেবকন্যা, আমারও পূজা পাবার অধিকার আছে।’ সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সে গেল। প্রথম গেল চণ্ডালদের কাছে। চণ্ডালরা তাকে মাথা পেতে গ্রহণ করল। গেল কৃষকদের কাছে। চাষারা তাকে তুলে নিল। গেল তাতি, জেলেদের কাছে। তারা তাদের অধিকার দিল। কিন্তু চাঁদ সওদাগর তাতে রাজি হয়নি। তাকে চ্যাংমুড়ি কানি বলে গালাগালি দিচ্ছিল। এখানেই দ্বন্দ্ব। মনসা চায় তার দেবতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আর সমাজের ধনী লোক, উঁচু শ্রেণীর লোক যেহেতু সে সাধারণ মানুষের দেবী, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রত আছে, সেই জন্য তার পূজা করতে চাইবে না উঁচু শ্রেণীর মানুষ। এই দ্বন্দ্ব আছে মনসামঙ্গল কাব্যে। এটা খুব স্পষ্ট যে, গরিব শ্রেণীর সঙ্গে ধনী শ্রেণীর লড়াই। এই তো ব্যাপারটা।
মনসা ও চাঁদ সওদাগরের লড়াইটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে মনসা এবং চাঁদ সওদাগর বিপক্ষে। মনসাপূজায় নাকি ব্রাহ্মণদের দরকার হতো না। একসময় প্রত্যেক গ্রামেগঞ্জে মনসার পূজা হতো, এখন হয় না।
নাগরিক সমাজে মনসাপূজা দেখা যায় না। নাগরিক হিন্দুই মনসাপূজা করান না। করেন নাই। এই যে কলোনিয়াল শিক্ষা ও ব্রাহ্মণ্যবাদ একসঙ্গে জড়ানো। এটা সাধারণ মানুষের ওপর আধিপত্যটা যেন ঠিক থাকে, যেন নড়চড় না হয়। সেজন্য ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখা।
আর মনসা পূজার কথা এলেও চাঁদ সওদাগরের গান করা হয় আর বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গান করা হয়। বেহুলার দুঃখের অন্ত নাই। সে বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হয়। কিন্তু মনসাকে যে পরিত্যাগ করল, তাকে যে মারল, ছুঁড়ে মেরে বাইরে ফেলে দিল, বিজন বনে একা একা। মা নাই, বাবা নাই। একা একাই যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনসার নানা বেদনার কাহিনীর কোনো কবিতা নাই।
সাক্ষাৎকারে তিনি মনসা ছাড়াও কালী, দুর্গা ও বাংলার শক্তি সাধনা বিষয়ে কথা বলেন। অধ্যাপক শওকত আলীর মতে, এই যে শক্তি সাধনার একটা ব্যাপার, এর মধ্যে একটা গোলমাল আছে। গোলমাল আছে এই অর্থে কালী ও কালীর আবির্ভাব। কালীর কৃষ্ণবর্ণ এবং কালীপূজয় নরবলি দেয়া হয়, পশুবলি দেয়া হয়। যে নরবলি, পশুবলি দেয়া হয়, তা ব্রাহ্মণদের কালচারে পারমিশন দেয়। তপোবনের কালচারে কি এটা আছে? এবং যে অসুরটিকে আঁকা হয়, কালী যাকে বধ করার জন্যে বের হয়েছেন, তার মূর্তি তো থাকে না। শিব তাকে বাধা দিচ্ছে। শিবের যে চেহারা, তাতে আর্য বলে ভাববার কোনো কারণ নেই। আর কালীর চেহারায়, না দেহবর্ণে, না তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে, কোথাও আর্যত্বের কোনো নিশানা চোখে পড়ে না।
এখন তো দুর্গাপূজা হচ্ছে। আগে তো দুর্গাপূজা ছিল না। জগদ্ধাত্রী পূজা হতো। তারও ১০ হাত। তবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক নিয়ে একসঙ্গে ৫ জনের পূজা হয়নি। শুধু জগদ্ধাত্রীর পূজা হতো।
তো অসুর বধ করছে। একে তো নারী দেবতা। আর্যরা যখন এসেছিল। তখন তাদের সঙ্গে মেয়ে ছিল না। নারী দেবতার বিষয়টা হচ্ছে আর্যপূর্ব সভ্যতার প্রভাব। আর্যরা আসার আগে একটি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। সেই সভ্যতার প্রভাবেই আর্য দেবতার মধ্যে নারী দেবতার প্রবেশ ঘটেছিল এবং প্রকৃতি ও পুরুষের তত্ত্ব, যে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন না হলে সৃষ্টিধারা অব্যাহত থাকত না। কেননা প্রকৃতি জন্মদান করতে পারে। বীজ ফেলে পুরুষ, প্রকৃতির গর্ভে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। এই যে তত্ত্ব, তা হচ্ছে এই নারী-পুরুষের মধ্যে মিলন, এই তত্ত্ব এসেছে আর্যপূর্ব যে সভ্যতা, সেখান থেকে।
দুর্গা যাকে সংহার করছেন, তার চেহারাটি কেমন? ওটা কি আর্য আগমনের পূর্বে স্থানীয় লোকের চেহারা? অত লম্বা চওড়া চেহারা কি তাদের ছিল? এই অসুর- অত লম্বা চওড়া চেহারাটি কি? আর্যদের বা আসিরিয়ানস, যাদের কাছ থেকে অসুর শব্দটি এসেছে। যাঁদের এ বিষয়টি অনুসন্ধান করার কথা, যেসব ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন না।
নারী দেবতার উদ্ভব কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সভ্যতায় মানুষ তখন খাদ্য উৎপাদনের দিকে যেতে শুরু করেছিল। খাদ্য আহরণের সময় নারী দেবতা পাওয়া যায় না। তার মানে, ধরণী এবং কৃষি কাজের পথ কারা দেখায়? উপনিষদে বলা আছে, মেয়েরাই কৃষি কাজের পথ দেখায়। যেখানে কর্তাদের করার কথা, সেখানে কোদালে মাটি কেটে, বীজ ফেলে, শস্য এনে ঘরে রাখা কিংবা পশু পালন, পাখি পালন ইত্যাদি মেয়েরাই করত। সভ্যতার একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল সেটা। শিকার করা বা ফলমূল আহরণ করা নয়, খাদ্য উৎপাদন কর। পশু পালন করা, শস্য উৎপাদন করা এই পর্যায়টাকে আস্তে আস্তে সূচনা করল মেয়েরা। গার্হস্থলি শুরু হলো এবং তার ফলেই নরনারীর সম্পর্কটা দাঁড়াল। আমার নারী বা আমার পুরুষ এই ব্যাপারটা দাঁড়াল। তারপরে সন্তান এবং সন্তানের দায়িত্ব। বলা যায়, খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবারের সূচনা একই সঙ্গে। যে কোনো সিভিলাইজেশনের এই পর্যায়টিতে নারী দেবতা ছিল। বাংলার নিজস্ব দেবদেবী ছিল। ঋতুর সঙ্গে, ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত দেবদেবী ছিল। যেমন বাসন্তী পূজা করে বসন্তকালে।
আধুনিক সাহিত্য, শিক্ষা ও রাজনীতি:
অধ্যাপক শওকত আলীর বক্তব্য গ্রহণের পর দেখা গেছে, আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে বক্তব্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ, বিকাশ, প্রবণতা, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে পার্থক্য, পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, দলাদলি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেন। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে আধুনিক শিক্ষার সূচনা ও বিকাশের কথাও। শওকত আলী বলেন, ওখানে যখন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা উঠেছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেড কোয়ার্টার থেকে বলা হয়, আমরা সেখানে রাজ্য শাসন করতে গিয়েছি, নিজের জন্য খরচ করে স্কুল-কলেজ করব। আমরা এখান থেকে টাকা পয়সা দিতে পারব না। ম্যাকলে একটি চিঠি লিখেছেন যে, তাতে তিনি বলছিলেন, ভারত যে কত বড় দেশ, আর কত মানুষ ওখানে বাস করে আপনারা কল্পনাই করতে পারবেন না। এই দেশ শাসন করার জন্য ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সমস্ত লোককে যদি নিয়ে আসা হয়, তাহলেও এই দেশ শাসন করা সম্ভব হবে না। তখন তিনি প্রস্তাব দেন, আমাদের প্রথমে একটি শ্রেণী তৈরি করতে হবে, যারা আমাদের মতো কথা বলবে, আমাদের মতো কাপড়-চোপড় পরবে, আমাদের মতো জীবনযাপন করবে, আমাদের মতো খাবার-দাবার ভোগ করবে, আমাদের মতো স্বপ্নও দেখবে। কিন্তু কখনোই আমাদের সমানভাবে না এবং আমাদের পাশে স্থান পাবে না। বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি ম্যাজিস্ট্রেট তিনি হতে পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে একটি কথা আছে। বলা আছে, বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম ঔপন্যাসিক। বঙ্কিমচন্দ্র তখন মাত্র দু’খানা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ হচ্ছে প্রথম উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে লিখেছেন।
রোমান্স, গ্রিক ভাষায় বলা হয় রোমান্স। রোমান্সের প্রথম কথাই হচ্ছে, বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া। তারপর কল্পনার বিস্তার হয়, কাহিনী হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রথমেই দু’শ আড়াইশ বছর আগে পাঠককে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, অন্ধকার রাত্রি। এক মন্দিরে নায়ক-নায়িকা। প্রকাশ্য দিবালোকে না। তারপর কল্পনা করতে হয়। কল্পনাটি কি? পরিচিত যে জগৎ, যে সমাজ, সেটা ছেড়ে চলে গেল সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি দ্বীপে। বাস্তবতার ও বিচ্ছিন্নতার যে ব্যাপারটা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, এটা হচ্ছে উপন্যাসের প্রধান উপাদান। তিনি কী করছেন? ইউরোপীয় সাহিত্য পড়ছেন। ইউরোপীয় স্যুট পরছেন, এলিয়ট পড়ছেন। কিন্তু ওই সময় বাস্তবতা বিষয়ক যে উপন্যাসগুলো হচ্ছিল, যেমন চার্লস ডিকেন্স শিশু শ্রম নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন, সেসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে শওকত আলী বলেন, এর পজিটিভ দিক আছে। কিছুটা হলেও ছিল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এতে বাস্তবতা ছিল। খুব সুন্দর বাস্তবতা।
ঔপন্যাসিক শাসকগোষ্ঠীর যে সহযোগী শ্রেণীটি ছিল, যে শ্রেণীকে তৈরি করা হয়েছিল দেশ শাসনের জন্যে। ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত করে তুলেছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয়েছিল। তাদের জন্যে ইংরেজি স্কুল-কলেজ খোলা হয়েছিল।
এরা খুব ভালো প্রশাসক হয়েছিল। ইংরেজদের বিরাট সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। এত বড়সাম্রাজ্য ভারতে এর আগে ছিল না। মুঘল আমলে ছিল না। অশোকের আমলে ছিল না, তার আগেও ছিল না। এত বড় সাম্রাজ্য। এটা সম্ভব হয়েছিল, পেশাভিত্তিক যে লোক, তাদের শিক্ষিত করে প্রশাসনিক কাজে লাগানো হয়েছিল। তখন কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। কলকাতাতে শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। এদের মাধ্যমে সারা ভারত শাসন করা সম্ভব হয়েছে।
এর মধ্যে থেকেই এরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলো। ইউরোপীয়রা কেউ কেউ এসেছিল। এ দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল। তারপর সাহিত্য এসেছিল। কিন্তু সামাজিক যে মূল্যবোধ তৈরি হয়েছিল তখন, বিদেশি যা, সবই ভালো এবং এ দেশের যা কিছু, সবই হচ্ছে খারাপ। অর্থাৎ দেশজ জিনিসটা ওরা গ্রহণ করতে চায়নি। এর মধ্যে কোনো আভিজাত্য নেই। এর মধ্যে কিছু নেই। এই রকম একটি মনোভাব গড়ে উঠেছিল। তার ফলে সাধারণ মানুষের কথা-কাহিনী বল, উপাখ্যান বল, সাধারণ মানুষের কথা খুব কম পাওয়া যায়। যদিও প্রথম উপন্যাস লেখার চেষ্টা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ তার মধ্যে সেই চেষ্টা আছে। প্রথম দৃশ্যে মিয়াজান গাড়োয়ান, গরুর গাড়ি চালিয়ে কলকাতা যাচ্ছে, বাবুরাম বাবুকে নিয়ে- তার যে দৃশ্যের বর্ণনা, তারপর কোর্টের এলাকার চারপাশে দালাল, উকিল মোক্তার তার সঙ্গে সাধারণ মানুষ। এইসব দৃশ্যে সাধারণ মানুষের দৃশ্য এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের গদ্য সাহিত্যের যখন এই অবস্থা তখন ইংরেজি সাহিত্যের উপন্যাস- তার প্রধান বিষয়টা হচ্ছে জীবনের বাস্তবতা। আর সেই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের বাস্তবতা এ দুটো নিয়ে উপন্যাস রচিত হচ্ছে। কিন্তু সেকালের বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখক, যাকে উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ লেখক বলা হয়, তিনি তো উপন্যাস লিখেননি। তিনি তো রোমান্স লিখেছেন। তাকে আমরা ঔপন্যাসিক মর্যাদায় বসিয়ে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এ ব্যাপারে বলেছেন, রোমান্স লিখেছেন, কল্পকাহিনী লিখেছেন।
ঐ সময় সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। তাতিরা বিদ্রোহ করছে। কৃষকরা বিদ্রোহ করছে। আদিবাসীরা বিদ্রোহ করছে। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ করছে। সাধারণ মানুষ তখন বিদ্রোহ করছে। সাধারণ মানুষের এই ব্যাপারটা ব্রিটিশের বশংবদ যারা তারা কনডেম করবে। এটা তারা কনডেম করেছে। যেমন চাষা শব্দটি গালি হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রভুদের দেশের যে ফার্মার? সে ফার্মার হচ্ছে সম্মানিত একটি শব্দ।
’৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপার ছিল। মার্কসের একটা তত্ত্ব আছে। এটি থিসিসের উপাদান। থিসিসের মধ্যেই থাকে। দুটি প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। সংঘর্ষ বাধে। সেরকম ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই দুটি উপাদান ছিল। মুসলমানরা মনে করল, তাদের প্রাপ্য দেয়া হচ্ছে না। এই ধরনের ব্যাপারটা আমাদের বুঝানো হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যারা করেছে তারা সম্প্রদায়ের নিচের দিকের, আর যারা বলেছিল, তারা ছিল ওপর দিকের লোক। ঢাকার নবাবরাও ব্রিটিশ গভর্নরের কাছে নিয়মিত যেত, সেখানে হিন্দু-মুসলমান দু’পক্ষই খাওয়া-দাওয়া আমোদ-ফুর্তি করত। এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে। কিছুদিন পর হলেও একইভাবে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। কলকাতাতে একটি অভিজাত শ্রেণী তৈরি করা হয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। ঠিক সেরকম সেখানকার মুসলমানরা যখন সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হয়ে গেল, অভিজাত মুসলমানরা ব্রিটিশের পদলেহন আগে থেকেই করছিল, সিপাহী বিদ্রোহের যে ব্যাপারটা, সেটা নবাব-বাদশারা কেউ করেনি। করেছে সাধারণ সিপাহীরা একই কারণে, একই উদ্দেশ্যে। ওখানে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছিল। মুসলমানরা সাম্রাজ্যের কিছু বেনিফিট পাচ্ছে, হিন্দুরাও পাচ্ছে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভক্তিটা পাকা হয়ে গেল।
’৪৭-এ পার্টিশন যে হলো- সেই পার্টিশনের কথা বলি। শুধু একটা কথাই বলেছিলাম- পাকিস্তান চায় কি চায় না মুসলমানরা, তা জানার জন্য রেফারেন্ডাম হয়েছিল। বাঙালি মুসলমানের ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তান দাবি এস্টাবলিস্ট হয়েছিল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের জন্যে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খুবই কমসংখ্যক হিন্দু। সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে মাত্র ১০ ভাগ ভোট পড়েছিল। বিহারে পড়েছিল ৩০ ভাগ। হিন্দুরা নয়, শুধু মুসলমানরাই তো দিয়েছিল। পাকিস্তান চাও কি চাও না। সিন্ধুতেও সেরকম। পাঞ্জাবে বেশ পড়েছিল। কিন্তু সেটাও ৪৫ ভাগ। ৫০ ভাগও নয়। কিন্তু বেঙ্গলে বাঙালি মুসলমানদের ভোট পড়েছিল ৮৬ ভাগ। সব মিলিয়ে দেখা গেল ৬০ ভাগ পাকিস্তান চায়, ৪০ ভাগ পাকিস্তান চায় না। বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বেশি ভোটের জন্যে সম্ভব হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
যারা পাকিস্তান তৈরি করেছিল, তারা তৈরি করেছিল এই জন্যে যে মহাজন হিন্দু, জোতদার হিন্দু, জমিদার হিন্দু, স্কুল-কলেজের মাস্টার হিন্দু। সবকিছুতেই হিন্দু। এই যে ঘাড়ের ওপর চেপে আছে। পাকিস্তান হলে আমরা এ থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু পাকিস্তান হলো। এক হিন্দু চলে গেল, আরেক হিন্দু ঘাড়ের ওপর চেপে বসল। এই প্রশ্নটি কখনো আলোচনা হয় না।
যারা পাকিস্তান তৈরি করল, তারা এক বছর যাওয়ার আগেই একটি সেক্যুলার দাবি তুলল। ভাষার বিষয়টি তো একটি সেক্যুলার বিষয়। এক বছর যাওয়ার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলল। তার দু’তিন বছর যেতে না যেতেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটা বড় হয়ে উঠতে লাগল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জোরদার হলো। ১০ বছরের আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করে নিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানি সরকার। ’৪৭ সালে পাকিস্তান হলো আর ’৫৬ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ঘোষণা করা হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি, উর্দু এবং বাংলা। ১০ বছরের মধ্যে এটা ঘটেছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানপন্থি সাহিত্যিক যাঁরা ছিলেন, সাহিত্য চর্চা যাঁরা করতেন, ইসলামের স্লোগান দিয়ে, যারা পাকিস্তানপন্থি ছিলেন, তাদের আর পাত্তা থাকল না। এবং যারা তরুণ সমাজ ছিল, তাদের বিষয় কি? শামসুর রাহমানের কবিতা, আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ খানের কবিতা, ফুল, শাপলা ফুল, শাকপাতা, আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা। এগুলো সব মানুষ থেকে উঠে এসেছে। এই রকম খুব কম স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগে এসেছে। সেই যে শুরু হলো একটি যাত্রা, বাঙালি সংস্কৃতির যে যাত্রা সেটা একপর্যায়ে বিকশিত হতে হতে রাজনৈতিকভাবে দেশ স্বাধীন হয়েছে বাঙালি জাতির।
আর এর মধ্যে ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু থেকে জনগণভিত্তিক জনগণমুখী একটি সাহিত্য প্রয়াস শুরু হয়েছে। এটা সুদৃঢ় একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছে। এখানে যে উপন্যাস লেখা হচ্ছে। তা বিশ্বসাহিত্যের মানসম্পন্ন বলতে পারি আমরা। শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ। লেখকরা যা লিখে গেছেন, তা আমাদের কাছে বহুকাল ধরে শাস্ত্রীয় হয়ে থাকবে এদেশের উপন্যাস খোয়াবানামা এখন বিশ্বের যে কোনো দেশের সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়। কবিতার কথা বলি। শামসুর রাহমানের কবিতার কথা প্রথমে বলতে হয়। আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ’র কবিতাও। তরুণ কবিদের, যারা লিখতেন তাদের কবিতার কথা বললাম। গল্পকারদের কথা বললাম। এখানে ছোট গল্পের কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভিতটা হচ্ছে জনগণনির্ভর জনগণমুখী। এখানে বিষয়ের দিকে যদি তাকাই, উপন্যাসের দিকে যদি তাকাই কী দেখব? একটা বড় উপন্যাস পাওয়া যাবে- যেখানে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে। আশ্চর্য লাগছে তোমার? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি উপন্যাসই গ্রামের বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা গ্রাম নিয়ে লেখা। ইলিয়াসের অপর উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই শহর নিয়ে লেখা হলেও বড়লোকদের নিয়ে নয়। এই ব্যাপারটা অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্যে পৌঁছেছিল। এই ব্যাপারটা কি কলকাতার সাহিত্যে পৌঁছেছিল? পৌঁছে থাকলে তা কত দিনে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক এসেছেন। সমরেশ বসুর মতো লেখক এসেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে এমন একটা জায়গা স্পর্শ করে, সেটা ঐ লেখায় স্পর্শ করে না। শুধু একটি লেখকের লেখাই পাই পাশাপাশি, সে অদ্বৈত মল্ল বর্মণের লেখা। অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদারও জনগণ নিয়ে লিখেছেন। ওদের মধ্যে সেই উপাদানগুলো আছে। কিন্তু এখানে উপন্যাসগুলো যে জীবন্ত মানুষ। খোয়াবনামা তো পড়েছ?
তমিজের বাপ, এরকম একটি ক্যারেক্টারের কথা চিন্তা কর। কুলসুমের কথাটা চিন্তা কর। এই কথাটা ভাববার আছে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকভাবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা আছে। এখনও আছে। বাঙালি বলতে এক সময় মুসলমানদের বাঙালি বলা হতো না। সেটা আমরা ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাতেই জানি । ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাতে, ও তো মুসলমান।
শওকত আলী বর্ণনা করেন তার শৈশবের স্মৃতি। আমি একটা থানা শহরের স্কুলে পড়তাম। ক্লাস সেভেনে ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ আরবি পড়ব না ফার্সি পড়ব- এ নিয়ে প্রশ্ন। আমি বললাম, সংস্কৃত পড়ব। এই স্কুলে এর আগে কোনো অহিন্দু সংস্কৃত পড়েনি। ১৯০৮ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত তখন থেকে পড়ানো হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে আমি সেভেনে উঠলাম (রায়গঞ্জে)। আমার বড় ভাই বলছে, এই তুই আরবি নিস না। আরবি নিলে তুই কোনোদিন পাস করতে পারবি না। আরবির যে মৌলভী স্যার, উনি তোকে কোনোদিন পাস নম্বর দিবেন না। ওকে কোনো দিন পাস করে দেননি। তার কারণ আমার বাবা কংগ্রেস করতেন। আমি তাই সংস্কৃত পড়েছিলাম। সংস্কৃত পড়তে গিয়ে অসুবিধা হয়েছিল একবার।
অসুবিধা হয়েছিল মানে, কাপড়চোপড় পরে গিয়েছিলাম অন্য ধরনের। সেজন্য আমার বন্ধুরা ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিল। আচকান পায়জামা পরে গিয়েছিলাম, সে কারণে। সেদিন হয়েছিল কি, বাড়িতে বাবা কংগ্রেস আর মা করতেন মুসলিম লীগ। সেদিন আবার কোনো একজন মুসলিম লিডার বাড়িতে এসেছেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সেজন্য মা আবার আমাদের আচকান শেরোয়ানি, পায়জামা আর মাথায় লাল ঝুঁটিবাধা টুপি পরিয়ে দিয়েছেন। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ থেকে চা টা খেয়ে চলে গেছেন। ১০টা বেজে গেছে। তখন আমি ঐ কাপড় পরেই স্কুলে ছুটি। টিফিনের পরের সংস্কৃত ক্লাসের পিরিয়ডে ছেলেরা আর পণ্ডিত মশাই বলে যে, এই তুই এই কাপড় পরে আসছিস কেন, বের হ। পণ্ডিত মশাই বলেন, যা তুই কাপড় বদল করে আয়। পরে অবশ্য হেডমাস্টার, তিনি বিলাতফেরত ছিলেন, বললেন, না। তা কেন? কাপড়ের কী দোষ হয়েছে। আমাকে একটি বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন। আমার বন্ধুরা ঐ বেঞ্চ থেকে উঠে অন্য বেঞ্চে বসল। তখন ১০-১১ বছর বয়স। হাফ প্যান্ট শার্ট পরতাম।
শৈশব স্মৃতি শেষে আবার শওকত আলী বলতে থাকেন, বাঙালিদের পাকিস্তান সমর্থন করাটা ইসলামি স্টেটের ব্যাপার নয়। বহুকাল ধরে চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান আমলেও চেষ্টা করেছে জামায়াতে ইসলামী টাইপের লোকেরা। ইসলামি স্টেট বানাবার জন্যে।
কখনো চিন্তা করেছ? সেই জন্যে বলছি। এখানে এই যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দল বা মতবাদ দানা বাঁধতে পারেনি। বাংলার ব্যাপারটাই ভিন্ন।
যাক, আমি বলছিলাম, বাংলাদেশের সাহিত্যের মধ্যে ব্যাপারটা এখন কেমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে এটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়।
ওখানেও গণমুখী সাহিত্য আছে। এখানেও গণমুখী সাহিত্য। বাংলাদেশ আন্দোলনের যে ব্যাপারটা ছিল, বাংলা ভাষা আন্দোলন তার মূলে এই তরুণরাই তো। যারা ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গেছে। কিংবা পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছে। কিংবা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তরুণদের ব্যাপারই তো। এই তরুণদের একটি অংশই সংস্কৃতি চর্চা করছে। এই যে নাটক করা হয়, তাতে অভিনেতা আছে, পরিচালক আছে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। তিনি তো নাটক করেন। এখানে সাহিত্য সংস্কৃতির যে কাজটা হয়েছে। এটা তো কম কথা নয়। কিংবা রুদ্রের কথাটা চিন্তা কর। সে তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বাহিনীতে ছিল কি না জানি না। কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এই যে ব্যাপার, যেটা এখানে ঘটেছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কবিতা লিখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এখানে তো লেখক, কবি, শিল্পীরা সাংগঠনিকভাবে যুক্ত থেকেছেন। যেমন ছবি আঁকতেন যাঁরা, যেমন কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, রনবী, এঁরা তো প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
এখানে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের যে উদ্ভব হচ্ছে সেটা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। এবং কি হলো শওকত ওসমান এতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শওকত ওসমান সেই ভূমিকা নিতে পারলেন না। তখন তার বয়স কত? হার্ডলি ফোরটি। তখন কলেজে চাকরি করছেন, সরকারি চাকরি। আবু রুশদ-আবুল ফজল তারা কলকাতায় গিয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন।
পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কেউ কেউ যুক্ত ছিলেন, কেউ কেউ ছিলেন না। শওকত ওসমান পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। আবু রুশদ এ ব্যাপারে কোনো পক্ষের মধ্যে ছিলেন না। কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তিনিও ছিলেন না। যদিও তখন তার আবির্ভাব হচ্ছে। ‘নয়নতারা’ তখন প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে বের হয়। উনি পাকিস্তান এসেছিলেন পরে ১৯৫০ সালে। অবশ্য এইসব হিসাব করে সময়টাকে ঠিকভাবে ধরা যায় না, কারণ সেটা তখন উন্মেষ কালও।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কায়েস আহমদসহ শক্তিশালী গল্পকারদের আবির্ভাব হয়েছিল বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ’৬০-এর পরে শক্তিশালী গল্পকার কেন আসছেন না প্রশ্ন করা হয়েছিল শওকত আলীকে। তিনি বলেন, না আসার কারণ হচ্ছে- আমাদের এখানে যে সাংস্কৃতিক বিকাশ এটা ব্যাহত হচ্ছে রাজনীতির কারণে। পাকিস্তান আমলে প্রবণতা, পাকিস্তানের পক্ষে থাকলে, পক্ষে লেখা ছাপা হলে অমুক কমিটির মেম্বার হওয়া যাবে, বিদেশি ডেলিগেশনের সদস্য হওয়া যাবে এই তো ব্যাপারটা। এটা এখনো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ গভর্নমেন্ট এলো, দেখা গেল একশ্রেণীর লোককে তারা সামনে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এরা দেশভ্রমণ করছে। আবার একটা সরকারের পতন হয়ে আরেকটা সরকার এলো, তখন আরেক শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে। আরেক ধরনের লেখক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক সুবিধা পাচ্ছে। এই হচ্ছে এ এলাকার ঘটনা। এর বাইরে যারা থাকে বা থাকতে পারে, তারা জেনুইন কাজ করতে পারে। তাদের কাজ কিছুটা জেনুইন হয়।
আর এই যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। সমকাল বলে একটি দৈনিক পত্রিকা আছে। পাকিস্তান আমলে সমকাল বলে একটি সাহিত্য পত্রিকা ছিল। এখন কি এ ধরনের একটিও পত্রিকা আছে? কেন হতে পারছে না? এরকম কমিটমেন্টের লোক নেই? সিকান্দার আবু জাফর যে একেবারে নন কমিটমেন্টের লোক ছিলেন, তা নয়- তিনি শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ভালো একটি কিছু বিল্ডআপ করতে চেয়েছিলেন। আমি যাই করি, এই কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি। ওই সময় কিছু কিছু লোকের মধ্যে এই বিষয়টা ছিল। তাদের কোনো বিকল্প ছিল না। এইটুকু করা ছাড়া। যেমন ধরুন আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ খান রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তার মনের বিষয়টি কি ছিল? সেটা তার কবিতা পড়লে জানা যায় কিংবা হাসান হাফিজুর রহমান। তার মনের বিষয়টা কি ছিল? সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, ব্যাংকে বড় চাকরি করতেন। কিন্তু তার মনের ভেতরটা কি ছিল? এই রকম একটা অবস্থার মধ্যে থেকেও তারা আজন্ম সাহিত্য চর্চা চালিয়েছেন। আমাদের চেনাজানার মধ্যে ইলিয়াস, আমার চেয়ে ৫-৬ বছরের ছোট ছিল। তাকে আমি কাছ থেকে দেখেছি।
একদিন আলোচনার শুরুতে জাদু বাস্তবতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছিল। শওকত আলী বলেন, ৬০-এর দশকের সুরিয়ালিস্টিক স্বপ্ন বাস্তবতা, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো ইলিয়াসরা করেছেন। আমরা যারা আর্লি সিক্সটিতে লেখালেখি শুরু করেছিলাম তাদের মধ্যেও পাওয়া যাবে। আমার ছোট গল্পের মধ্যে আছে এ বিষয়গুলো।
আমরা যখন করছিলাম, ইউরোপে এর অনেক আগে থেকে ব্যাপারগুলো ঘটছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইউরোপে এ বিষয়গুলো ঘটছিল। ৫০-এর দিকে।
আর্লি সিক্সটিজে এইসব খবর আসতে শুরু করে। আমরা এগুলো পড়তে শুরু করি। ব্রিটিশ কাউন্সিলে যেতাম রেগুলার। ইউসিসে যেতাম রেগুলার। গিয়ে ওঁদের কবিতা-টবিতা পড়তাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি ১৯৫৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। ৫৮ থেকে ৬২ পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও স্কুলে এবং কলেজে চাকরি করেছি। ওই অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন হয়েছে, তেভাগা আন্দোলন হয়েছে। লড়াই-টরাই হয়েছে। দারিদ্র্য এবং শোষণ এসব চোখের সামনে দেখি। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্যারেক্টার পাই, বাস্তবতায় থেকেও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। একটা উদাহরণ দেই, জায়গাটার নাম বীরগঞ্জ। এক সময় তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল। এক বৃদ্ধ সাঁওতাল, পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তার উরুতে গুলি লাগলে পা-টি কেটে ফেলতে হয়। ১৯৪৬ থেকে ৪৮ এর মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছিল। তারপর পুলিশ তাকে ধরেনি? রোগা ভেবেছিল, মরে যাবে। তো ওকে দেখতাম। শীতকাল। ও শুয়ে আছে। ওখানে শীতকাল বেশ দীর্ঘ। দিনাজপুরের উত্তরাঞ্চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত শীত থাকে। বিকেলবেলা রোদে মাঠ, মাঠের মধ্যে আল আছে। একটা আলের উপর সে ঘুমিয়ে আছে। আমি কয়েকদিন ধরে দেখছি। লক্ষ্মীকান্ত না কি জানি সই নাম। ওকে সবাই কান্ত মোড়ল বলে ডাকত। কান্ত মোড়ল শুয়ে আছে দেখতাম। এর পাশে ছিল স্কুল। আমি গল্প করার জন্যে যেতাম প্রায়ই। একদিন সন্ধ্যা তখন হয় হয় অবস্থা, তখনও সে শুয়ে আছে। আমি তখন বললাম, মোড়ল, তুমি শুয়ে আছো কেন?
সে বলল, শুয়ে থাকতে হামার ভালো লাগে।
কী রকম ভালো লাগে?
বলল, হামি গান শুনতে পাই।
তারপর যে কথাটা বলল সে, বাংলা ভাষার কোনো কবি কখনো বলেননি এতো এক কবিত্বময় কথা। বলল, আমি গান শুনতে পাই।
কোথায় গান শুনতে পাও?
মাটির তলায় গান শুনতে পাই। বীজ ফেলা হচ্ছে। বীজ থেকে অঙ্কুর বের হচ্ছে। আর একটা করে পাতা ফুটছে আর গান হচ্ছে। হামি সেটা শুনতে পাই।
এই কবিতার বিষয় না। এমন কবিতা কেউ লিখেছে? এটা সুরিয়ালিজমের ব্যাপার। সুরিয়ালিজম তো হচ্ছে এক্সটেনশন অব রিয়ালিজম। এখন তুমি যদি রিয়ালিজমটাকে না ধরো, আগে ওর ডালপালা ধরো, তাহলে কি হবে? সত্যকে কি ধরা যাবে? তবে ঐ পথে যাঁরা অগ্রসর হয়েছিলেন, আমার মনে হয়, সবচাইতে সাকসেসফুল হয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তার খোয়াবনামার মধ্যে স্বপ্নকে নিয়ে এসেছেন, বাস্তবতাকে নিয়ে এসেছেন। কি বাস্তব? ফকির বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ ও তার শিষ্য চেরাগ আলীকে নিয়ে এসেছেন। এঁরা যুদ্ধ করেছিলেন। সেই যুদ্ধের সময় গান রচনা করা হয়েছিল। পল্লীর লোকেরা সেই যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে গান রচনা করেছিল। সেই গান লোকের মুখে প্রচারিত হতো। তমিজের বাপ, সেই বুড়া লোক সেই গান গেয়ে বেড়াত, আর ভিক্ষা করত। কাৎলাহার বিল বলে একটা বিল আছে। সেখানকার মাছের সঙ্গে সে কথা বলত, ব্রাত্যদের সঙ্গে কথা বলে আর গান গায়। এই হচ্ছে ক্যারেক্টার। বাস্তবতা হোক, স্বপ্ন বাস্তবতা হোক, অর্ধ বাস্তবতা হোক, এ এক জীবন্ত ক্যারেক্টার। তার মধ্যে তত্ত্বটা কি হচ্ছে, হিউম্যান স্ট্রাগলের, মানুষের মুক্তির সংগ্রামের যে কাহিনী, যে গান, এটা থেকে যায়। এটা কীভাবে থাকে? মানুষের মধ্যে গান হয়ে থাকে, ছবি হয়ে থাকে। কল্পনা হয়ে থাকে। সেখান থেকে মানুষ নতুন করে উজ্জীবন পায়। এটা কিন্তু বাস্তবতা। কিন্তু স্বপ্ন ও কল্পনার যে অবস্থাটা সেটা কিন্তু প্রত্যক্ষ বাস্তবতা নয়। এটা হচ্ছে সুরিয়ালিজম, রিয়ালিটি ও কল্পনার এই যে একত্র সমাবেশ, মিথের যে কাজ, মিথ একটা কল্পকাহিনীর মতো, তা থেকে মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং লড়াই করছে। বাঁচার লড়াই করছে। এ ব্যাপারটা ইলিয়াস যেভাবে করেছেন, এটা বিশ্বসাহিত্য তুল্য।
আমি এবং ইলিয়াস দুজনেই আরম্ভ করেছিলাম। আমি আরম্ভ করেছিলাম মাদারডাঙার কথা দিয়ে। আরেকটি উপন্যাস ছাপা হয়েছিল কলকাতার একটি কাগজে। সেটার বিষয় ছিল তাবিজ। পীরের দরগা। পীরের যে পূজা করতে যায়। সম্মান দেখানোর জন্যে যায়। হিন্দু মুসলিম সবাই যায়। এ ব্যাপারটা ছিল।
তো ওখানকার সাম্প্রদায়িকতার এ ব্যাপারটা, লেখাটা ছাপানোর পর প্রথম অভিজ্ঞতা হলো। দৈনিক কলকাতা বলে একটা কাগজ। তার শারদীয় সংখ্যা। সেখানে কিছু অংশ বাদ দিয়েছে। তাবিজের যে লেখাগুলো ছিল, নকশাগুলো ছিল, লিখে দিয়েছিলাম নকশাগুলো এই রকম যাতে আল্লাহু আল্লাহু লেখা ছিল। কিন্তু ওরা পত্রিকায় ছাপানো নকশাটি আর ছাপেনি। আরেক জায়গায় আছে, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ভালোই হয়েছিল, দুটি গরু এবং দুটি ছাগল জবাই হয়েছিল। দুইটি গরু বাদ, জবাই শব্দ বাদ হয়েছিল। ’৮৮-এর ঘটনা।
নকশাটা না হয় হারিয়ে যেতে পারে বুঝলাম। কিন্তু গরু শব্দ কীভাবে বাদ যাবে। জবাই শব্দটা কীভাবে বাদ যাবে? এ কারণে ’৯২-এ বিচিত্রায় এটি প্রকাশ করেছি। তার মধ্যে ঐ উপাদানগুলোকে আমি ব্যবহার করেছি। মানব মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে মিথ এখনো কাজ করে চলে।
এখানে এটা মিস করেছিল বলেই বিপ্লব হয় না। আধুনিকরাও বিচ্ছিন্ন ছিল। বামপন্থা বিষয়টি আধুনিকতার ব্যাপার। মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম সব দেশে সবসময় হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনে যেভাবে হয়েছে, সেভাবে আমাদের দেশেও হবে, তা নয়। কিছু শর্ত আছে। এখানে লড়াই সংগ্রাম ছিল। কিন্তু যারা বামপন্থিরা রাজনীতি করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন, তাদের প্রবলেম হয়েছে, তারা ভদ্রলোকের ছেলে। কলকাতার ঔপনিবেশিক কালচারের মধ্যে তারা লেখাপড়া শিখেছেন। আধুনিকতা বলতে ঐটাই বুঝায়। গ্রামের লোক মূর্খ চাষা। চাষা শব্দটা একটা গালি হয়েছে। ‘দুর ব্যাটা তুই একটা চাষা।’
সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন, সংস্কৃতি ও প্রথা উপেক্ষিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্য। এ প্রসঙ্গে শওকত আলী উল্লেখ করেন উত্তরবঙ্গের একটি প্রথার কথা, যা বাংলা কথাসাহিত্যে আসেনি। তিনি বলেন, অল্প বয়স, একটি কি দুটি বাচ্চা হয়েছে। মেয়েটি বিধবা হয়ে গেছে। বয়স হয়েছে ধরো ২৩-২৪। তার কিছু জমি আছে স্বামীর। তার বাড়ি আছে। এখন এই মহিলাকে দখল করার জন্য, তাকে বিয়ে করার জন্য কিছু মানুষের আগ্রহ জেগে ওঠে। কারণ, বিয়ে করলেই প্রপার্টি পাওয়া যাবে। আর বিধবাটিকেও নিরাপত্তার জন্যে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হবে।
ওখানকার (উত্তরবঙ্গে) একটা সিস্টেম আছে, ও ডাঙ্গুয়া বর ধরতে পারবে। ঘরজামাই নয়, ডাঙ্গুয়া। সাধারণত বয়সে ছোট হয়। মালিকানা কর্তৃত্ব থাকবে তার হাতেই। তারপর সে সন্তানও জন্ম দেবে? এক বিছানায় শোবেও। মৌলভীদের ডেকে কলেমা পড়ে বিয়ের যে অনুষ্ঠান, সেটাও হবে। কিন্তু কর্তৃত্বটা থাকবে স্ত্রীর হাতে। এই সিস্টেমটাকে বলা হতো ডাঙ্গুয়া সিস্টেম। এখন এই ব্যাপারটা আধুনিককালের মহিলা, যারা আছে, নারীবাদে বিশ্বাসী, তাদের মগজের মধ্যে কি ঢুকে? চিন্তা করতে পারে, সিস্টেমটা কত ভালো?
এইভাবে জমির চাষাবাদ কীভাবে হয়, কোন ফসল, কী ফসল ফলছে, কতদিন পরে এটা গজায়, ‘নাড়াই’ বইতে এইসব আছে। কবিরাজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে গুরু, কবিরাজ ওষুধ দিচ্ছে, এসব লেখা কোন উপন্যাস আছে? কৃষকের দেখলে তো চলবে না। কৃষকের যে সমগ্র অভিজ্ঞতা সেটাকে আনতে হবে। তা না হলে কৃষকের জীবন হবে কি করে? যেমন গরু একটা। একটা নেই। অল্প বয়সী ছেলে নাঙ্গলের খোটাটা ধরেছে। একপাশে গরু এবং এক পাশে বাপ টানছে। এসব কোনো ছোট গল্পে আছে? কোনো উপন্যাস আছে?
বিশ্বায়ন ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য:
ইন্টারনেট সংস্কৃতির বিকাশের ফলে উন্নত দেশগুলোতে সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্ক হচ্ছে। বই প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে শওকত আলী বলেন, সাহিত্য সংস্কৃতিকে কম্পিউটার প্রভাবিত করেছে এবং করবে। এখন এক বিশ্ব, এক সংস্কৃতির এই ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। গ্রন্থ প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবে- এটা আমার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না এই জন্যে যে গ্রন্থপাঠের যে আনন্দ, সেই আনন্দ অন্য কিছু দিয়ে, বিকল্প কিছু হয় না। জনপ্রিয় লেখক, বাচ্চাদের বই লেখে যে হেনরি পটার, বিদেশে গিয়ে খবর শুনলাম যে তার এগার মিলিয়ন বই বিক্রি হয়ে গেছে। আমি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে হাঁটছি, লাইনে দাঁড়ানো স্বামী-স্ত্রী, তাদের দুই বাচ্চাই দু’খানি বই হাতে নিয়ে পড়ছে, এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আর ঐ হিলারি ক্লিনটনের বই এয়ারপোর্টের যে বুকস্টলগুলো রয়েছে, তার মধ্যে স্তূপ করে সাজানো। তার মধ্যে লোক কিনছে। বেশ দাম। কিন্তু বেশি বিক্রি হচ্ছে। যাই হোক, আগেও দেখেছিলাম- লংগেস্ট জার্নি তারপর আরেকটা এসেছে, ৯৯ এ দেখেছিলাম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ম্যাক ম্যাকক্রফটের লেখা। আয়ারল্যান্ডে জন্মেছিলেন। আইরিশ আমেরিকান। আয়ারল্যান্ডে তার বাল্যকাল কেটেছে ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত। তার কাহিনী তুলে ধরেছেন। এই কাহিনীর মধ্যে কোথাও সেক্স নেই। কোথাও ভায়োলেন্স নেই। একটি পরিবার দুটি ছেলেমেয়ে আগে ৩টি ছিল। একটি মারা গেছে। একটি ছেলে একটি মেয়ে। আর স্বামী। নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে কীভাবে তাদের লড়াই চলছিল, তার কাহিনী। সেই ঘটনাটির নাম ছিল এঞ্জেলা। তার নামেই এঞ্জেলা এসেজ নাম ছিল। ঐ বইটি ৯৯ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলাম, তখন ছেলে আমায় বলল, নাও পড়। বইটি কিনে নিয়ে আসলাম। সেটা এখন ১ বছরের মধ্যে ৩ বিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল। তার মধ্যে সেক্স নাই, ভায়োলেন্স নাই। মাত্র বর্ণনা আছে।
আমার ধারণা কম্পিউটার টেলিভিশন এ ধরনের জিনিস যতই হোক এবং বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যতই জোরদার হোক। কিন্তু সংস্কৃতি, বিভিন্ন অঞ্চলের যে সংস্কৃতি তার প্রকৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। এক প্রকৃতি করতে পারছি না, এখানে বর্ষাকালে বর্ষাকালটা তো থাকবে। নাকি? এখানে শাপলা এখানেই হবে। অন্য কোনখানে হবে না। এখানের কাপড় পরার রয়েছে নিজস্ব ঢং ভঙ্গী। গেঞ্জি প্যান্ট পরে মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা কি পারবে? যতই আধুনিক হই না কেন, শাক তা খেতে হবে তাকে।
কোন পোশাক পরবে। লম্বা গাউন? চেন্নাইতে দু’মাস ছিলাম। মাদ্রাজে মুসলমান পরিবারের মেয়েরা সালোয়ার কামিজ পরে এবং বোরখাও পরে। যে মেয়েটি ডাক্তারি করে হসপিটালে সার্জেন্ট, গাড়ি চালিয়ে এলো, শাড়ি পরেই। সার্জারিতে অংশ নিল শাড়ি পরা অবস্থায়, শুধু ওপরে একটি গাউন পরে নিল। ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা সুট-টুট পরে, পাঞ্জাবি পরে। কিন্তু মহিলারা শাড়ি পরে। সাইকেল করে মেয়েরা অফিসে যাচ্ছে। মাদ্রাজের মেয়েরা খুব শিক্ষিত। প্যান্ট পরা রেয়ার। এটা কলকাতার কালচার। কলকাতার রাস্তা দেখলে মনেই হবে না এটা কলকাতা। ঢাকায়ও প্যান্টপরা মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। মৌলবাদী আচরণ বাড়ছে। হিন্দু মৌলবাদীও বাড়ছে। আশ্রমে নাকি শাস্ত্রীয় সমাবেশ হয়।
বাংলাদেশে, এই সাথে জনগণের যে প্রকৃতি, এখানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম যতই করা হোক না কেন, এখানকার মূল যে ভাবধারা তা হচ্ছে গণধর্মী ভাববাদী।
এখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার আধুনিকতা-শিক্ষার যে ব্যবস্থাটা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, সেটা কী? রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তার ইনসপাইরেশন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব কি শাস্ত্র জানতেন। তিনি তো ভক্তিবাদী ছিলেন। শক্তিরূপিনী মাতৃদেবী মাকে তিনি কী করেছেন? তিনি মাতৃরূপিনী রূপে কল্পনা করেছেন। দয়া ও ভক্তির বিষয় হিসেবে সাধনা করেছেন। কিন্তু তার নামে সংগঠন গড়ে তুললো স্বামী বিবেকানন্দ, এই সংগঠনটা কি দাঁড়াল? দাঁড়াল হচ্ছে শাস্ত্র শিক্ষা, শাস্ত্র আলোচনার কেন্দ্র। এগুলো করে কে? সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকেরা। ব্রাহ্মধর্ম সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে হয়নি, হয়েছে এলিটদের থেকে। এই ধর্মীয় ব্যাপার দেখতে পাচ্ছে। এটাও কিন্তু সমাজের এলিটরাই করছে। হিন্দু ধর্মই বল, বা ইসলাম ধর্মই বল। সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু দুর্গাপূজা দেখা আনন্দের বিষয়। ওদের পূজা ওরা করছে। এখন ওরা ওদের ভগবানকে পূজা করছে। আল্লাকে ওরা ভগবান বলে। করুক। আমরা আল্লাকে আল্লা বলি। এটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ধর্ম। সে কারণে তারা পাশাপাশি বসবাস করছে, মেলামেশা করছে। কোনো অসুবিধা নেই। ওরা ওদের ধর্ম পালন করে, আমরা আমাদের ধর্ম পালন করি।
সুপ্রিয় পাঠক, প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সাহিত্যকীর্তিকে উপলক্ষ করে এই লেখাটি নয়। মহান, কৃতিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর সাহিত্য, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
তথ্যসূত্র:
১.’প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ইউপিএল, ঢাকা।
২. যেভাবে লেখা হলো ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, মাহমুদ শাওন (২৯ মে ২০১৫), দৈনিক কালের কণ্ঠ।
৩. “যে ঐতিহ্য আমার চেতনা আর চিন্তায় ক্রিয়াশীল তার বিকাশ এই বাংলা ভূখণ্ডেই, শওকত আলী”; দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ এপ্রিল ২০১০।
৪. কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের সাক্ষাৎকার: সাক্ষাৎকার গ্রহণ, গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় তরুণ সরকার, সাপ্তাহিক।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন ও কথাসাহিত্যিক শওকত আলী প্রবন্ধ সাহিত্য সৈয়দ আমিরুজ্জামান