বাইক দিয়ে নতুন যান ‘মন্টু মিয়ার মোটরভ্যান’
৪ মে ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৪ মে ২০২৫ ০৮:২২
রাজবাড়ী: যান্ত্রিক যুগে অনেকেই অনেক কিছুর রূপান্তর ঘটায়। যেমন- শ্যালো মেশিনকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, এখন আর নতুনভাবে উপস্থান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার সাইকেল ও রিকশায় মোটর ব্যবহার করে যান্ত্রিক রূপ দেওয়া অনেক আগেই ঘটে গেছে বাংলাদেশে। হাল আমলে পায়ের ভ্যান-রিকশার জায়গা দখল করেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ভ্যান।
কিন্তু মোটরসাইকেলকে ভিন্ন যানবাহন হিসেবে রূপান্তর ঘটানোর খবর খুব একটা দেখা যায়নি। সম্প্রতি মোটরসাইকেলের সঙ্গে ভ্যানের বডি লাগিয়ে চমক দেখিয়েছেন রাজবাড়ীর মন্টু মিয়া নামের এক ব্যক্তি। গত পাঁচ বছর ধরে এমন পরিকল্পনা তার। মোটরসাইকেলের শখ, জীবিকা নির্বাহ ও ব্যাটারিচালিত ভ্যানের খরচ কমাতে এই কাজ করেছেন তিনি। তিনি এই বাহনটির নাম দিয়েছেন ‘মন্টু মিয়ার মোটরভ্যান’।
মন্টু মিয়ার বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের ধুঞ্চি গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। বিভিন্ন জিনিস বানানোর স্বপ্ন ছিল ছোটবেলা থেকে। কিন্তু অর্থ কষ্টে থমকে যায় তার সব ইচ্ছা। পাঁচ বছরের চিন্তা শেষে বানিয়েছেন ব্যতিক্রমী এই যানবাহন। প্রতিদিন এই যানবাহনটি দেখতে আসছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজারো দর্শনার্থী।
জানা গেছে, বিগত পাঁচ বছর ধরে স্বপ্ন দেখেন মোটরসাইকেলের সঙ্গে ভ্যানের বড়ি লাগিয়ে জিনিসপত্র বহন করবেন মন্টু। কিন্তু অর্থকষ্টে থেমে যায় তার স্বপ্ন। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। একটি মোটর মেকানিক্সের দোকানে বলে রাখেন কম দামের মোটরসাইকেল পেলে তার কাছে বিক্রির কথা। এর পর কিস্তি উঠিয়ে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে লটারিতে পাওয়া ৮০সিসির একটি মোটরসাইকেল কেনেন মন্টু। নিজের বুদ্ধি আর পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে মোটরসাইকেল দিয়ে তৈরি করেন যান্ত্রিক ভ্যানগাড়ি। এতে খরচ পড়েছে ৩০ হাজার টাকা। বর্তমানে দিব্যি রাস্তায় চলছে তার এই গাড়ি। নতুন মডেলের এই ভ্যানটি দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শণার্থীরা।
মন্টু শেখের মা ময়না সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলে আমার কাঠ মিস্ত্রির কাজ করে। তার পাশাপাশি রিকশা-ভ্যান চালায়। আর যখন কাজ থাকে না তখন সে যে কী করে বোঝা কষ্ট। জানতে চাইলে বলে, মা আমিই বুঝি না তোমাদের কি বলব। পুরাতন রিকশা কিনে এনে সব খুলে আবার অন্যরকম করে রিকশা বানায়। এই ভ্যান আর মোটরসাইকেল কিনে সেটা খুলে এমন গাড়ি বানাইছে। আরও কতকিছু বানায় সে।’
মন্টুর স্ত্রী জুলেখা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন এনে দিন খেতে হয়। আমার স্বামী মাঝে-মধ্যে হুদা কাম করে। তয় এবার যা বানাইছে তা অবাক করা বিষয়। মোটরসাইকেল আর ভ্যান কেটে একটা গাড়ি বানাইছে। গাড়িটি দেখতে প্রতিদিন অনেক লোক আসে। দেখা যায়, সে একটা রিকশা কিনে সেটা খুলে আবার অন্যরকম করে সেট করে। টিভি খুলে কী কাজ করে যে, ডিস ছাড়া টিভি দেখতে পাচ্ছি। অনেক সময় ভালো জিনিসও নষ্ট করে ফেলে। কিস্তি তুলে এগুলো কিনে। ভালো মোটরসাইকেল আর ভ্যান কেটে এই গাড়ি বানাইছে।’
মন্টু মিয়া সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি কাঠ মিস্ত্রি। এছাড়া, যখন সময় পাই, তখন রিকশা-ভ্যান চালাই। ভ্যানের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে চার্য দিলে চার্য হয় না, অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না, তখন বসে থাকতে হয়। আমার খুব শখ ছিল মোটরসাইকেল চালানো। টাকার অভাবে কিনতে পারি নাই। একজনকে বলেছিলাম কম দামে কেেউ মোটরসাইকেল বিক্রি করলে জানাতে। একজন লটারিতে পাওয়া ৮০সিসির মোটরসাইকেল বিক্রি করবে শুনে কিস্তি তুলে সেটা ১৬ হাজার টাকায় কিনেছি। পাঁচ বছর ধরে পরিকল্পনা করছি, অন্যরকম একটা গাড়ি তৈরি করব। আমি যখন ঘুমাতে যাই তখনও চিন্তা করি গাড়িটা কীভাবে তৈরি করব। মোটরসাইকেলের পিছনের চাক্কা আর আমার আগের ভ্যানগাড়ির সামনের চাক্কা খুলি। এরপর একটা ফ্রেম তৈরি করি ওয়ার্কশপ থেকে। তার পর তৈরি করি এই গাড়িটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করি। বাঁশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মালামাল টানি। একলিটার তেলও লাগে না দৈনিক। আগে অনেক অসুবিধায় পড়তে হতো। ভ্যানে চার্য থাকত না, ব্যাটারি দুর্বল হয়ে যেত। এখন আর সে চিন্তা নাই। অনেকে আমার গাড়িটি দেখে নিয়ে দিতে বলে।’
তবে অনেক শখ আর কষ্টের অর্থ দিয়ে তৈরি করা গাড়ি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত মন্টু মিয়া। আর সেই চিন্তাটা হলো পুলিশ হয়রানি। কারণ, তার নতুন এই যানের কোনো লাইসেন্স নাই। এমনকি নেই তার ড্রাইভিং লাইসেন্সও।
মিজানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) প্লাবন আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মন্টু মিয়ার অনেক মেধা। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু তৈরি করেছে। এবার মোটরসাইকেলের পেছনের আর ভ্যানের সামনের চাক্কা খুলে একটি গাড়ি তৈরি করেছে। সে একজন কাঠ মিস্ত্রি। এর পাশাপাশি সে ভ্যান-রিকশা চালায়। তবে এমন গাড়ি আমিও প্রথম দেখলাম।’
নতুন এই বাহনটি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক মো. শফিউল্লাহ সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মোটরসাইকেল সাধারণত দুই চাকার হয়। কিন্তু গাড়িটি যখন মোডিফাই করবে, অর্থাৎ দুই চাকা থেকে তিন চাকাতে পরিণত করবে, তখন বিআরটিএ-তে আবেদন করতে হয়। আর সে যেভাবে গাড়িটি তৈরি করেছে এটি কন্ট্রোল করা কঠিন। এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।’
স্থানীয় লোকজন এই যানবাহনটি দেখতে এসে বলেন, রাজবাড়ীতে এরকম ভ্যান এই প্রথম দেখলাম। মোটরসাইকেলের পেছনের আর ভ্যানের সামনের চাকা খুলে ফিটিং করে গাড়িটি বানানো। মন্টু শেখের মাথায় অনেক বুদ্ধি। আজব এক জিনিস বানাইছে মন্টু মিয়া।
সারাবাংলা/পিটিএম