ঢাকা: বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন হতে যাচ্ছে বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিকেলে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই বাজেটে বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এর আগে, ১৫ শতাংশ হারে একক ভ্যাট হারের সিদ্ধান্ত এলে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে দুই বছরের জন্য আইনটি স্থগিত করা হয়েছিল। তবে বাস্তবায়নের মুখে থাকা ভ্যাট আইনটিতে ভ্যাটের হার রাখা হয়েছে পাঁচটি। অর্থাৎ পুরোনো আইনের সঙ্গে সামঞ্চস্য রেখেই বাস্তবায়ন হচ্ছে ভ্যাট আইনটি।
এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় যেন স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকে। ধুঁকতে থাকা দেশের আর্থিক খাতের সংস্কার বিষয়েও বাজেটে নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার যে লক্ষ্যগুলো এখনও পূরণ হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নেও দিকনির্দেশনা থাকবে বলে প্রত্যাশা তাদের। একইসঙ্গে ধানসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বাজেটে বড় কোনো ঘোষণা আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন- দেশের ৪৮তম বাজেট বৃহস্পতিবার, পাস ৩০ জুন
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের এটি প্রথম বাজেট। উন্নয়নের যে ধারবাহিকতা সরকার দেখিয়েছে, বাজেটে তা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রত্যাশা। এছাড়া এটি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকীর পরিকল্পনার শেষ বছর। এখন পর্যন্ত এ পরিকল্পনার যা অর্জন হয়নি, বাজেটে সেই দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আমরা আশা করি। দেশের আর্থিক খাতে নানা বিশৃঙ্খলা রয়েছে, আমরা সেইসব কাঠামোর সংস্কার চাই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, বাজেটে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রতিফলনও থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, এ বছর নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আগে তিনটি হার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, এবার পাঁচটি হারে ভ্যাট বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই পাঁচটি হার কিভাবে প্রয়োগ করা হবে, নতুন আইনটি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এবারও প্যাকেজ ভ্যাট থাকবে কি না— বাজেট বক্তৃতায় তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আশা করি। নারীদের জন্য বাজেটে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হবে, অর্থাৎ বাস্তবায়নের বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
আরও পড়ুন- করমুক্ত আয়সীমা না বাড়লে চাপে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর সারাবাংলাকে বলেন, কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্যের অধিকারের বিষয়টি যেন বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ থাকে। কৃষক কিভাবে ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে, ভতুর্কি বাড়ানো হচ্ছে কি না— এসব বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
এদিকে, সংসদে বাজেট উত্থাপনের ঠিক আগের দিনও বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার। শেষ মুহূর্তেও তারা তুলে ধরেছেন কিছু দাবির কথা। নতুন অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাক রফতানিতে এখনো নগদ ৫ শতাংশ প্রণোদনা দাবি করছে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। একইসঙ্গে খাতটিকে সম্পূর্ণ ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবিও তাদের। যদিও পোশাক রফতানিতে এরই মধ্যে এক শতাংশ রফতানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, সারাবাংলাসহ একাধিক গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ পেয়েছে।
আরও পড়ুন- ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলকে ভ্যাট নিবন্ধন করতেই হবে
বাজেটের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমএই সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘পোশাক খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে পোশাক রফতানির সব ক্ষেত্রে আমরা নগদ ৫ শতাংশ প্রণোদনা চাই। কিন্তু যদি কোনো ক্ষেত্রে ১ শতাংশ বাড়ানো হয়, সেটি আমাদের জন্য সুসংবাদ নয়। আমরা ৫ শতাংশ প্রণোদনা আশা করি। এটা না হলে আমরা মর্মাহত হব। আর অন্য শিল্প থেকে কিন্তু তেমনভাবে রিটার্ন আসছে না। পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া দরকার।’
একই বিষয়ে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে বর্তমানে পোশাকের চাহিদা দিন দিন কমছে। আজ থেকে তিন বছর আগে আমাদের প্রত্যাশা ছিল ২০২০ সালে এসে পোশাক রফতানি ৬০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। তিন বছর আগে যেখানে ৪৮০ বিলিয়ন ডলার রফতানি ছিল, সেখানে তা কমে গতবছর ৪৪০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে অনলাইনে মার্কেটিং অনেক বেড়ে গেছে। অনলাইনে যেভাবে সাপ্লাই দিতে হয়, আমাদের সেই সুযোগ না থাকায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। দ্রুততার সঙ্গে করতে পারি না। ওভেন গার্মেন্টের উপকরণের ৬৫ শতাংশ এখনো আমদানি করতে হয়। চীন সাত দিনে তাদের পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে। আমাদের লিড টাইম বেশি। অনলাইনে তেমন কিছু করতে পারিনি। একইসঙ্গে মজুরি বেড়েছে। কিন্তু পোশাকের দাম কমেছে। তাই আমরা সব ধরনের পোশাক পণ্য রফতানিতে নগদ ৫ শতাংশ প্রণোদনা চেয়েছি। অন্তত আগামী এক বছরের জন্য এই প্রণোদনা দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে পোশাক পণ্যকে সম্পূর্ণ ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে। আমরা ভ্যাটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। তবে কৃষিতে ভর্তুকি না বাড়িয়ে পোশাকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা বাড়ানোর সমালোচনাও করেছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।
আরও পড়ুন- বাজেটে পোশাক খাতে প্রণোদনা ১ শতাংশ বাড়ছে
এদিকে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদেরও বেশ কিছু দাবি রয়েছে। খাতটির শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, আইসিটি খাতে যে সুবিধা আছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটি খাতের জন্য কর অব্যাহতি রয়েছে, কিন্তু সেটা পেতেও বেগ পোহাতে হয়। কর অব্যাহতি পেতে কোম্পানিগুলেকে প্রতিবছর এনবিআর থেকে সার্টিফিকেট তুলতে হয়। সেটা পেতেও অনেক সময় তিন থেকে চার মাস সময় লেগে যায়। এই কোম্পানিগুলোকে যেন ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, আমরা তা চেয়েছি। অথবা যারা কর অব্যাহতি পাবে, তাদের যেন বেসিস থেকে অথরাইজড করা যায় সেই, ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যে সুবিধা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো যেন তা পায়।
বেসিস সভাপতি বলেন, সরকার কিছু অনুন্নত দেশকে এমন শর্তে সাহায্য করতে পারে যেন সেই দেশ ওই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আইটি সেবা নেয়। এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে আমরা ৫০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ চাই। এ অর্থ দিয়ে আমরা অন্য দেশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কারিগরি সহায়তা দেবো। আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোকে এ অর্থ দিয়ে ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে এই শর্তে যে, তারা আমাদের দেশ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সেবা নেবে।
বিকল্প ক্রেডিট কার্ডের দাবি জানিয়ে বেসিস সভাপতি সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের আরেকটি ক্রেডিট লাইন দেওয়া হোক, যে কার্ড দিয়ে ডিজিটাল মার্কেটের বিজ্ঞাপনের অর্থ লেনদেন করা যাবে। সম্পূর্ণ আলাদা ক্রেডিট লাইনের কথা আমরা ভাবছি। এর ফলে সরকার হিসাব রাখতে পারবে, সেখান থেকেই ভ্যাট নিতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, সেপারেট ক্রেডিট লাইন হলে সরকারের কাছে সঠিক হিসাব থাকবে। সরকারের কাছে তথ্য না থাকায় সরকার ফেসবুক ও গুগলকে চাপও দিতে পারছে না। তখন বাংলাদেশে অফিস খোলার জন্য ফেসবুককে চাপ দেওয়াও সম্ভব হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু দাবির কথা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি সেলিমা আহমাদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, নারীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করার দাবি রয়েছে আমাদের। নারীদের জন্য প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমরা বলেছি, বরাদ্দ দেওয়া অর্থ যেন পুরোটা ব্যয় হয়। অর্থাৎ যে কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার পুরোটা যেন বাস্তবায়ন হয়।
সেলিমা আহমাদ বলেন, নতুন নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে আগামী ৫ বছরের জন্য কর ও ভ্যাটে রেয়াত চেয়েছি। নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে অনেক স্টেশনারি কিনতে হয়। খাতা, কলম ও সব প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার খরচে আমরা ভ্যাট রেয়াত চেয়েছি। আমাদের যদি এসব সুবিধা না দেওয়া হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থে নারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারব না। কারণ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমনিতেই আমাদের অর্থের ঘাটতি রয়েছে।
এদিকে, বাজেটের ঠিক আগে দেশের শীর্ষ দুই ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই ও ডিসিসিআই অনেকটাই নিশ্চুপ রয়েছে। কোনো কোনো নেতারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও অপারগতা প্রকাশ করছেন।
আরও পড়ুন-
বাজেটে ‘চাহিদা নেই’ কৃষি মন্ত্রণালয়ের!
বাজেটের আকার বাড়ছে, বাড়ছে ঘাটতিও
বাজেটে ভর্তুকি বাড়ছে বিদ্যুতে, কমছে খাদ্যে
৪৮ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৬৬৬ গুণ
বাজেটের আকার বাড়লেও সংক্ষিপ্ত হচ্ছে বক্তৃতা
বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে দুই শতাংশ ভর্তুকি
আসন্ন বাজেটে ঘাটতি এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ
ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে দেড় হাজার কোটি টাকা থাকছে বাজেটে
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর