‘তারেক জিয়াকে ফিরিয়ে এনে সাজা বাস্তবায়ন জরুরি’
২১ আগস্ট ২০২০ ১৮:৪৮
এস এম কামাল হোসেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার জেনাসুরের এই আওয়ামী লীগ নেতা কৈশোরকাল থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। কলেজ ছাড়াও জেলা ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক হন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের এর আগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তিনি কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিএনপি-জামায়াত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের আজকের দিনে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এস এম কামাল হোসেন। যোগ দিয়েছিলেন সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে। কিন্তু কে জানত, সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গিয়ে ঘৃণ্য সন্ত্রাসের শিকার হতে হবে! সেদিনের গ্রেনেড হামলায় এস এম কামাল গুরুতর আহত হন। একের পর এক স্প্লিন্টার বিদ্ধ করে তার শরীরকে। এখনো কিছু স্প্লিন্টার বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে।
১৬ বছর আগের সেই দিনটি আজও জীবন্ত বীভৎসতা নিয়ে যেন হাজির হয় এস এম কামালের স্মৃতিপটে। সারাবাংলার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট নৃপেন রায়ের সঙ্গে কথা হয় সেই স্মৃতি নিয়ে। এস এম কামালের সঙ্গে আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
শুরুতেই জানতে চাই ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত সেই হামলার দিনটির কথা। এস এম কামাল হোসেন বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। সারাদেশে বোমাবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমাবেশ ছিল ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। সেখানে আমরা নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে গিয়েছিলাম। নেত্রীর গাড়ি বহরের সঙ্গেই আমি গিয়েছিলাম। নেত্রী তখন মাত্র বক্তৃতা শেষ করছেন। আজকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং পঙ্কজ দেবনাথ, পান্নাসহ ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা সবাই সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড। আমরা সবাই ছিটকে পড়ি। আহত হই।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ তখন শত শত আহত ব্যক্তির রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিলছিল না সেবা। কামাল বলেন, আমাকে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) ড্রাইভার আলী হোসেন আর শাজাহান ধরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। ধানমন্ডিতে ওই সময় ডেল্টা হাসপাতাল ছিল। ছাত্রলীগের একটা ছেলে আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে আমার সঙ্গে সেন্টুকেও নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি সেন্টু কোথাও নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, চিকিৎসক বললেন মারা গেছে।
আরও পড়ুন-
ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১৬তম বার্ষিকী আজ
আপিল শুনানিতে অগ্রাধিকার পাবে ২১ আগস্ট মামলা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মুখে কুলুপ এঁটেছে বিএনপি
গ্রেনেড হামলায় শ্রবণশক্তির ক্ষত বয়ে চলছেন শেখ হাসিনা
‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা’
এস কামালের কাছে জানতে চাই— শরীরে কতগুলো স্প্লিন্টার আঘাত হেনেছিল বা এখনো কতগুলো স্প্লিন্টার আছে? উত্তরে বলেন, কতগুলো স্প্লিন্টার আছে, ঠিক বলতে পারব না। তবে চিকিৎসকরা বলেছেন, অনেকগুলো আছে। এখনো এক্সরে করলে বোঝা যায়, পুরো পায়েই স্প্লিন্টার আছে। আর ওই সময় যখন ডেল্টায় অপারেশন হয়েছিল, ৯ ইঞ্চি নাড়ি কেটে ফেলে দিয়েছিল। ওইটা পুরোটাতে স্প্লিন্টার ভর্তি ছিল। আবার ইন্ডিয়াতে যখন নিয়ে গিয়েছিল, তখনো ১৩/১৪টা স্প্লিন্টার বের করেছিল। আর বাকি যেগুলো আছে, সেগুলো বের করতে গেলে পায়ের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাই ওগুলো আর বের করার চিন্তা করিনি কখনো।
ভয়াবহ সেই আঘাতের পর সুচিকিৎসায় যে সুস্থ হয়েছেন, তার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন এস এম কামাল। তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নেত্রী ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। তিনি ওই অবস্থার মধ্যেও লোক পাঠিয়ে আমার খোঁজ নিয়েছেন। অবস্থা এমন ছিল— অপারেশনের সময় হয়তো অনেকেই ভাবেনি যে আমি বেঁচে ফিরব। কিন্তু আল্লাহ হায়াত রেখেছেন, বাঁচিয়ে দিয়েছেন। পরে আবার নেত্রী উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন, চিকিৎসা করিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, একুশে আগস্টের সেই গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য ছিল সরাসরি শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলে থাকেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে যেমন দেশকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে আরও একবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ওই হামলা চালানো হয়েছিল। এ হামলাকে আপনি কিভাবে দেখছেন— প্রশ্ন রাখি এস এম কামালের কাছে। তিনিও মনে করেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে গ্রেনেড হামলারও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
এস এম কামাল বলেন, ২১ আগস্টের হামলার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা। মূল টার্গেট ছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গববন্ধুসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করেছিল সেই অপশক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি এবং যারা বাঙালির কাছে পরাজয় বরণ করেছিল। সেই পাকিস্তানি শক্তি, তাদের আন্তর্জাতিক মোড়ল এবং তাদের এ দেশের এজেন্ট মোশতাক ও জিয়া চক্রই পঁচাত্তরের সেই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের সন্তান তারেক জিয়া হাওয়া ভবনে বসে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রেনেড হামলার। পরবর্তী সময়ে তো জানাই গেছে, বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর, জামায়াতের সেক্রেটারি মুজাহিদীসহ, বিএনপির পিন্টু, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, হারিছ চৌধুরী, মুফতি হান্নানসহ জঙ্গিরা বসে এই হামলার পরিকল্পনা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তারা ১১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল। সেদিন অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন। কিন্তু আমাদের আইভি রহমানসহ ২২ জন প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। আমরা মনে করি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হামলাকারীরা এক ও অভিন্ন শক্তি। তাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এদের মূল লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা হত্যা করা, গণতন্ত্রকে হত্যা করা।
তবে শেখ হাসিনার কারণেই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের সেই ষড়যন্ত্রে সফল হয়নি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বাংলাদেশের মানুষ বঞ্চিত হয় না। ওই সময় উনি আবার বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশটাকে একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, সেই অপশক্তি মনে করে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তানের ধারায় ফিরে নিতে পারবে না। বাংলাদেশকে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র, শোষণের ক্ষেত্র করতে পারবে না। এ কারণে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলেই বাংলাদেশকে তারা তাদের মতো করে পরিচালনা করতে পারবে— এই ধারণা থেকেই সেদিন ২১ শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা।
তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েছেন। যে বাংলাদেশ ছিল জঙ্গিবাদের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ ছিল সন্ত্রাসের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ ৫/৬ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই বাংলাদেশ সমৃদ্ধির বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই করোনা মহামারির মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করছেন বিশ্বনেতারা। যেকোনো সংকট, মহামারি, দুর্যোগ— সবকিছু মোকাবিলার জন্য বর্তমান বিশ্বে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই, এটি আজ প্রমাণিত।
১৪ বছর পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা কী— এমন প্রশ্নের জবাবে এস এম কামাল বলেন, আমরা মনে করি, ২১ আগস্টের সেই নৃশংস হামলার যারা নায়ক, তাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। তারেক জিয়াসহ অন্য আসামি যারা পলাতক আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোটা জরুরি। অন্যরাসহ তারেক জিয়ার যে সাজা আছে, সেই সাজা কার্যকর করাটা জরুরি। এটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এটি কেবল আমার দাবি নয়, এই দাবি দেশের আপামর জনগণের
গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা সোচ্চার বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে দলটির এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, এই দাবি আমাদের সবসময় আছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীনও আছে। হয়তো আন্তর্জাতিক মহলের কোনো অজুহাত আছে, সে কারণে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু আমার যেটা মনে হয়— সরকারের পক্ষ থেকে এবং আমাদের দলের পক্ষ থেকে প্রেশার আছে, তাকে (তারেক রহমান) দেশে ফিরে আনা এবং বিচারের সম্মুখীন করা এবং তার বিরুদ্ধে যে সাজা হয়েছে, সেই সাজা বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা সবসময় সোচ্চার।
২১ আগস্ট ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এস এম কামাল গ্রেনেড হামলা গ্রেনেড হামলার শিকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক স্প্লিন্টার