নেতাদের নির্দেশেই গাড়ি পোড়ানো হয়!
১৬ নভেম্বর ২০২০ ১৮:২৪
ঢাকা: ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের দিন রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৯টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার বিএনপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, নেতাদের নির্দেশেই বাসে আগুন দিয়েছেন। তারা বলছেন, রাজনীতির ময়দান সাদামাটা হয়ে গেছে। বিশেষ করে কর্মীদের মনকে চাঙ্গা রাখতেই বাসে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এতে ভোট কম পেলেও বাস পোড়ানোর মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মন কিছুটা ‘পুষিয়ে নিতে’ সক্ষম হয়েছেন।
রোববার (১৫ নভেম্বর) পুলিশের একাধিক সেলের সঙ্গে কথা বলে বাস পোড়ানোর ঘটনাগুলো নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। মূলত বাসে আগুনের ঘটনাগুলোতে পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়েই এসব কথা বলছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) উপনির্বাচনের দিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে রাজধানীর ৯টি পয়েন্টে ৯টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই দিন থেকেই জড়িতদের গ্রেফতারে মাঠে নামে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রথম দিন ঘটনাস্থল ও রাতের বেলায় অভিযান চালিয়ে অন্তত ২৮ জনকে আটক করা হয়। বাস পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) তাদের আদালতে হাজির করলে আদালত তাদের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, রাজনীতির মাঠ গরম করতেই নেতাদের নির্দেশে গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
পল্টন থানার একজন পুলিশ পরিদর্শক রোববার (১৫ নভেম্বর) রাতে সারাবাংলাকে বলেন, রিমান্ডে থাকা বেশ কয়েকজন বিএনপির নেতাকর্মী জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে এক ঘরোয়া বৈঠকে সিনিয়র কয়েকজন নেতা বলেছিলেন, ‘মাঠ গরম রাখতে হবে। নাহলে রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। টিকে থাকতে হলে মানুষের অন্তরে বাস করতে হবে। সারাদেশের মানুষ বিএনপিকে চায়। কিন্তু বিএনপির কোনো সাড়াশব্দ নেই। তাই মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে হবে।’ নির্দেশনার বাইরে একজন নেতাকর্মীও কিছু করেন না বলে জানিয়েছেন রিমান্ডে থাকা এসব নেতাকর্মী।
বসুন্ধরা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা-১৮ আসনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে যুবদল ও ছাত্রদল একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষোভ মিছিল শেষে নেতাকর্মীরা একটি বাস ভাঙচুর করে। সেখান থেকে পুলিশ হাতেনাতে দু’জনকে আটক করে। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রগতি সরণিতে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
একই দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরীর একটি ফোনালাপের রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ফোনালাপেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে যুবদলের নেতাকর্মীরা বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত। পুলিশ ওই ফোনকল ভতিয়ে দেখছে।
পুলিশ বলছে, দুপুরে বসুন্ধরা এলাকায় বিএনপির মিছিল শেষে গাড়ি ভাঙচুর এবং দু’জন নেতার কল রেকর্ড এটিই প্রমাণ করে— বিএনপিই গাড়ি পুড়িয়েছে। এই দু’টো জায়গায় নিশ্চিত হয়েই পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। গাড়ি পোড়ানোর ব্যাপারে অনেকে স্বীকার করলেও আরও অনেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা স্বীকার করেনি। তবে গাড়ি কে পুড়িয়েছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। পুলিশ আশা করছে, এখন স্বীকার না করলেও রিমান্ডের বাকি দিনগুলোতে বাকি আসামিরাও গাড়ি পোড়ানোর তথ্য স্বীকার করবেন।
এদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৫ সালের পর এই প্রথম একদিনে এত গাড়ি আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। নগরবাসী যেমন আতঙ্কিত হয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নড়েচড়ে বসেছে। একদিনে গাড়ি পোড়ানো হয়েছে শুধু তাই নয়, অভিযান অব্যাহত না রাখলে আরও নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। নাশকতা ঠেকাতে হলে বাসে আগুন দেওয়া ব্যক্তিদের যেকোনো মূল্যে গ্রেফতার করতে হবে।’
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, বিএনপির সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীদের বারবার মাঠ গরমের নির্দেশ দিয়ে আসছিলেন। তারা বলছিলেন, মাঠ গরম না করতে পারলে এই সরকারকে কোনোদিনই হটানো যাবে না। তাছাড়া সরকার পরিবর্তন না হলে তারেক রহমানকে কোনোদিনই ফেরত আনা সম্ভব হবে না। তাই দীপ্ত শপথ নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে হবে— এরকমই বার্তা দিয়ে আসছিলেন নেতারা। যার ফলে নেতাকর্মীরা ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ৯টি বাসে আগুন দিয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিনিয়র কয়েকজন নেতা গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত রয়েছেন। তাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। পরিকল্পনা করেই তারা মাঠে নেমেছে। তাদের নাশকতার পরিকল্পনা সুদুরপ্রসারী।’
বাসে আগুনের এই ঘটনায় অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের স্যাবোটিয়ার এজেন্টরা গাড়ি পুড়িয়েছে। গাড়ি পুড়িয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে দমানো যাবে না।
তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই ঘটনায় বিএনপিকেই দায়ী করেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গাড়িতে আগুন প্রমাণ করে— বিএনপি আগুন-সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে বের হতে পারেনি।
আরও পড়ুন
বাসে আগুন: ১৬ মামলায় গ্রেফতার ৪৭
ভোট ‘ডাকাতি’ আড়াল করতে বাসে আগুন: ফখরুল
শাহবাগ-মতিঝিল-গুলিস্তানসহ রাজধানীর ৮ স্থানে বাসে আগুন
বাসে আগুন প্রমাণ করে— বিএনপি সন্ত্রাস ছাড়তে পারেনি: কাদের
বাসে আগুনের পেছনে সরকারের স্যাবোটিয়ার এজেন্টস: ফখরুল
রাজধানীতে হঠাৎ ৮ বাসে আগুন: করোনার আতঙ্কের মধ্যে নাশকতার আতঙ্ক