সাইবার অপরাধে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছরের জেল, কোটি টাকা অর্থদণ্ড
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:৪১
ঢাকা: সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ, দমন এবং এসব অপরাধের বিচারে ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। বিলে চার ধরনের অপরাধকে অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। আর অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিলটি উত্থাপন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এই বিলটি পাস হয়ে আইনে পরিণত হলে তা ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে প্রতিস্থাপন করবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয় ২০১৮ সালে। আইনটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলের। বিশেষ করে আইনটি বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি বলেও সমালোচনা রয়েছে। এসব সমালোচনার মুখেই পাঁচ বছর পর সেটি প্রতিস্থাপন করতে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া করেছে সরকার। তবে নতুন এই আইনের খসড়াকে অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিচ্ছবি বলেই অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন- সংসদে সাইবার নিরাপত্তা বিল উত্থাপন
বিলটি সংসদে উত্থাপনের সময় এর বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, এটি কালো আইন হচ্ছে। এই আইনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখেননি। বিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির শুধু নামের পরিবর্তন ও কিছু ধারার পরিবর্তন-পরিমার্জন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মৌলিক যে দুর্বলতা ছিল, সেগুলো এখানে রয়েছে।
ফখরুল ইমাম আরও বলেন, বাকস্বাধীনতা, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা, বিশেষ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা— এরকম মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের মতো অনেক উপাদনই সাইবার নিরাপত্তা আইনে রয়েছে। এই বিলের খসড়াকে নিবর্তনমূলক বলে মন্তব্য করেছে টিআইবি। টিআইবি মনে করে, এই আইনও মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা হরণ করবে। এই আইনটিও কালো আইনে পরিণত হবে।
জবাবে প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অনেক সুবিধা হয়েছে। একইসঙ্গে সাইবার স্পেসে ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। ২০১২ সালে রামুতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা মিথ্যা তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে অনেক সম্পদ ও প্রাণের ক্ষতি করে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাইবার হামলা চালিয়ে হ্যাকাররা ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে যায়। এরপরে আমরা কম্পিউটার রেসপন্স টিম তৈরি করি।
আরও পড়ুন- উত্থাপন-পাসের তালিকায় ২৪বিল, নেই ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের শেষ দিকে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হলো— সেতুর পিলার শক্ত করতে নাকি শিশুদের মাথা দরকার। এর ধারাবাহিকাতয় মিরপুরে রেণু নামে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে বিলটি প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যেসব অপরাধ অজামিনযোগ্য ছিল, সেগুলো নতুন আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
পরে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিলে প্রস্তাবিত আইনের চারটি ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ ধারায় বলা হয়েছে— কোনো ব্যক্তি কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ করলে বা বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন বা বিনষ্ট বা অকার্যকর করলে বা করার চেষ্টা করলে তা অপরাধ হবে। এর মধ্যে বেআইনি প্রবেশের সাজা হিসেবে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আর বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন বা ক্ষতিসাধনের চেষ্টার জন্য ছয় বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
কোনো কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক থেকে তথ্য-উপাত্ত বা তথ্য-উপাত্তের অনুলিপি সংগ্রহ; ম্যালওয়ার বা ক্ষতিকর সফটওয়্যার প্রবেশ করানো; ইচ্ছাকৃতভাবে সিস্টেম, নেটওয়ার্ক, উপাত্ত বা উপাত্ত ভাণ্ডারের ক্ষতি করা কিংবা ক্ষতি করার চেষ্টা করা কিংবা ওই সিস্টেম বা নেটওয়ার্কের অন্য কোনো প্রোগ্রামের ক্ষতি করা বা ক্ষতি করার চেষ্টা করা; সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে অনুমোদিত ব্যক্তির প্রবেশে বাধাদান বা বাধা দেয়ার চেষ্টা; প্রেরক বা গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই পণ্য বা সেবা বিপণনের উদ্দেশ্যে স্প্যামিং; এবং কোনো সিস্টেম বা নেওটয়ার্কে কাসাজির মাধ্যমে কোনো চার্জ অন্যে হিসাবে জমা করার অপরাধগুলোকেও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। ১৯ ধারায় বর্ণিত এসব অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা, জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়াতে কোনো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেওয়ার্কে প্রবেশে বাধাদান বা বেআইনি প্রবেশ; ডিজিটাল ডিভাইসে ম্যালওয়্যার বা ক্ষতিকর কিছু প্রবেশ করানোর ফলে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু বা গুরুতর জখম হওয়া বা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়া; নিত্যপণ্যের সরবরাহ বা সেবা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বিরূপ প্রভাব বিস্তাব; এবং কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এবং বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুবিধার্থে ব্যবহার হতে পারে— এমন কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো সিস্টেমে অনুপ্রবেশকে এই বিলে সাইবার সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ২৭ ধারায় এসব অপরাধের উল্লেখ করা বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
হ্যাকিং করলে সেই অপরাধও জামিন অযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিলে। কম্পিউটারের তথ্যভাণ্ডারের কোনো তথ্যের ক্ষতি, বাতিল, পরিবর্তন বা মূল্য বা উপযোগিতা কমানো কিংবা অন্য কোনোভাবে ক্ষতি করা এবং অন্যের কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়াকৃ বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধনকে হ্যাকিং হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, এ ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধীকে অনধিক ১৪ বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ও প্রচার বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে মদত দয়ার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে অপরাধীকে।
ওয়েবসাইট কিংবা ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রচার, কাউকে হেয় করা কিংবা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, তথ্যের বিকৃতি ইত্যাদি অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনে। অন্যের পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রি, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ সাজা দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূীততে আঘাত বা উসকানির অপরাধেও দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে বিলে। আর ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানির তথ্য প্রকাশ বা প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান থাকছে এই আইনে। অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীন কোনো অপরাধ ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটিত করলে বা সহায়তা করলে তার জন্য সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত রাখার বিধান রাখা হয়েছে।
এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের জন্য পুলিশ সন্দেহভাজন এলাকা তল্লাশি করতে পারবে। তল্লাশিতে বাধাপ্রাপ্ত হলে তার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। ৪২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এরকম স্থানে যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও থাকবে পুলিশের।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ ও দমনে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা থেকে এই আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং সাইবার ঝুঁকি ও হুমকি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে দেশের সাইবার স্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-
- সাইবার নিরাপত্তা আইনে যা থাকছে
- সাইবার নিরাপত্তা আইনে অনুমোদন মন্ত্রিসভার
- ডিজিটাল নাম বদলে আসছে সাইবার নিরাপত্তা আইন
- সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিএসএর রূপান্তর না হয়: টিআইবি
- ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন না পড়েই বিএনপি নেতারা মন্তব্য করছেন’
- ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করলে মেনে নেব না’
- ৪টি ধারা অজামিনযোগ্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন
- সাইবার নিরাপত্তা আইনের সিদ্ধান্তে সাংবাদিক সমাজ চরম হতাশ: ডিআরইউ
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিল উত্থাপন সংসদ অধিবেশন সংসদে বিল সাইবার নিরাপত্তা আইন সাইবার নিরাপত্তা বিল