Tuesday 17 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বায়ুদূষণের বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত চট্টগ্রাম

আজহার মাহমুদ
৫ মে ২০২৫ ১৫:২৯

আমরা সকলেই জানি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা উপরের দিকেই থাকে। ঢাকায় যে পরিমাণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে পরিমাণ গাড়ি, কলকারখানা, বিল্ডিংসহ সব কিছু বৃদ্ধি হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন দূষণের মাত্রাও বৃদ্ধি হচ্ছে। শুধু বায়ুদূষণই নয়, সবধরনের দূষণ ঢাকায় হচ্ছে। তবে এ সমস্যাটা এখন চট্টগ্রামেও দেখা দিচ্ছে। শ্যামল প্রকৃতির এক জেলা চট্টগ্রাম। এখানেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা। সে সাথে দিন দিন দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যেভাবে শব্দদূষণ, সেভাবে বায়ুদূষণ। দেশে নিয়ম হয়েছিলো সকল গাড়ি এবং কলকারখানায় যেন কালো ধোঁয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় সব গাড়িতেই দেখা মেলে কালো ধোঁয়া। আর গাড়ি থেকে এতো পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, যা কয়েক মিনিটের জন্য রাস্তাকেও অন্ধকার করে তোলে। আর সে সময় যারা নিঃশ্বাস নিচ্ছে তাদের হচ্ছে মারাত্বক সব রোগ।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২০ বছর ধরে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ভবন-অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের নামে অবাধে সবুজ বৃক্ষরাজি ধ্বংস এবং রাতারাতি অসংখ্য খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট, একসময়ের প্রকৃতির সবুজকন্যা চট্টগ্রাম মহানগরীকে আজ দেশের ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার নগরীগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর, তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের নিচে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বছরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা আছেন অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাতাসে সিসার উপাদান বেশি থাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কারণে শিশুরা সহজেই হৃদ্রোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ভুগে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে শহরগুলোর রাস্তাঘাটে শিশুরা মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করছে, এই দৃশ্য এখন একটি সাধারণ বিষয়। রাস্তায় যেমন ধূলাবালি তেমন গাড়ী এবং কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। এথেকে বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক পরা। কিন্তু এতেও পুরোপুরি নিরাপদ নয় শিশুরা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতে মাস্ক পরলেও নিঃশ্বাসের সাথে কিছু জীবানু শরীরের ভেতর প্রবেশ করবেই। যা পরর্বতীতে ভয়ংকর হয়ে উঠে।

ফিনল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের অকালমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের মানুষ। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে স্যাটেলাইটের তথ্য, আন্তর্জাতিক তথ্যভান্ডার ও সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এই গবেষণা করা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই দূষণ রোধ করা গেলে বছরে ৫ হাজার ২৫৪টি শিশুর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। এ ছাড়া হৃদরোগে ২৯ হাজার ৯২০ জন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ২৩ হাজার ৭৫ জন, সিওপিডিতে ২০ হাজার ৯৭৬ জন, নিউমোনিয়ায় ৯ হাজার ৭২০ জন এবং ফুসফুসের ক্যানসারে ৩ হাজার ৬৩ জনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতা হাঁপানির কারণে বছরে প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার মানুষকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়। এই দূষণের কারণে বছরে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হয়। বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৯ লাখ ৪৮৫টি শিশুর অকাল জন্ম হয়। ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৯টি শিশু ওজনস্বল্পতায় ভোগে। বায়ুদূষণ না থাকলে বছরে মানুষের মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ কমবে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুুতে ক্ষতিকর বস্তুকতার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া সীমার দশগুণের বেশি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে যেসব রোগ হতে পারে, তার মধ্যে আছে হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়ুাসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট জনিত নানা রোগ, স্ট্রোক, চোখে ছানি পড়া, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। তাই এখনি বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে জাতিকে। বায়ুদূষণ মুক্ত দেশ গড়তে পারলে বাংলাদেশ অনেক উপকুত হবে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়বে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সহায়তা হবে, রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে, প্রতিবন্ধী সমস্যা কমে আসবে, অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়বে।

চট্টগ্রামেও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে যানজট। যানজটে মাধ্যমে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে বায়ু দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা, যেখানে সেখানে ইটভাটা স্থাপন, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রাম শহরকে বায়ুদূষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়েছে।

সেই সঙ্গে এই শহরে নিয়মিত নির্মাণ কাজ চলছে, যা বায়ুদূষণের আরও একটি বড় কারণ। ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় অতিরিক্ত সময় ধরে চলছে, সেগুলো অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করছে, এসবও বায়ুদূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠান্ডা করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ুদূষণ আরো বাড়ছে।

এ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ুন্ত্রণ বা ময়ুলাগুলো পুড়িয়ে ফেলা, পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা এবং কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা, এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা। এসকল বিষয় নিয়ে সকলে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হলে আমি মনে করি বায়ুদূষণ অনেকটা কমে আসবে। এছাড়াও প্রচুর বনায়ান করা উচিত আমাদের, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা নিয়মিত গাছ কর্তন করতেই ব্যস্ত।

এছাড়া বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা জরুরি, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে। নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়। এসব কাজ আমাদের নিজেদের। আমরা চাইলেই এসকল বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে পরি। কিন্তু আমরা করি না। কারণ আমরা আমাদেরকে নিয়ে সেভাবে চিন্তা-ই করি না। অন্তত নিজেকে ভালোবাসলেও নিজের পরিবেশ ভালো রাখতে হবে আমাদের। আমি আমার স্থান থেকে আমার ঘর, এলাকা দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করলেই হবে। দেখা যাবে এভাবে একদিন দেশটাও হবে দূষণমুক্ত। তবে সরকারেরও এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কঠোর আইন করতে হবে, আইন অনুযায়ী শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাজে সচতেনতা বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পেইন করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিকতা

সারাবাংলা/এএসজি

আজহার মাহমুদ চট্টগ্রাম বায়ুদূষণ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর