ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার পর ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তটি স্বস্তিদায়ক। তবে ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি চলছে, লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চলছে, তার অবসান হওয়া জরুরি।
তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনেই রাজনীতির নামে গুণ্ডাবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সংঘাত, সহিংসতাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে তাদের বাঁচাতে হবে। নিজেদের অধিকার কিংবা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা কথা বলবে, তবে তা হতে হবে দলীয় ব্যানারের বাইরে থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হওয়ার প্রবণতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা থাকে উল্লেখ করে তাদের কেউ কেউ শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষেও মত দেন।
গত সোমবার (৭ অক্টোবর) ভোরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আবরার ফাহাদের মরদেহ। জানা যায়, আগের দিন রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে তাকে তার নিজের ১০১১ নম্বর রুম থেকে ডেকে নিয়ে যান ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত— এমন অভিযোগে তার মোবাইল থেকে মেসেঞ্জার ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করা হয়। পরে মারধর করা হয়। মারধর শেষে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়লে তাকে সিঁড়িতে ফেলে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চিকিৎসকরা জানান, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আবরারের।
আবরারের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট ক্যাম্পাস। র্যাগিংসহ শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধসহ ক্যাম্পাসে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা শুরুতে সাত দফা ও পরে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করতে থাকেন। আন্দোলনের মুখে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংলাপে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু বুয়েট নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, তার লাগাম টেনে ধরার সময় এসেছে। কিন্তু বুয়েট যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা গলায় কাঁটা বিঁধে যাওয়ার পর গলা কেটে ফেলার মতো হয়েছে।’
তিনি বলেন, মূল সমস্যা জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দলগুলো নিজেদের শক্তি বাড়াতে শিক্ষার্থীদের বলপ্রয়োগের বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পছন্দমতো পদ দিচ্ছে, সেখানে মাস্তান-গুণ্ডারা স্থান পাচ্ছে। তাদের হাতে কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে, তবে তা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এখন যা হচ্ছে, তা প্রতিহিংসা ও অপকর্ম। দলের ছত্রছায়ায় থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
ঢাবি’র এই শিক্ষক বলেন, সবলেরা দুর্বলের ওপরে আক্রমণের জন্য সচেষ্ট থাকবে— এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হতে পারে না। সে পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। অপশক্তি, অপরাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আদর্শগত রাজনীতি করতে হবে।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েট তাদের ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তা রাজনীতি নয়, লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। এই লেজুড়বৃত্তি থেকে শিক্ষক-ছাত্র সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে আবরারেরা জীবন দিতেই থাকবে। আর তার দায় নিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, বুয়েট যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সময়োপযোগী। কারণ এখন রাজনীতি আর রাজনীতির জায়গায় নেই। সবখানে অপরাজনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো অনায়াসেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থেকে যেসব কাজ করে, তা মোটেই ছাত্রসুলভ নয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সহিংসতা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রকে সক্রিয় হতে হবে। তা না করতে পারলে শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় ভেঙে পড়বে।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, এখানে নির্বাচন কমিশনও ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যে আইন রয়েছে, সেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিওতে) স্পষ্ট বলা আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের সহযোগী দলগুলোর সম্পর্ক কী হবে। ফলে ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দল কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, নির্বাচন কমিশন চাইলে সে বিষয়ে আইন প্রয়োগ করতে পারে।
দেশে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ মদ-জুয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চালানো দরকার বলে মনে করছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বুয়েট যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে করে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির অবসান হবে। এ সিদ্ধান্ত দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর করা গেলে শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হবে।
ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়ে এই স্থপতি আরও বলেন, এমন নৃশংস ঘটনা প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে। বুয়েটে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে বিষয়টি সামনে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিযান চালিয়ে এ অত্যাচার বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পরিস্থিতি যাই হোক, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তকে সঙ্গত বলে মনে করছেন না বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আইন করে কিংবা বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। যদিও এখন আদর্শগত রাজনৈতিক চর্চা কোথাও হয় না, ক্ষমতার প্রয়োগ বা প্রতিহিংসাই এখন রাজনীতির মুখ্য বিষয়। তবু রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবেই। কিন্তু তাই বলে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, তা হতে পারে না। নিজেদের ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে তা হতে হবে আদর্শগত, নৈতিকতা সম্পন্ন।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত কখনো সমর্থন করেননি এবং কখনো করবেনও না বলে জানান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শিরীন আখতার। তবে ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতি চলছে সেটা বন্ধ চান তিনি।
শিরীন আখতার বলেন, রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত সমর্থন করার কিছু নেই। তবে বুয়েটের বিষয়টি কিছুটা আলাদা। নিজেদের সমস্যা সমাধানে বুয়েট কর্তৃপক্ষ যদি সাময়িকভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, সেটা তাদের ব্যাপাক। কিন্তু একেবারে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাটা কোনো সমাধান নয়। আমরা অপরাজনীতি বা রাজনীতির নামে অনৈতিক কাজ, অসাংবিধানিক কাজ কোনোভাবেই সমর্থন করি না।
জাসদ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, গত ১০ বছর রাজনৈতিকভাবে আমরা কতকগুলো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীর মতো ইস্যুতে মনোযোগ বেশি থাকার কারণে বেশকিছু বিষয়ে অবহেলা বেড়েছে। যে কারণে মাথাচাড়া দিয়েছে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাজনীতি। যে কারণে আমরা জাসদের পক্ষ থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাব এনেছি। আগামীতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেই কেবল এসব সমস্যা সমাধানের এক পথ বের করা সম্ভব।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের অস্থিরতা চলছে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ী করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে শিক্ষকেরা শিক্ষকসুলভ আচরণ করছেন না। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করছেন। তাদের ইন্ধনেই ছাত্ররা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন ধরনের লাভের আশায় তাদের হাতে কাজ করে। তাই শিক্ষকদের রাজনীতির বাইরে রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।
নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ আরও বলেন, ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকতে পারে, তবে তার মুখ্য বিষয় হবে শিক্ষার্থীদের নিজেদের অধিকার রক্ষার রাজনীতি। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে, এরকম কোনো ছাত্র রাজনীতি চাই না।
আরও পড়ুন