Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রস্তুতিতে ‘ঘাটতি নেই’, আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ


২৭ জানুয়ারি ২০২০ ২৩:২৮

ঢাকা: সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। চীন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া এই রহস্যময় ভাইরাস নিয়ে সতর্ক অবস্থানে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। আশঙ্কা রয়েছে, আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে এই ভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। দেশের বিভিন্ন স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে স্থাপন করা হয়েছে থার্মাল স্ক্যানার, আইএইচআর স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোতে জারি করা হয়েছে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, চালু করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন। বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ইউনিট চালুর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ নিয়েই এই ভাইরাস মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো নেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- চট্টগ্রামে কর্মরত চীনা নাগরিকদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া না গেলেও স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই। তবে এই ভাইরাস প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ যেসব ভূমিকা নিয়েছে, তা সময়োপযোগী। তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শও দেন তারা।

বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার

করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসানো হয়েছে থার্মাল স্ক্যানার। বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন ও আশপাশের দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং চলছে সেখানে। আলাদা করে মেডিকেল টিমও রাখা হয়েছে বিমানবন্দরে, যাত্রীদের যদি সর্দি, হাঁচি বা কোনো অন্য লক্ষণ থাকে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শাহজালালে যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানিং

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ও রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, ২৭ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্ক্যানার মেশিন ও হ্যান্ড স্ক্যানিং মেশিনের মাধ্যমে দুই হাজার ৪৭০ জন যাত্রীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এখনো দেশে কোনো করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়নি।

এছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরেও বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে।

আরও পড়ুন- চীন থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত ঢাকা

বন্দরগুলোতে মেডিকেল টিম

এদিকে, বিমানবন্দর ছাড়াও দেশের স্থলবন্দরগুলোতেও মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও সিলেটের তামাবিলসহ অন্য বন্দরগুলোতেও স্থানীয় সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে চলছে এসব বন্দর দিয়ে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিং।

হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী না পাওয়া গেলেও এরই মধ্যে দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ইউনিট খোলার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আপাতত দেশের আটটি বিভাগের সব জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ইউনিট খোলার নির্দেশনা রয়েছে। প্রয়োজনে পর্যায়ক্রমে দেশের সব হাসপাতালেই আইসোলেশন ইউনিট চালু করা হবে।

আরও পড়ুন- চীনের গোপন অস্ত্র গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস!

যাত্রীদের তথ্য সংগ্রহে হেলথ কার্ড, হটলাইন

বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর দিয়ে চীন বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি একটি করে হেলথ কার্ড দেওয়া হচ্ছে। তাদের ফোন নম্বরও সংগ্রহ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস আক্রমণ করলে ১৪ দিন পরও যেহেতু তার লক্ষণ প্রকাশ হতে পারে, তাই যাত্রীদের ১৪ দিন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ থাকলে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে (০১৯৩৭ ১১০০১১, ০১৯৩৭ ০০০০১১, ০১৯২৭ ৭১১৭৮৪, ০১৯২৭ ৭১১৭৮৫)। আবার ফোন নম্বর সংগ্রহে রেখে এসব যাত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং আইইডিসিআরও যোগাযোগ রাখছে।

আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস আতঙ্ক, চাই সতর্কতা

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) পরিচালক এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা সারাবাংলাকে বলেন, চীন ও আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের একটি করে কার্ড দেওয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ দেখা গেলে ১৪ দিনের মধ্যে তাদের আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। আর কেউ যদি আক্রান্ত হয়ে যান, তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত রি-এজেন্ট রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলছেন, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিমানবন্দরসহ স্থলবন্দরগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন স্থলবন্দরে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের হেলথ কার্ডের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে মনিটরিং করা হবে।

আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, চীন থেকে আসা প্রতিটি যাত্রীর টেলিফোন নম্বর নিয়ে তাদের কল করে নিয়মিত সবকিছু জানা হবে। কারণ এই মুহূর্তে কারও জ্বর না থাকলেও আগামী ১৪ দিনের মধ্যে যদি এই লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তাদের আইইডিসিআরের পরীক্ষার আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে আইইডিসিআরে স্যাম্পল কালেকশন ও পরীক্ষাসহ অন্যান্য কাজের জন্য একটি আলাদা রুম তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস: চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮০, আক্রান্ত তিন হাজার

‘সন্দেহজনক কেস’ নেই

আইইডিসিআরের ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এখন পর্যন্ত আইইডিসিআরে ৯ জন তাদের অসুস্থতা সম্পর্কে জানিয়েছেন। তাদের সবাইকে টেলিফোনে ভেরিফিকেশন করে দু’জনের স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, তারা সবাই সিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সন্দেহজনক কেস পাইনি।

প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই, আতঙ্ক না ছড়ানোর আহ্বান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও  প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের দেশে হবে না, এটা বলা যায় না। বিশেষ করে চীন থেকে যারা আসছে, আমাদের বন্দরগুলোতে তাদের স্ক্রিনিংয়ের বিষয়টি জোরদার করতে হবে। জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশি ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত যাত্রীদের অবশ্যই স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যা এরই মধ্যে করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- জেনে নিন, করোনাভাইরাস থেকে বিপদমুক্ত থাকবেন কীভাবে?

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, হঠাৎ করে এমন একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অনেক স্থানে। সেটা মোকাবিলায় যে প্রস্তুতি বাংলাদেশ নিয়েছে, তাকে খারাপ বলা যায় না। অন্তত শুরু তো করা হয়েছে। প্রয়োজনে বাকি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে— এটা সত্য। তবে এটা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে প্রতিরোধে কাজ করে যেতে হবে।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে নেওয়া প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোকে এখনো যথেষ্ট বলা যায়। তবে আমরা এখনো বলতে পারি না, এই রোগ কতটুকু প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। যদি আমাদের এখানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, তখনই আসলে বোঝা যাবে আমাদের প্রস্তুতি সঠিক কি না। তবু আতঙ্ক ছড়ানোটা কাজের কথা নয়।

আরও পড়ুন- উহানে করোনা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ৩শ বাংলাদেশি

বিএসএমএমইউয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, করোনাভাইরাসের কোনো রোগী যদি পাওয়া যায়, তাদের আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে হাসপাতালের সব স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সচেতন করা হবে। করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, এর উপসর্গ কী, কিভাবে চিকিৎসা দেওয়া যায়— সব বিষয় নিয়েই সেখানে বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে পর্যাপ্ত। কারণ বাংলাদেশে এখনো এই ভাইরাস প্রবেশ করেনি। তারপরও পড়ালেখা ও ব্যবসায়িক কাজে দুই দেশের মধ্যে নাগরিকদের যাতায়াতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। তাই দেশের সব বন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, যা সরকার থার্মাল স্ক্যানার স্থাপনের মাধ্যমে করেছে। এটি খুবই জরুরি ছিল।

ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্তের কথা জেনেছি। এটি আরেকটি ভালো পদক্ষেপ। কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদাভাবে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

ডা. জাহিদুর মনে করেন, যেহেতু এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করেনি, তাই এই ভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো ইতিবাচক। আর এই ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই ভাইরোলজিস্ট।

আইইডিসিআর করোনাভাইরাস থার্মাল স্ক্যানার প্রতিরোধ প্রস্তুতি বিএসএমএমইউ ভাইরাস প্রতিরোধ যাত্রী স্ক্রিনিং স্বাস্থ্য অধিদফতর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর