Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বাস্থ্য অধিদফতর ও রিজেন্টের চুক্তিতে যা ছিল


৮ জুলাই ২০২০ ১৬:২১

ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষায় নানা অনিয়ম-প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের দু’টি শাখাই বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাভাবিকভাবেই কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালটির সঙ্গে অধিদফতরের চুক্তিও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছিন্ন হয়েছে। এর মধ্যে 0নানা অনিয়মের অভিযোগে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ ১৭ জনের নামে মামলা করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সোমবার (৬ জুলাই) হাসপাতালে অভিযানের সময়ই আটজনকে আটক করা হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেদসহ বাকি ৯ জন এখনো পলাতক।

বিজ্ঞাপন

এরকম একটি পরিস্থিতিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে— আসলে কী ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর ও রিজেন্টের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে? আর হাসপাতালটি চিকিৎসার অনুমতি নিয়ে আসলে কী করছিল? দু’টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হওয়া সমঝোতা চুক্তিতে কী কী উল্লেখ ছিল— তার দালিলিক প্রমাণ সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিকিৎসা দেওয়া নিয়ে চলতি বছরের ২১ মার্চ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমঝোতা চুক্তি সই হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং রিজেন্ট হাসপাতালের পক্ষে এর চেয়ারম্যান মো. সাহেদ।

আরও পড়ুন- মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়েই রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা!

২১ মার্চ হওয়া ওই চুক্তিতে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা দেওয়ার কথা কোথাও উল্লেখ ছিল না। সেইসঙ্গে এই হাসপাতালের তিনটি আইসিইউ বেডে কোভিড-১৯ আক্রান্ত গুরুতর রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। মূলত আইসোলেশনের জন্য রিজেন্টের দুই হাসপাতালকে ব্যবহার করার কথা ভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পাশাপাশি রিজেন্টের তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি হোটেলও ব্যবহার করার কথাও উল্লেখ করা হয় চুক্তিতে।

সারাবাংলার হাতে আসা বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, মূলত রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখার ৫০টি শয্যাকে আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য চুক্তি হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে। সমঝোতা চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয়, রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুরে দুটি শাখা আছে। দুটি শাখাতেই ৫০টি করে শয্যা আছে। এই দুই হাসপাতালে আউটডোর, ইনডোর, আইসিইউ ও অপারেশন থিয়েটার আছে। এই সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতাল দুটি আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সেইসঙ্গে এই হাসপাতালের তিনটি আইসিইউ বেডকে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ব্যবহার হবে। এই হাসপাতালে ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও রেডিওলজি সার্ভিসও আছে।

বিজ্ঞাপন

সমঝোতা চুক্তির প্রথম পাতায় আরও উল্লেখ করা হয়, উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে মিলিনা নামে একটি হোটেলে ৩৬ টি কক্ষ আছে। এগুলো বিভিন্ন স্থানে সেবা দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের কোয়ারেনটাইনের জন্য ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও এই হাসপাতালের তিনটি অ্যাম্বুলেন্স স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে ব্যবহার করার কথাও উল্লেখ করা হয় চুক্তিতে।

আরও পড়ুন- প্রতারণার শেষ নেই রিজেন্টের: রক্তের নমুনা নিয়ে ইসিজি পরীক্ষা!

সমঝোতা চুক্তিনামায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ও রিজেন্ট হাসপাতালের কী কী করণীয় তাও উল্লেখ করা হয়। চুক্তিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর রিজেন্ট হাসপাতালের কারিগরি সহায়তা, মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণের কাজ করবে। সংক্রমণ প্রতিরোধের উন্নতকরণের বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। হাসপাতালের কর্মীদের আপডেট চিকিৎসা প্রটোকল জানাতে দায়বদ্ধ থাকবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেইসঙ্গে হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোর সার্ভিস, ল্যাবরেটরি এবং ইমেজিং সার্ভিস, জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া, রিপোর্টিং প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে ও অনলাইনের মাধ্যমে সাহায্য করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে হাসপাতালে কনসালটেন্ট, স্পেশালিস্ট চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট দিয়ে সহায়তা করা হয় আইসিইউ সার্ভিস ও ডায়ালাইসিস সার্ভিসে সহায়তার জন্য।

সমঝোতা চুক্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গণমাধ্যমে হাসপাতালের যেকোনো ধরণের কর্মকাণ্ড (সার্ভিস আপডেট, চলমান সার্ভিস ও মৃত্যু) বিষয়ে তথ্য দিবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। হাসপাতালে নিজস্ব জনবল ছাড়াও কারিগরি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল দেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এছাড়াও রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় প্রয়োজনীয় এসওপি ও গাইডলাইন দেওয়া ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষজ্ঞরা রেফারেল পাথওয়ে নিয়ে সাহায্য নিশ্চিত করবে।

সমঝোতা চুক্তিতে রিজেন্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে যে সকল বিষয় নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা হলো, হাসপাতালটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিল্ডিং ভাড়া দিবে। এছাড়াও বিভিন্ন ইউটিলিটিজ বিল, মেরামত খরচ ও লজিস্টিকসহ অন্যান্য বিলও রিজেন্ট হাসপাতাল দেবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে পাঠানো সাসপেক্টেড ও আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা সবধরনের সেবা নিশ্চিত করা হবে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে মেডিকেল অফিসার, নার্স, প্যারামেডিকস, ক্লিনার, ল্যাব টেকনিসিয়ান, ড্রাগ ডিসপেন্সারদের সেবা নিশ্চিত করা হবে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় জনবল স্বাস্থ্য অধিদফতর দিবে প্রতিষ্ঠানটিকে ও তাদের অধীনেই কারিগরি সহায়তা নিয়ে হাসপাতালটি পরিচালিত হবে।

আরও পড়ুন- পরীক্ষা ছাড়াই করোনার রিপোর্ট দিত রিজেন্ট হাসপাতাল

রিজেন্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে আরও যে সব বিষয় নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা হলো- প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও ইমেজিং সার্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। অন্যান্য বিভাগের লজিস্টিকস সাপোর্টও দেবে রিজেন্ট হাসপাতাল। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ল্যাভাটরি সার্ভিস ও ইন্টারনেট সার্ভিস দেওয়া হবে হাসপাতালের পক্ষ থেকে। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিভিন্ন বিষয় যেমন স্টেরিলাইজেশন, জীবাণুমুক্তকরণ, হাত ধোয়ার বিভিন্ন সামগ্রী রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেবে, যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কারিগরি সহায়তায় হবে।

এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কারিগরি সহায়তায় সামাজিকভাবে জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ভয় ভীতি ও ভুল ধারণা দূর করার কাজ রিজেন্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে করা হবে বলে উল্লেখ করা হয় সমঝোতা চুক্তিতে।

সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, কোনো দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিরূপ আবহাওয়া, সশস্ত্র সংঘর্ষ, অবরোধ কিংবা সরকারের বিধিনিষেধ, অর্থাৎ যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ এই চুক্তির দুইপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তেমন কোনো কারণে সমঝোতার শর্ত পূরণ করা না গেলে সেক্ষেত্রে কোনো জরিমানা গুনতে হবে না। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের কারণে যেসব খরচ হবে, সেগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বহন করতে হবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের জন্য সই হওয়া চুক্তি উভয়পক্ষের সম্মতিতে বাড়ানো যাবে উল্লেখ ছিল। তবে ৩০ দিনের নোটিশে যেকোনো পক্ষকে চুক্তির অবসান ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন- ‘প্রতারণা করে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল’

সমঝোতা চুক্তি সইয়ের দিন অর্থাৎ ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. মো. আমিনুল হাসানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জরুরি ভিত্তিতে করোনাজনিত জটিলতা মোকাবিলার জন্য বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালের লোকবল ও এমএসআর প্রদান প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার জন্য অনুরোধ করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাজনিত জটিলতা মোকাবিলার জন্য সচিবের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের দুটি হাসপাতাল পরিদর্শন করা হয়। প্রতিটি হাসপাতাল ৫০ শয্যার। প্রতিটিতে তিন বেডের আইসিইউ ও রোগ নির্ণয়ের সুবিধাসহ জনবল আছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংযুক্তিতে বর্ণিত তালিকা অনুযায়ী অল্প কিছু লোকবল প্রয়োজন। এমএসআর ও ডায়েটের জন্য কুর্মিটোলা হাসপাতালের বর্ধিত অংশ হিসেবে কুর্মিটোলার কোডের বিপরীতে অর্থ দেওয়া যেতে পারে, যা এর আগে মহানগর ও লালকুঠি মিরপুর হাসপাতালের জন্য করা হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এ বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি সই করেছেন।

ডা. আমিনুল হাসান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২৩ মার্চ আরেক চিঠিতে হাসপাতাল দুটিতে একজন করে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন অথবা অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের জনবল সংযুক্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর একাধিকবার এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান চলে।

আরও পড়ুন- সাহেদ ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যতবার অভিযোগ এসেছে, ততবারই আমরা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে ফোন করে জানিয়েছি। তারপরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে দেখিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চিঠি চালাচালি অনেক হয়েছে, এটা সত্যি। প্রথমদিকে আসলে এই হাসপাতালটি এগিয়ে আসায় আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়ে রাজি হই। পরে নানা অনিয়মের কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হয়।’

হাসপাতালটিকে অনুমতি দেওয়ার আগে সেখানে কেউ গিয়েছিলেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আমিনুল কোনো উত্তর দেননি।

আরও পড়ুন-

সিলগালা রিজেন্ট হাসপাতাল

রিজেন্ট হাসপাতালের ৭ জন রিমান্ডে

রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর

রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা: সাহেদের সহযোগী গ্রেফতার

কোভিড চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা: রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাবের হানা

‘রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা হবে’

রিজেন্ট কিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল হলো—জিজ্ঞাসা মন্ত্রণালয়ের

‘অপরাধ ঢাকতে নতুন কৌশল নিয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে প্রায় ৩ কোটি টাকার বিল চেয়েছিল রিজেন্ট

সংগৃহীত নমুনা ফেলে রাখা হতো রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মকর্তার কক্ষে

করোনা চিকিৎসা করোনা চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা করোনা পরীক্ষা করোনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা চুক্তি বিস্তারিত রিজেন্ট হাসপাতাল সমঝোতা চুক্তি স্বাস্থ্য অধিদফতর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর