বিজ্ঞাপন

প্রতারণার শেষ নেই রিজেন্টের: রক্তের নমুনা নিয়ে ইসিজি পরীক্ষা!

July 5, 2020 | 3:12 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: শরীরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উপসর্গ দেখা দিলে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় যোগাযোগ করেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। শরীর ভীষণ দুর্বল ছিল তার। ২৮ জুন তিনি রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনার পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। পরদিন শারীরিকভাবে ভালো বোধ করায় হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যান তিনি।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালে অবস্থানরত ঘণ্টায় তার কাছ থেকে বিল নেওয়া হয় ৫২ হাজার টাকা। এর মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল ছিল ৮ হাজার ৩০০ টাকা। বিল পেয়ে সাইফুল অবাক হয়ে খেয়াল করেন, তার কাছ থেকে কেবল রক্ত নেওয়া হলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তালিকায় ইসিজিও রয়েছে!

সাইফুল সারাবাংলাকে বলেন, ইসিজি’র বিল দেখে তো আমি অবাক। ডাক্তারকে বললাম, আমার তো ইসিজি করাননি, ইসিজি’র বিল নেওয়া হয়েছে কেন? ডাক্তারের উত্তর শুনে আমি আরও অবাক। তিনি বলেন, আপনার রক্ত তো নেওয়া হয়েছে, ওটা দিয়েই ইসিজি করা হয়েছে!

আরও পড়ুন- মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়েই রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা! 

বিজ্ঞাপন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এই ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় সরকারিভাবে যুক্ত হওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের নানা ধরনের প্রতারণার এটি একটি নমুনা মাত্র। করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা না করিয়েও ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া, কেবল হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি থাকলেও টাকা নিয়ে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ, সরকারি সমঝোতার আওতায় চিকিৎসা দিলেও রোগীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের বিল হাতিয়ে নেওয়া— এরকম নানা ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত রাজধানীর এই হাসপাতালটি।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের একটি শাখার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ছয় বছর আগে, আরেক শাখার তিন বছর আগে। হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। জানা গেছে, এসব বিষয় নিয়ে নানা অভিযোগ জমা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরেও। শেষ পর্যন্ত তাই কোভিড চিকিৎসায় সরকারের সঙ্গে রিজেন্টের সমঝোতা চুক্তিটিও বদলে যায়।

রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসার নামে কেবল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধা ছিল বলে অভিযোগ করেন ‘রক্তের নমুনা দিয়ে ইসিজি পরীক্ষার বিল’ দেওয়া সাইফুল। তিনি বলেন, যেদিন ভর্তি হতে যাই, সেদিন হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, শেষবারের মতো নিজের হাতে খেয়ে নেন। বাথরুমে যেতে চাইলে যেতে পারেন। এরপর আর নিজে নিজে এসব করতে পারবেন না। অথচ শারীরিকভাবে অতটা বেশি দুর্বলতা ছিলই না। পরে আমি যখন হাসপাতাল থেকে চলে যাই, আমাকে ফোন করে একজন জানতে চান, আমি রিজেন্টের আইসিইউতে ভর্তি আছি কি না। আমাকে আইসিইউতে ভর্তি করানোর জন্যই সম্ভবত এরকম করা হচ্ছিল। পরে রিজেন্ট থেকে যে ওষুধগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো দেখে আমার এখনকার ডাক্তার চমকে গেছেন। বলেছেন, আমাকে নাকি ওখান থেকে ভুল ওষুধ দেওয়া হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

গত মার্চে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে শুরু করে রিজেন্ট হাসপাতাল। সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই তাদের হাসপাতালে বিনামূল্যে কোভিড চিকিৎসা হওয়ার কথা। অথচ কোভিড রোগীদের বড় অঙ্কের বিল ধরিয়ে দিয়েছে হাসপাতালটি। আবার করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো খরচ নেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তারা এই খাতে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরকম অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। সারাবাংলার কাছেও বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

তাদেরই একজন মাহফুজ চৌধুরী (ছদ্মনাম)। এপ্রিলে ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান তিনি। সেখানে জানানো হয়, কোভিড পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত তারা ভর্তি করতে পারবেন না। রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় সে সুবিধা আছে বলে সেখানে যোগাযোগ করতে বলেন তারা। সেখানে গেলে মাহফুজকে জানানো হয়, ভর্তি হতে হবে। নইলে তারা নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে না। সেখানে মাহফুজের সঙ্গে ছিলেন তার মামা। মাহফুজের মায়ের পাশাপাশি মাহফুজ ও তার মামাকেও দুইটি বেড নিয়ে ভর্তি হতে বলা হয়। এরপর তাদের তিন জনের কাছ থেকেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর জন্য ২৪ হাজার টাকা নেয় তারা। তবে রিপোর্ট পাননি নমুনার। শেষ পর্যন্ত পাঁচ দিন পর তারা নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পান, কিন্তু তার তার আগেই মাহফুজের মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক খসরুজ্জামান (ছদ্মনাম)। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেলে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালে ১৩ দিন থাকতে হয়েছিল তাকে। এর মধ্যে দুই বার তার কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হলেও তার ফল মেলেনি। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার দিন তাকে ওষুধের খরচসহ ধরিয়ে দেওয়া হয় দুই লাখ ৪৭০০ টাকার বিল। রশিদ ছাড়াই আরও ৩০ হাজার টাকা দিতে বলা হয় তাকে।

বিজ্ঞাপন

ওই বিলের কপিতে দেখা যায়, হাসপাতালে আইসিইউ বেডে থাকা বাবদ আট হাজার টাকা করে তিন দিনের বিল ২৪ হাজার টাকা। এর সঙ্গে চার হাজার ৫০০ টাকা করে ১০ দিনের থাকার বিল করা হয় ৪৫ হাজার টাকা। এছাড়াও অক্সিজেনের বিল বাবদ ২১ হাজার ৬০০ টাকা ও মনিটরিং বাবদ ১০ হাজার ৪০০ টাকা ধরা হয় বিলে। কোভিড মেডিসিন নামে ৪০০ টাকা করে একটি ওষুধ ৪০টি খাওয়ানো হয়েছে উল্লেখ করে বিল ধরা হয় ১৬ হাজার টাকা। এছাড়াও কনসালট্যান্ট ফি হিসেবে ৩০ হাজার টাকা (২০০০ টাকা করে ১৫ বার) ও দায়িত্বরত চিকিৎসকের খরচ হিসেবে ১৩ হাজার টাকা (প্রতিদিন এক হাজার টাকা) বিল করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার জন্য ১৫ হাজার ৫০০ টাকা ও সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১৭ হাজার ২২৫ টাকা বিল দেখানো হয়।

খসরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ওখানে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে ওষুধ ছিল। আর সব ওষুধ বাসা থেকেই কিনে দেওয়া হতো। তাই ওষুধের বিল কেন করা হলো, বুঝিনি। আমাকে একবেলার জন্যও আইসিইউতে নিতে হয়নি, অক্সিজেনও দিতে হয়নি। তাই এই বিলগুলো দেখে আমি অবাক হই। কোভিড মেডিসিন লিখলেও এমন কোনো ওষুধই আমাকে খাওয়ানো হয়নি। নমুনা পরীক্ষার কথা বলা হলেও আদৌ কী নমুনা পরীক্ষা করেছে, সে বিষয়েও কিছু জানানো হয়নি। এখনো আমি আসলে জানিই না আমার রিপোর্টের কী হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এসব বিষয়ে কথা বললে তারা আমার বিল কিছু কমানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু তাদের এমডি আমার সঙ্গে খুবই বাজে ব্যবহার করেন। এ সময় সেখানে ডা. মো. আবু বকর সিদ্দিকী নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি আমাকে তার ফোন নম্বর দেন নমুনা পরীক্ষার ফল জানিয়ে দেওয়ার জন্য। এর পর তিনি আর কখনো আমার ফোন ধরেননি।

এই ভুক্তভোগী বলেন, আমি জানতাম রিজেন্ট হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়। কিন্তু এই হাসপাতালে গিয়ে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। আমার খাবার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হতো, যেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভালো চোখে দেখত না। হয়তো খাবার বাবদ আরও কিছু বিল করতে পারেনি বলেই তারা বাসা থেকে খাবার নিয়ে যাওয়ায় অসন্তুষ্ট ছিল। আমরা চাই এমন প্রতারকদের বিচার হোক।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. আমিনুল হাসান জানান, দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর বেসরকারি হাসপাতালগুলো এগিয়ে আসেনি তেমন একটা। এ পরিস্থিতিতে ওই সময় রিজেন্ট হাসপাতাল কোভিডের চিকিৎসা দিতে আগ্রহী হলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়, তারা কোভিডের চিকিৎসা দিতে শুরু করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের অনিয়মের অভিযোগ এসেছে অধিদফতরে।

ডা. আমিনুল আরও বলেন, আমাদের কাছে যতবার অভিযোগ এসেছে, ততবারই আমরা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে ফোন করে জানিয়েছি। তারপরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে দেখিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চিঠি চালাচালি অনেক হয়েছে, এটা সত্যি। প্রথমদিকে আসলে এই হাসপাতালটি এগিয়ে আসায় আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়ে রাজি হই। পরে নানা অনিয়মের কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হয়।

এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘কোন রোগীর কাছ থেকে বিল নেওয়া হয়েছে? আমাকে দেখি একটু বলেন।’ অক্সিজেনসহ বিভিন্ন সময়ে রোগীদের কাছ থেকে বিল রাখা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো তো আমাদের কিনতে হয়েছে। এগুলো কি আমাদের কেউ ফ্রি দিয়েছে?’

সরকারি সাহায্য পাওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসক আমি কোনোদিনই পাইনি। একদিনের জন্য চিকিৎসক দিয়েছিল, তারপর আর কোনোকিছু পাইনি।

নমুনা সংগ্রহ বিষয়ে মো. সাহেদ বলেন, ‘আমরা কখনো নমুনা সংগ্রহ করি না। এ বিষয়ে আমরা বারবার আমাদের ফেসবুক পেজ ও বিভিন্নভাবে সতর্ক করে আসছি। আমরা বারবার বলেছি, রিজেন্টের নামে একটি ভুয়া চক্র কাজ করছে। তাদের বিষয়ে কিন্তু আমরা বারবার বলেছি। এগুলো নিয়ে আমরা প্রেস রিলিজ দিয়েছি। আর আমাদের যেসব স্যাম্পল, সেগুলো আমরা নিপসমে জমা দিয়েছি।’

কোভিড-১৯ স্যাম্পল নিয়ে ভুয়া সনদ দেওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কে বলেছে? কবে দিয়েছে? আমাকে সেগুলোর প্রমাণ দেন regenthospitallimited@gmail.com মেইল আইডিতে।’

দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা ও করোনা চিকিৎসা নিয়ে বেশকিছু চক্রের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায়। এরকমই একটি প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট হাসপাতাল। নমুনা পরীক্ষা ও করোনা চিকিৎসাসহ চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সেরই মেয়াদ নেই! সারাবাংলার অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগই উঠে এসেছে, যার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা নিয়ে পড়ুন সারাবাংলার তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব

সারাবাংলা/এইচআর/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন