বিজ্ঞাপন

পরীক্ষা ছাড়াই করোনার রিপোর্ট দিত রিজেন্ট হাসপাতাল

July 5, 2020 | 8:58 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম) করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে চান। তার পরিবারেরও কয়েকজনের একই ধরনের উপসর্গ ছিল। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। গত ২৭ জুন হাসপাতাল থেকে তারিক শিবলি নামে একজন ব্যক্তি সাইফুলদের বাসায় যান নমুনা সংগ্রহ করতে। ছয় জনের নমুনা নিয়ে ফি হিসেবে ২৭ হাজার টাকা বুঝে নেন তিনি। এসময় কোনো কাগজ না দিলেও নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে আসেন তারিক শিবলি।

বিজ্ঞাপন

২৯ জুনই নমুনা পরীক্ষার ফল পান সাইফুল ইসলাম। Covid.test09@gmail.com ইমেইল ঠিকানা থেকে যায় রিপোর্ট, সেটি ছিল রাজধানীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিউটের (আইপিএইচ) প্যাডে। মেইলে নমুনা সংগ্রহের সাইট হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতাল ও রেফার্ড বাই রিজেন্ট হাসপাতাল লেখা ছিল। নমুনা পরীক্ষায় ছয় জনের মধ্যে দু’জন পজিটিভ ও চার জন নেগেটিভ আসেন। রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ জানালে ৩ জুলাই ফের তাদের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হয়। এবার তাদের নমুনা পরীক্ষার ফল আসে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিনের (নিপসম) ওয়েবসাইটে। তবে এবারের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে চার জন পজিটিভ ও দু’জন নেগেটিভ আসেন। এই চার জনই আবার আগের রিপোর্টে নেগেটিভ ছিলেন! শুধু তাই নয়, নিপসমে এই ছয় জনের নমুনা সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই দেখানো হলেও ওই দিন সাইফুল বা তার পরিবারের কারও কাছ থেকেই কোনো নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি।

আরও পড়ুন- মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়েই রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা!

প্রায় একই অভিযোগ করেন রাজধানীর আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের আরেকজন কর্মকর্তা। তার বাসায় গিয়ে আট জনের নমুনা পরীক্ষা বাবদ ৪০ হাজার টাকা ফি নেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের জনসংযোগ কর্মকর্তা তারিক শিবলি। আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের ওই কর্মকর্তাকেও আইপিএইচের প্যাডেই নমুনা পরীক্ষার ফলাফল জানানো হয়।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, আরও একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা রিজেন্ট হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে এলেও এখনো কোনো রিপোর্ট পাননি। তাদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফি নেওয়া হলেও কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি।

এরকম ভুক্তভোগী আরও অনেকেই আছেন, যারা রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা নিয়ে নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল আসলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নাম করে করোনা পরীক্ষার ভুয়া ফল দিত। সারাবাংলার অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে, রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করলেও সেগুলো পরীক্ষা না করিয়েই রিপোট ধরিয়ে দিত।

আরও পড়ুন- প্রতারণার শেষ নেই রিজেন্টের: রক্তের নমুনা নিয়ে ইসিজি পরীক্ষা!

বিজ্ঞাপন

করোনা নমুনা পরীক্ষা ছাড়াও রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-প্রতারণার অভিযোগ উঠে এসেছে সারাবাংলার অনুসন্ধানে। জানা গেছে, হাসপাতাল পরিচালনার লাইসেন্সের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে তাদের। তারপরও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে করোনা চিকিৎসা দিতে শুরু করে তারা। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা চললেও রোগীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কেবল হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করানোর কথা থাকলেও তারা অনুমতি ছাড়াই বাসায় নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইফুলকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে নমুনা পরীক্ষার ফল জানানো হয় যে সনদ ব্যবহার করে, তার একটিতে প্রতিষ্ঠানটি ল্যাব আইডি ব্যবহার করে IPH 053770 নম্বরটি। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিউটে ৫৩ হাজার ৭৭০ নম্বর নমুনা ছিল সেটি। অথচ জুনের ওই সময়ে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৪৫ হাজার।

শুধু তাই নয়, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা এমন কোনো সনদ দেননি কাউকে। ২৩ মে তারিখের পর থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের কোনো নমুনাও পরীক্ষা করেননি তারা।

আইপিএইচের ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্টের সই করা সনত বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ডা. মাহবুবা জামিল সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এ ধরনের কোনো সনদ দেইনি। তারা আমাদের এখানে নমুনা পরীক্ষাই করায়নি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা কখনো নমুনা সংগ্রহ করি না। এ বিষয়ে আমরা বারবার আমাদের ফেসবুক পেজ ও বিভিন্নভাবে সতর্ক করে আসছি। আমরা বারবার বলেছি, রিজেন্টের নামে একটি ভুয়া চক্র কাজ করছে। এগুলো নিয়ে আমরা প্রেস রিলিজ দিয়েছি। আর আমাদের যেসব স্যাম্পল, সেগুলো আমরা নিপসমে জমা দিয়েছি।

তবে সারাবাংলার পক্ষ থেকে সাইফুল ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তারিক শিবলির ছবি দেখানো হলে তারা তাকে রিজেন্ট হাসপাতালের নমুনা সংগ্রহকারী হিসেবে শনাক্ত করেন। তারা জানান, তারিক শিবলি একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। টাকা নেওয়ার কোনো রশিদ না দিলেও তারা তার মোবাইল নম্বর সরবরাহ করেন যোগাযোগের জন্য।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের দুইটি শাখায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের ২৫টি করে মোট ৫০টি নমুনা জমা দেওয়ার কথা ছিল নিপসমে। কিন্তু বাসায় গিয়ে তাদের নমুনা সংগ্রহের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর হাসপাতালে যদি নমুনা সংগ্রহ করে, তবে সেক্ষেত্রেও তারা বিল নিতে পারবে না। কারণ তাদের নমুনা পরীক্ষা সরকারিভাবে বিনামূল্যে করানো হচ্ছিল।

দেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা ও করোনা চিকিৎসা নিয়ে বেশকিছু চক্রের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায়। এরকমই একটি প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট হাসপাতাল। নমুনা পরীক্ষা ও করোনা চিকিৎসাসহ চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সেরই মেয়াদ নেই! সারাবাংলার অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগই উঠে এসেছে, যার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা নিয়ে পড়ুন সারাবাংলার তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব

সারাবাংলা/এইচআর/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন