রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি: অভিযোগের আঙুল অধিদফতরের পরিচালকের দিকে
১২ জুলাই ২০২০ ১৬:৩২
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায় নানামুখী অনিয়ম-প্রতারণার অভিযোগে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। মার্চ মাস থেকে হাসপাতালটি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করে। অথচ হাসপাতালের একটি শাখার লাইসেন্সের মেয়াদ তিন বছর আগে এবং আরেকটি শাখার লাইসেন্সের মেয়াদ ছয় বছর আগে শেষ হয়েছে! অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকার বিষয়টি জানার পরও হাসপাতালটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে। তাছাড়া কোভিড চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার আগে হাসপাতালটি পরিদর্শন কিংবা মতামত যাচাইয়ের কিছুই করা হয়নি। আবার হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ এলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। আর রিজেন্টকে ঘিরে অধিদফতরের এসব অনিয়ম নিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠেছে অধিদফতরের একজন পরিচালকের বিরুদ্ধেই!
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র বলছে, হাসপাতাল পরিদর্শন ও যাচাই-বাছাই না করেই রিজেন্ট হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য মনোনীত করা হয় অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানের পরামর্শে। রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়ম বিষয়ে দুই চিকিৎসকের অভিযোগের পরও তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। অন্যান্য কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে দায় এড়িয়ে চললেও রিজেন্ট হাসপাতালকে বরাবরই বিশেষ সুবিধা দিয়ে গেছেন তিনি। এছাড়াও সরকারি কাজে বিল জমা দেওয়ার সময় আনুষাঙ্গিক খরচের কাগজপত্র যোগ করলেও রিজেন্ট হাসপাতালের বিলে তেমন কিছু না থাকার পরেও সেটার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি ডা. আমিনুল।
আরও পড়ুন- মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়েই রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা!
সবশেষ রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর অনিয়ম-প্রতারণার সব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অধিদফতর। তবে পরিচালক আমিনুল হাসানের সই করা এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিকেও অধিদফতরের অনেকেই বলছেন দায়সারা। এছাড়া একই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে অধিদফতরের চুক্তি বাতিলের বিজ্ঞপ্তিও দেওয়ার কথা ছিল। তবে এ বিষয়টি রিজেন্টকে কেবল মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়েছিল।
এর আগে, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমঝোতা চুক্তি সই হয় গত ২১ মার্চ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, চুক্তির আগে হাসপাতাল পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি বিশেষ দল। তারা হাসপাতালটিকে নিয়ে তাদের কিছু অভিযোগ জানায়। একইসঙ্গে দেশের কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানও এই প্রতিষ্ঠান বিষয়ে অভিযোগ জানায়। কিন্তু সেসব অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।
এর কারণ অনুসন্ধান করলে অধিদফতরের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এই সমঝোতা চুক্তির পেছনে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার অনুরোধ। জানা গেছে, চুক্তির আগে আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কক্ষে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। ওই সময় উপস্থিত হন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ। সেখানে উপস্থিত ডা. আমিনুল হাসান তখন জানান, রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার মান ভালো।
আরও পড়ুন- প্রতারণার শেষ নেই রিজেন্টের: রক্তের নমুনা নিয়ে ইসিজি পরীক্ষা!
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের দুই শাখার মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সের বিষয়ে কিছুই অধিদফতরকে জানাননি এই পরিচালক। উল্টো তিনি জানান, এই হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য ‘ওপর মহলে’র নির্দেশনা আছে। এ কারণে হাসপাতাল পরিদর্শন করতে যাওয়া দলের বা সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের রিজেন্ট হাসপাতাল নিয়ে করা তদন্ত রিপোর্টও পর্যালোচনা করা হয়নি।
হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করা না থাকলেও রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি কিভাবে করা হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আমিনুল সারাবাংলাকে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তাদের কাগজপত্র আপডেট করার বিষয়েও জানানো হয়েছে। তবে তাদের কাগজপত্র আপডেট হয়নি।
২১ মার্চ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ডা. আমিনুলের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জরুরিভিত্তিতে করোনাজনিত জটিলতা মোকাবিলার জন্য বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালের লোকবল ও এমএসআর প্রদান প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনার জন্য অনুরোধ করা হয়। এতে জানানো হয়, করোনাজনিত জটিলতা মোকাবিলার জন্য সচিবের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের দুইটি শাখা পরিদর্শন করা হয়। প্রতিটি হাসপাতাল ৫০ শয্যার। প্রতিটিতে তিন বেডের আইসিইউ ও রোগ নির্ণয়ের সুবিধাসহ জনবল আছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংযুক্তিতে বর্ণিত তালিকা অনুযায়ী অল্প কিছু লোকবল প্রয়োজন। অথচ ওই সময় কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালেও পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করা যায়নি।
আরও পড়ুন- পরীক্ষা ছাড়াই করোনার রিপোর্ট দিত রিজেন্ট হাসপাতাল
এদিকে, ৩০ এপ্রিল অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালককে লেখা চিঠিতে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ জানান, তার হাসপাতালের রোগী, রোগীর চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের খাবারের খরচ বহন করা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে তিনি সরকারের পক্ষ থেকে সবার খাবারের খরচ বহন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন চিঠিতে। আট দিন পর ৯ মে অধিদফতরের পরিচালক ডা. আমিনুল রিজেন্টের দুই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করার সুপারিশ করেন। একইসঙ্গে বিষয়টি বিবেচনার জন্য সমঝোতা চুক্তি পরিবর্তন করে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ করেন তিনি।
এরপর ১২ মে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান অন্য এক চিঠিতে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন। চিঠিতে লিখেন, সরকারের পক্ষ থেকে ১১ জন ডাক্তার ও ৯ জন নার্স পেয়েছেন। আইসিইউ বা ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের জন্য আরও ২০ জন ডাক্তার ও ৩৯তম বিসিএসে সদ্য যোগ দেওয়া মেডিক্যাল অফিসারদের মধ্যে থেকে ১৫ জন মেডিক্যাল অফিসার প্রয়োজন। আরও ১৫ জন নার্স প্রয়োজন।
এর চার দিন পর ১৬ মে অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) বরাবর লেখা এক চিঠিতে সরকারিভাবে পাঠানো চিকিৎসকদের হাসপাতাল থেকে প্রত্যাহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন মো. সাহেদ।
আরও পড়ুন- ‘প্রতারণা করে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল’
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগের দিন, অর্থাৎ ১৫ মে রিজেন্ট হাসপাতালে নিযুক্ত দুই চিকিৎসক হাসপাতালটির নানা অনিয়ম-ত্রুটি বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দেন। তারা হাসপাতালে থাকা চারটি আইসিইউতে ত্রুটিপূর্ণ সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা ও তিনটি ভেন্টিলেটর থাকার কথা জানান। এছাড়াও আইসিইউতে দক্ষ জনবল না থাকা ও জরুরি কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না থাকার কথাও জানান তারা। ওষুধ ও সুরক্ষা সামগ্রীর ঘাটতির বিষয়েও জানানো হয় চিঠিতে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ও জনবল না পাওয়ার বিষয়ে হাসপাতাল চেয়ারম্যানকে জানানো হলে তিনি চিকিৎসককে হুমকি ও ভয় দেখানোর কথা উল্লেখ করে বাজে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করেন চিকিৎসকরা। দুই চিকিৎসকের এমন অভিযোগ পাওয়ার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
১৬ মে পর্যন্ত রিজেন্ট হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসক নিযুক্ত থাকলেও বিভিন্ন সময় রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসা করানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে ১ জুন রিজেন্ট হাসপাতাল চেয়ারম্যান মো. সাহেদের সই করা এক চিঠিতে হাসপাতালের উত্তরা শাখাকে ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও মিরপুর শাখাকে এক কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে অনুরোধ করা হয়। হাসপাতালের দুই শাখার মাসিক খরচ হিসেবে উল্লেখ করা হয় টাকার এই অঙ্ককে। এসময় সমঝোতা স্মারক সংশোধন করে আগের সমঝোতার তারিখ থেকে এই খরচ রিজেন্ট হাসপাতালকে দিতে অনুরোধ করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্রগুলো বলছে, সরকারি কাজে বিল চাইলে তার সঙ্গে দিতে হয় আনুষাঙ্গিক খরচের কাগজপত্র। কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতালের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিতে কোনোবারই এমন কিছু দেওয়া হয়নি। প্রতিটি চিঠিতে সমঝোতা চুক্তি পরিবর্তনের কথা বলা হলেও এর আসলে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ বিষয়ে ডা. আমিনুল হাসান তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও কিছু জানাননি।
আরও পড়ুন- রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান ৫ জুলাই সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের কাছে যতবার অভিযোগ এসেছে, ততবারই আমরা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে ফোন করে জানিয়েছি। তারপরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে দেখিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চিঠি চালাচালি অনেক হয়েছে, এটা সত্যি। প্রথমদিকে আসলে এই হাসপাতালটি এগিয়ে আসায় আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়ে রাজি হই। পরে নানা অনিয়মের কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হয়।
মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, হাসপাতালটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। এ বিষয়ে তাদের আমরা জানিয়েছি। কিন্তু কোনোবারই তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি।’ লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল কিভাবে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বরাদ্ধ পেলো— এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
রিজেন্ট হাসপাতল প্রায় তিন কোটি টাকা বিল জমা দেওয়া বিষয়ে ডা. আমিনুল বলেন, তারা আমাদের কাছে বিল চেয়েছে, কিন্তু আমরা তো আর দেইনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আমরা আমাদের চিকিৎসকদের প্রত্যাহার করে নেই। তবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা চুক্তিতে কী ছিল, তা নিয়েও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হন নি ডা.আমিনুল হাসান।
আরও পড়ুন- স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে প্রায় ৩ কোটি টাকার বিল চেয়েছিল রিজেন্ট
রিজেন্ট হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে বিল নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে জুন মাসে এ বিষয়ে একাধিকবার পরিচালক ডা. আমিনুলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আর কোনো চুক্তি নেই। তারা বিল নিয়েই চিকিৎসা করাতে পারবে।’ অথচ ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের আগ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি বাতিল করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। অভিযানের পরদিন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির দুই শাখার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক সর্বোচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা যায়, পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান কখনোই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাউকেই রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকার বিষয়ে অবহিত করেননি। বরং রিজেন্ট হাসপাতাল প্রসঙ্গে কথা উঠলেই তিনি ‘‘ওপরের নির্দেশ’ বলে অনেক কিছুই পাশ কাটিয়ে যেতেন। অভিযোগ আছে, এ বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ‘ব্যাক ডেট’ দিয়ে দুইটি চিঠি ইস্যু করেছিলেন ডা. আমিনুল। তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সমঝোতা চুক্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আসলে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। তবে এই হাসপাতাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। হাসপাতালের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও ২১ মার্চের আগে কখনোই আমার দেখা হয়নি। চিনতামও না তাকে।
লাইসেন্স না থাকা একটি হাসপাতালের সঙ্গে অধিদফতরের চুক্তি কিভাবে হয়— এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি মহাপরিচালক।
আরও পড়ুন- সংগৃহীত নমুনা ফেলে রাখা হতো রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মকর্তার কক্ষে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা অবহিত করেছিলেন পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানকে। কিন্তু তিনি এসব অভিযোগকে আমলে নেননি। ১৯ মে পর্যন্ত নিপসমে রিজেন্ট হাসপাতালের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও পরবর্তী সময়ে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালের নমুনা পরীক্ষা বেসরকারি ল্যাবে করার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ বিভিন্ন ধরনের ‘প্রভাব’ দেখিয়ে সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বহাল রাখার চেষ্টা করেন। পরে আবার ডা. আমিনুলও ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে’র কথা বলে রিজেন্ট হাসপাতালের নমুনা পরীক্ষা করানোর অনুমতি দেওয়ার আবেদন জানান। ডা. আমিনুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই রিজেন্টের দুই শাখার জন্য ৫০টি করে নমুনা নিপমসে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয় অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সই করা চিঠিতে।
এ বিষয়ে ৮ জুলাইয়ের পর থেকে ডা. নাসিমার নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে গত ৪ জুলাই ডা. নাসিমা সারাবাংলাকে বলেছিলেন, রিজেন্টের নমুনা পরীক্ষা বিষয়ে আমাদের কাছে একাধিকবার অভিযোগ এসেছে। আমরা তাদের নমুনা পরীক্ষা বন্ধও করে দিয়েছিলাম। পরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কথা বিবেচনা করে দুই হাসপাতাল থেকে ২৫টি করে ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করানোর অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু লাইসেন্স না থাকা বা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আসলে আমাদের জানা নেই। কারণ সেগুলো মনিটরিং করার জন্য আলাদা বিভাগ আছে আমাদের।
রিজেন্ট হাসপাতাল বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা জানার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) মো. মহিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি। ফোন ধরেননি মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও।
আরও পড়ুন- ‘অপরাধ ঢাকতে নতুন কৌশল নিয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ’
এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ঠিক আছে কি না, হাসপাতালের লাইসেন্স ও চিকিৎসাসেবা ঠিক দেওয়া হচ্ছে কি না— এসব বিষয় নজরদারি করা। এসব কিছুই যদি না হয়ে থাকে, বুঝতে হবে— ওই বিভাগের কর্মকর্তা কোনো কাজ করছেন না। ‘ওপরের মহলের নির্দেশ’ শব্দ কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তার চাকরির প্রথম কয়েকটি শর্তের একটি হলো কোনো অনৈতিক কাজ করবেন না ও সমর্থনও করবেন না। রিজেন্ট হাসপাতালের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তার কোনো ক্ষেত্রেই আমরা কোনো নৈতিকতা দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, রিজেন্টের ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তাই দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ হিসেবে হাসপাতাল পরিচালকের দায় বেশি। এক্ষেত্রে যদি কেউ বলে ‘ওপরের নির্দেশ’, তবে তাকে তার প্রমাণ দেওয়া উচিত। অথবা তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর যেহেতু কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই কোভিড চিকিৎসার অনুমতি থেকে শুরু করে সব ধরনের সহায়তা রিজেন্টকে করা হয়েছে, তাই সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক হিসেবে হাসপাতাল পরিচালকের ভূমিকা নিশ্চয় বেশি।
আরও পড়ুন-
রিজেন্ট হাসপাতালের ৭ জন রিমান্ডে
‘রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে’
রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা: সাহেদের সহযোগী গ্রেফতার
রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা: সাহেদের সহযোগী শিবলী রিমান্ডে
কোভিড চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা: রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের হানা
রিজেন্ট কিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল হলো—জিজ্ঞাসা মন্ত্রণালয়ের
‘রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা হবে’
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের বাবা মারা গেলেন করোনায়
করোনা চিকিৎসায় অনিয়ম করোনা চিকিৎসায় প্রতারণা করোনা পরীক্ষায় প্রতারণা টপ নিউজ ডা. আমিনুল হাসান মো. সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতাল রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক