Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাহসে ভর করে সমৃদ্ধির পথে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৫ জুন ২০২২ ২২:২২

ঢাকা: ২০০৯ সাল। দেশের বাজেট তখন মাত্র ১ লাখ কোটি টাকার অঙ্ক স্পর্শ করছে। এমন সময়ে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দেশের জন্য সব অর্থেই মেগা একটি প্রকল্প। তবে দেশের ২১টি জেলা যেখানে বাকি অংশের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, তখন সেই বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে যোগাযোগের পথ তৈরির প্রকল্পটি সার্বিকভাবেই ছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত। পদ্মা সেতু নামের সেই প্রকল্পটি তখনো বাস্তবতা বিবেচনায় স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের সারথী হলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে সেতু ছিল সুদূর কল্পনা, সেই সেতুকে বাস্তবতায় হাজির করার স্বপ্ন দেখালেন।

বিজ্ঞাপন

পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। সেতুর সমীক্ষা হলো, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রকল্প পাস হলো। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে হলো ঋণচুক্তি। তারপর আচমকা দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগে সরে দাঁড়াল বিশ্বব্যাংক। সেতু সচিবের দায়িত্বে থাকা মোশাররফ হোসেনকে যেতে হলো কারাগারে। মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আবুল হোসেনকে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানের দিকেও উঠল অভিযোগের আঙুল। দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের তখন স্বপ্নভঙ্গের উপক্রম। কিন্তু সেই স্বপ্নের পালে নতুন হাওয়া জোগালেন সেই শেখ হাসিনা। সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন— কোনো সহায়তার প্রয়োজন হবে না, নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে পদ্মা সেতু!

বিজ্ঞাপন

স্বল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশের জন্য সে এক অসীম সাহসী সিদ্ধান্ত। তা নিয়ে নানা মহল থেকে সমালোচনা হলো অনেক। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও জানালেন, এ অসম্ভব। যে বাংলাদেশকে তখনো বেশিরভাগ কাজের জন্যই নির্ভর করতে হচ্ছিল বিদেশি অর্থায়ন কিংবা সহযোগী সংস্থাগুলোর ঋণের ওপর, তখন সত্যি সত্যিই তো পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করাটা অসম্ভবেরই সামিল ছিল।

আরও পড়ুন- পদ্মা সেতুর উদ্বোধন

সবার মধ্যে তাই পদ্মা সেতু নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে একজন টললেন না। তিনি শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংক যখন ভুল বুঝতে পেরে ফের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এগিয়ে এসেছিল, সেই আহ্বানেও সাড়া দেননি তিনি। অসম সাহসিকতা নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থেকে বললেন— নিজেদের টাকাতেই হবে স্বপ্নের সেতু।

এক দশক পরে এসে সেই সেতুর দুয়ার এখন উন্মুক্ত। যে স্বপ্ন দেখতে অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। যার হাত ধরে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা, সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধন করলেন পদ্মা সেতু। তবে ইতিহাস ভুলে যাননি তিনি। সমালোচনা করলেও পদ্মা সেতুর বিরোধিতা যারা করেছে, তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উদ্বোধনের উৎসবে সামিল হতে। শুধু তাই নয়, আবুল হোসেন, মসিউর রহমান ও মোশাররফ হোসেন— পদ্মা সেতু ঘিরে যাদের অপবাদের গঞ্জনা সইতে হয়েছে, তাদের পাশে নিয়েই উদ্বোধন করলেন স্বপ্নের সেই সেতু।

আরও পড়ুন-

পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, এত ঘটনাচক্র পেরিয়ে নির্মিত এই সেতু তাই নিছক একটি সেতু নয়, এটি বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। এই সেতু বাঙালির গর্ব। এই সেতু সব অপমানের জবাব। এই সেতু আত্মনির্ভরশীল একটি বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনার দ্বার নিয়ে যাত্রা শুরু হলো এই পদ্মা সেতুর। আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পদ্মা নদীর তীরে ফেরি কিংবা লঞ্চের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে লাখো মানুষকে, সড়কপথে সেই পদ্মার দূরত্ব এখন তাদের কাছে নেমে এসেছে মাত্র ৬ মিনিটে। বৈরী আবহাওয়া কিংবা যানবাহনের চাপে যেখানে আগে ঘাটে নিয়মিতই বসে থাকতে হয়েছে ১০/১২ ঘণ্টা, সেই অপেক্ষার পালা এবার ঘুচে গেল। অ্যাম্বুলেন্সে অসুস্থ রোগীর সঙ্গের স্বজনদের এখন আর আগের মতো উৎকণ্ঠার প্রহর গুনতে হবে না— কখন আসবে ফেরি। প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায় থাকা পরিবারের সদস্যদেরও অপেক্ষার প্রহর আর দীর্ঘায়িত হবে না আগের মতো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে পদ্মা সেতুকে জাতির সক্ষমতা, গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে অভিহিত করেন

যোগাযোগের এই সুবিধার সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সবজি, ফল ও ফসলের চালান ফেরি ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে, এমন নজির কম নেই। মাছের মতো পণ্য ঘাটেই ফেলে দিতে হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে নিয়মিতই। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পদ্মা সেতু এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসবে, তা বলাই বাহুল্য।

পদ্মা সেতু ঘিরে এরই মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্প পার্কের কারণে কর্মসংস্থান তৈরিসহ এই এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন-

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতুর প্রভাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর দক্ষিণাঞ্চলের জন্য এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, বছরে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমাতে ভূমিকা রাখতে এই সেতু। একটি গবেষণার তথ্যও বলছে, পদ্মা সেতুর কারণে বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১ দশমিক শূন্য চার শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সে হিসাবে বছরে দুই লাখ হিসাবে আগামী পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান হবে ১০ লাখ মানুষের। ১০ বছর পর এই সংখ্যা তিন গুণ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ অঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে এসেছে।

মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার একপাশে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আরেক পাশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম

তিনি বলেন, দক্ষিণ বাংলার কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা খুব সহজে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার আগেই এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে।

যোগাযোগ সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ ও বাণিজ্য সংযোগ— এই ত্রিমুখী সংযোগের সার্থক সমন্বয় করতে সক্ষম হলে পদ্মা সেতু আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডরের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ— এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতু আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। জাতীয় আত্মমর্যাদার এই ব্যতিক্রমী মাইলফলক দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধাকে দূর করবে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর মুহূর্তেই আলোকজ্জ্বল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে গোটা এলাকা

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীও উপ-আঞ্চলিক সংযোগে পদ্মা সেতুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই পদ্মা সেতু স্পষ্টতই বাংলাদেশ ও আমাদের এই উপঅঞ্চলের মধ্যে সংযোগ বাড়াবে। আমরাও এই সম্ভাবনায় অত্যন্ত আনন্দিত। আমি এ অঞ্চলে আরও অনেক বেশি বাণিজ্য এবং ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সহজে যোগাযোগ ও ভ্রমণের সুযোগ দেখতে চাই।

পদ্মা সেতুর সুফল যেন দ্রুতই বাংলাদেশ পেতে পারে, তার জন্য এখন থেকেই সুষ্ঠু পরিকল্পনার তাগিদ দেন আতিউর রহমান। বলেন, সেতুটি চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলায় শিল্পকারখানা স্থাপনে আরও বেশি করে উৎসাহী হবেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। তাদের যেন বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি পেতে কোনো অসুবিধা না হয়, তা এখন থেকেই দেখতে হবে। করোনাকালে এসএমই খাতে যেভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা হয়েছিল, সে রকম বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ দক্ষিণ বাংলার জন্য অন্তত আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্ধারণ করা যায় কি না, সে বিষয়ে কৌশল প্রণয়ন করার আহ্বান জানান তিনি।

পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের গৌরব নিয়ে শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিলেন, মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করবেন না

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতো পদ্মা সেতু ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন পদ্মা পাড়ের মানুষরা। তারাও স্বপ্ন দেখছেন উন্নত জীবনের, গতিশীল অর্থনীতির। আত্মমর্যাদা আর অন্যায়ের প্রতিবাদের যে প্রতীক পদ্মা সেতু, সেই পদ্মা সেতু গড়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের হাত ধরে। তিনি নিজেই সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাওয়া ও জাজিরা— উভয় প্রান্তের বক্তব্যেই বলেছেন, সাধারণ মানুষ পাশে ছিল বলেই তিনি সেই নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস দেখাতে পেরেছেন। আজ যখন সেই সেতুর দুয়ার খুলেছে, দক্ষিণাঞ্চলের সেই মানুষরাও নিশ্চয় সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজদের সমৃদ্ধ করতে বসে থাকবে না। তাতে জাতীয় অর্থনীতিও এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির আরেক ধাপের পথে। ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ আর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন, নিজে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ পাওয়া পদ্মা সেতু নিশ্চয় নতুন সেই স্বপ্নের পালে বাড়তি হাওয়া দেবেই দেবে।

সারাবাংলা/টিআর

অর্থনৈতিক অঞ্চল অর্থনৈতিক গতিশীলতা কর্মসংস্থান জিডিপি প্রবৃদ্ধি জিডিপিতে অবদান পদ্মা সেতু পদ্মা সেতুর উদ্বোধন স্বপ্নের পদ্মা সেতু

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর