সর্বাত্মক রাষ্ট্রে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের বার্তা
২৬ জানুয়ারি ২০২২ ২০:৩১
কেন্দ্র ঢাকার বাইরে, খবরে-আলোচনায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পাওয়া প্রান্তের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে কী রকমভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দিলো, দেখেছেন? শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তথা শাবিপ্রবি তথা সাস্টের শিক্ষার্থীদের অহিংস অবাধ্যতাকে রুখতে আস্ত এক সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার নজরদারি, বলপ্রয়োগ আর সম্মতি উৎপাদনের সবগুলো ফোর্সকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো। রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের বাহিনী হিসেবে পুলিশ, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ, রাষ্ট্রের নজরদারি ও গোয়েন্দা ফোর্স, রাষ্ট্রের মতাদর্শিক ফোর্স হিসেবে মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী— সব এক জায়গায় করতে হলো বাচ্চা শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার জন্য। তবু কাজ হলো না। দাবি মানার প্রতিশ্রুতিসমেত পাঠাতে হলো শেষ অস্ত্র, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে।
শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা আপাতত অনশন ভাঙলেন। আমার মতো অসংখ্য সংবেদনশীল মনের ধারাবাহিক উৎকণ্ঠাকে আপাতত ছুটি দিলেন তারা। আর গোটা দেশটাকে দিলেন বিবেকের তাড়না, মর্যাদা রক্ষার তাগিদ। আশা করছি মামলা প্রত্যাহার, সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর মুক্তির প্রশ্নগুলো মীমাংসা হতে ২৪/৪৮ ঘণ্টার বেশি সময়ক্ষেপণের চেষ্টা হবে না! আশা করছি, শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াগুলোও মানা হবে কোনো গড়িমসি ছাড়া। জাফর ইকবাল স্যার নিজে সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে গেছেন, শিক্ষার্থীরা তাকে বিশ্বাস করে অনশন ভেঙেছেন। আশা করি সরকার দাবি না মেনে ড. জাফর ইকবালকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার মতো ভুল পথ বেছে নেবে না।
আমার ক’দিন থেকেই মনে হচ্ছে, দিকে দিকে অবাধ্যতার জয় হোক। এই লেখার উছিলায় শাবিপ্রবির প্রতি আবারও নতজানু সেলাম, এক আকাশ ভালোবাসা… কেবল অনশনকারীদের নয়, এর বাইরেও যে শত শত শিক্ষার্থী আন্দোলনে ছিলেন, তাদের গুরুত্বই একইরকম। তাদের জন্যও একই ভালোবাসা। বলে নেওয়া দরকার, এই লেখার উদ্দেশ্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উছিলায় মানুষের মর্যাদা, অধিকার আর স্বাধীনতার বোধকে বোঝা। সঙ্গে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর রাষ্ট্রযন্ত্রের সংকটকে একটুখানি আলাপে আনা।
মানুষের মর্যাদার বোধ যখন আহত বোধ করে, মানুষ যখন দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙতে চায়, যখন মানুষের ভেতরে তার সহজাত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয় তখন মানুষ এতটাই বড় হয়ে ওঠে যে কয়েকজন মিলেই একটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ওলটপালট করে দিতে পারে। ঠিক কোন শক্তিতে ১৫০ ঘণ্টার বেশি সময় পানি পর্যন্ত না খেয়ে বাঁচা যায়? কোন শক্তিতে অস্বীকার করা যায় একটা আস্ত সরকারকে? শক্তিটা আত্মমর্যাদার আর বিবেকের স্বাধীনতার। একদিনে এই বোধ তৈরি হয়নি নিশ্চয়ই। প্রজন্ম পরম্পরায় শাবিপ্রবি এমন দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে। তরুণ তাজা রক্ত এরা, আমি সাস্টের এই আন্দোলনকারীদের পূর্বসূরীদের কাউকে কাউকে চিনি। সুদীপ্ত বিশ্বাস বিভু, সহুল আহমেদ মুন্না, সারোয়ার তুষার, লোপা ভৌমিকসহ বেশ কয়েকজনকে আমি খেয়াল করি। এদের চিন্তা আর তৎপরতায় আলোড়িত হই। তাদের দেখেই বুঝেছি— কী করে প্রান্তের একটা বিশ্ববিদ্যালয় এমন অহিংস অবাধ্যতায় সারা দেশটা নাড়িয়ে দিলো।
আরও পড়ুন-
- ‘উপাচার্য পদের মূল্য বেশি নাকি শিক্ষার্থীর প্রাণ’
- ভোরে শাবিপ্রবিতে গিয়ে যা বললেন জাফর ইকবাল
- ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা
- জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভাঙার প্রস্তুতি চলছে
- শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করা হবে: শিক্ষামন্ত্রী
- ‘১০ হাজার টাকা দিলাম, দেখি সিআইডি অ্যারেস্ট করে কি না’
- ভিসি ফরিদের বক্তব্যে অনেক মেয়ের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে
মর্যাদার লড়াই, মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই
শুরুটা ছিল ১৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। রাত সাড়ে ১০টা থেকে হল প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ পদত্যাগ দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলন শুরু করেন বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সে সময় জানান, আগে থেকেই হল কর্তৃপক্ষের কাছে ডাবলিং নিষিদ্ধ করা, গণরুম না রাখা, অভিভাবকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া, খাবারের মান উন্নত করাসহ বেশকিছু দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। অন্যদিকে হল প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদকে দাবির বিষয়ে ফোন দিলে তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন ‘হল থেকে বের হয়ে গেলে যাও। কোথায় যাবা তোমরা? আমার ঠেকা পড়েনি।’
প্রভোস্টের এমন ক্ষুব্ধ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নেন হলের শিক্ষার্থীরা। এসময় হল প্রভোস্টের পদত্যাগ ও শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “আমরা প্রভোস্টকে ফোন দিলে তিনি হল থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। বিষয়টি ‘জরুরি’ উল্লেখ করলে তিনি (প্রভোস্ট) বলেন, ‘কীসের জরুরি? কেউ তো আর মারা যায়নি!’”
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়। তারা জানায়, ছোট-বড় কোনো সমস্যাতেই প্রভোস্ট কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। বরং সমস্যা উত্থাপনের পরিপ্রক্ষিতে তার এরকম বৈরী আচরণ দিন দিন বেড়েই চলছে। সমস্যা নিয়ে হলে গেলেই সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। হলের ইস্যু নিয়ে পরিবারের আর্থসামাজিক বিষয় এবং ডিপার্টমেন্টে হয়রানি করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় যাদের, সেই শিক্ষার্থীদের জীবন-মরণকে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, তাদের মর্যাদাহানি করা— শিক্ষক-প্রশাসকদের সামন্ত প্রভুর মতো আচরণ শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা মানতে চাননি। আর এই মানতে না চাওয়ার ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ১৫ জানুয়ারি। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা ১৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করেন উপাচার্যকে। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় আমরণ অনশন।
ক্রিমিনাল রাষ্ট্রের ক্রিমিনালাইজেশন বনাম শিক্ষার্থীদের স্বরাজ
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আরেক দফা সহিংস হামলা হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে— এই বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা এই সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রী সরকার ভিন্ন পথ নেয়। করোনার উছিলায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার পর শাসক শ্রেণির মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলনকে ক্রিমিনালাইজড করার পথ নেওয়া হয়। শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত এই অহিংস অবাধ্যতার মধ্যে ‘নাশকতা’, ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা। শুরু হয় তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনকে প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে ব্যর্থ হওয়ার পর নগ্নভাবে শুরু হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক নির্যাতন। আন্দোলনকারীদের বাড়িতে বাড়িতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর হানাদারি, ভিসিপন্থি শিক্ষকের জোর করে জুস খাওয়ানোর চেষ্টা, মেডিকেল সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা, খাবার বন্ধ করতে ফুডকোর্ট বন্ধ করে দেওয়া এবং এমনকি অভাবনীয়ভাবে আন্দোলনে সহায়তা দেওয়া সাবেক পাঁচ গ্র্যাজুয়েটকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার মতো ‘নজির’ তৈরি করা হয়।
এদিকে, রাষ্ট্রের গৃহপালিত মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, শিক্ষক সমিতি, বুদ্ধিজীবীর এবং মিডিয়াও সরব হয়ে ওঠে। ৩৪ ভিসি হুমকি দেন— এই ভিসির জন্য তারাও পদত্যাগ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের ব্যানারে দাবি করা হয়— এই আন্দোলন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তের অংশ! ঢাবির শিক্ষক সমিতি আবিষ্কার করে— সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলন সরকার পতনের একটি ষড়যন্ত্র! একটুও ভাবেন না তারা, প্রকাশ্যে এমন সরকার রক্ষার বন্দোবস্ত তাদের কতটা নগ্নভাবে মানুষের সামনে হাজির করে! বুদ্ধিজীবীরা কলাম পয়দা করেন— দুই পক্ষের জন্যই সম্মানজনক এক্সিট রুটের পরিকল্পনা নিয়ে।
এই বিপুল বন্দোবস্ত সত্ত্বেও থামানো যায়নি শিক্ষার্থীদের। দমানো যায়নি মনুষ্যপ্রজাতির স্বাধীনতার স্পৃহা। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে— আমলা-প্রক্টর-প্রশাসন না থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে নিরাপদ, শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত আর জীবন্ত। এমন সত্যিকারের ছাত্র আন্দোলনের মুহূর্তগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত গন্তব্যের কাছাকাছি চলে যায়। হলের ক্যান্টিন ফুড কোর্ট বন্ধ তো কী হয়েছে, শিক্ষার্থীরা বের হয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েট বড় ভাইবোনদের দেওয়া গণচাঁদা নিয়ে নিজেরাই নিজেদের খাবার রান্না করেছে। নিজেদের নিরাপত্তার বন্দোবস্তও তারা নিজেরা করেছে। ফেনসিডিল ঢুকিয়ে আন্দোলনকে ক্রিমিনালাইজড করার চেষ্টাকে রুখে দিয়েছে। চাষা তথা কৃষকদের নিয়ে শ্রেণিবিদ্বেষী শিক্ষকের মন্তব্যকে তারা রুখে দিয়েছে ‘চাষাভুষার টং’ বানিয়ে।
রাষ্ট্র আসলে নিজে ক্রিমিনাল না হয়ে পারে না। আত্মাহীন এই মেশিন আসলে মানুষে মানুষে ঐক্যকে ভয় পায়। সেজন্য তারা উত্তরসূরীদের প্রতি সাবেক শিক্ষার্থীদের সংহতিবোধকে ক্রিমিনালাইজ করে। সেজন্য তারা টং তুলে দেয়, যেন শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত হতে না পারে। সেজন্য তারা বিভক্ত করতে চায়, বিভক্ত রাখতে চায়।
শাবিপ্রবির দিশা: যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি
বলে রাখাটা জরুরি— ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাবার বুলেটে রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনাও এই প্রথম না। অভাবনীয়ও নয়। স্বায়ত্তশাসনের স্পিরিটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রকে নিরঙ্কুশ রাখার পথ হিসেবে যে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি জারি আছে, তাকে সবসময়ই ব্যবহার করা হয়। বরাবরই সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী পুলিশ ব্যবহার করে অহরহ এসব ঘটিয়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরেরা। এর বীজবপন হয়ে যায় ভিসির সর্বব্যপী ক্ষমতায় আর শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতে। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে দলীয় বিবেচনা ছাড়া কয়জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন গত ১৫ বছরে? হওয়ার পথ নেই। নেই কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কাঠামোটাই এমন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিয়ে আসল আলাপটা ক্ষমতার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন কাঠামোর।
সরকারিগুলোর কথা বাদই দিলাম। তিয়াত্তরের অধ্যাদেশে পরিচালিত আমাদের চারটি পাবলিক প্রতিষ্ঠান ঢাবি, জাবি, রাবি, চবির ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় হলো মিনি রাষ্ট্র, আর ভিসি হলেন তার সুলতান/বাদশা/রাজা। তার এই ক্ষমতা আইন দ্বারা স্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কোনো শিক্ষক নন, একজন প্রশাসক। হায় দৈন্য!
আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী যে একক ক্ষমতা ভোগ করেন, বাস্তব অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ভিসিরা সেই ক্ষমতার থেকেও বেশি ক্ষমতার অধিকারী। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সমন্বিত ক্ষমতার সমান। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর অন্তত কাগজে-কলমে দায়মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভিসির সেই ‘বিশেষ ক্ষমতা’ও আছে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতার পাশাপাশি। সে কারণেই শাবিপ্রবি ভিসির গুষ্টি উদ্ধার করে, তাকে ‘বিশেষ প্রাণীর বাচ্চা’ হিসেবে উপস্থাপন করে, অপেক্ষাকৃত এই লোক বেশি খারাপ জাতীয় আলাপকে সামনে এনে কিংবা আনু স্যারের মতো ‘ভালো ভিসি খারাপ ভিসি তত্ত্ব’ প্রণয়ন করে হাততালি আর লাইক পাওয়া যাবে; তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট বোঝা যাবে না, তাকে বরং আড়াল করা যাবে। বরং কোন ক্ষমতাকাঠামো ভিসিদের নির্বিচারি করে তোলে, একজন ফারজানা কিংবা ফরিদ কী করে হয়ে ওঠেন— সেটাই জরুরি প্রশ্ন।
যথার্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা চূড়ান্ত অর্থে একাডেমিক ফ্রিডমের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক করে তোলার, সেখানে জারি থাকা আমলাতান্ত্রিকতার শুঁড় কেটে ফেলার বিকল্প নাই। বিকল্প নেই এর কর্তৃত্বক্রমতান্ত্রিক কাঠামোকে সমূলে উৎপাটন করার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের সাংগঠনিক অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে বেনিআসহকলার মতো শিক্ষকদের দলবাজি, শাসক শ্রেণির সরকারি ও বিরোধী দলীয় অংশের লেজুড় ছাত্র রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। কেননা শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির নাম করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ঢুকে পড়ে। স্বায়ত্তশাসন ক্ষুন্ণ্ন করে। সেজন্য রাজনীতি নয়, দরকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের স্বাধীন সংগঠন।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন সংস্কারের পাশাপাশি আরেকটা জরুরি প্রশ্ন হলো— বিশ্ববিদ্যালয় যে আসলে প্রশাসক ভিসি আমলা শিক্ষকদের নয়, এটা যে চূড়ান্ত অর্থে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান— সেই আলাপটা সামনে আনা। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুই লিফটের একটি হাজার হাজার শিক্ষার্থী-কর্মচারীর জন্য, অন্যটি শিক্ষক কর্মকর্তাদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আকারেই থেকে যাবে।
যতটুকু বুঝেছি— শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ে মর্যাদার প্রশ্নটিই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে জরুরি। প্রভোস্টের কথায় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেছেন শিক্ষার্থীরা। এই দিকটি ভীষণ জরুরি আমাদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচানোর লড়াই আসলে শিক্ষার্থীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠারও লড়াই, ধারণাগতভাবেও বিশ্ববিদ্যালয় আসলে সেই জিনিস। তবে আইন ও বিধিগত বাস্তবতায় তা নয়। এইসব পরিস্থিতি বদলের প্রশ্ন তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন বিধি বদলের প্রশ্ন। পরিতাপের বিষয়— সেই আলাপে কেউ নেই!
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/টিআর
বাধন অধিকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শাবিপ্রবি শাবিপ্রবি আন্দোলন