সংলাপের স্বস্তিতে ইতিহাসের অস্বস্তি
১ নভেম্বর ২০১৮ ১৬:০২
।। তরিকুর রহমান সজীব, জয়েন্ট নিউজ এডিটর ।।
ঢাকা: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নবগঠিত রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে সন্ধ্যায়। বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় নির্ধারিত রয়েছে এই সংলাপের সময়। বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মতপার্থক্য দূর করে এই সংলাপের আয়োজন রাজনীতিতে স্বস্তির বাতাস নিয়ে এসেছে। আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে— এমন প্রত্যাশাই সকলের। তবে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ আলোর মুখ না দেখা কিংবা একাধিকবার সংলাপে বসা সম্ভব হলেও তাতে কোনো ফল না আসার অতীত ইতিহাস অস্বস্তিরই বটে।
এর আগে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিরসনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ, বৈঠক বা আলোচনার আহ্বান জানালেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিরা বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন বরাবরই। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর বলা হয়েছে, খুনী-দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে কোনো বৈঠক নয়।
এর মধ্যে এগিয়ে আসতে থাকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে এক হয় বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্যসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তি রাজনীতিক। ৭ দফা ও ১১ লক্ষ্য ঘোষণা করা ঐক্যফ্রন্ট একাধিক সভা-সমাবেশ করার পর সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে বসার আগ্রহের কথা জানায়।
এই আহ্বানে সাড়া দিতে সামান্য দেরিটুকুও করেননি প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত রোববার (২৮ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয় আওয়ামী লীগকে। ঠিক পর দিনই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জানান, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসবে আওয়ামী লীগ। পরদিনই সংলাপের দিন-ক্ষণ-স্থান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি পৌঁছে যায় ঐক্যফ্রন্টের কাছে। আওয়ামী লীগ সংলাপে রাজি হবে কি না— ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার পর এ ভাবনা ডালপালা মেলতে না মেলতেই সংলাপে আওয়ামী লীগের সম্মত হওয়াটা কিছুটা হলেও স্বস্তির সুবাতাস ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
কেবল ঐক্যফ্রন্টই নয়, এরই মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা এবং আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেও সংলাপে বসতে সময় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামীকাল শুক্রবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় বিকল্পধারার সঙ্গে এবং আগামী সোমবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণভবনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংলাপে বসবে ক্ষমতাসীন দলটি। এছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোটও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। তাতেও সরকারের তরফ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
দেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর বরাবরই মুখোমুখি অবস্থানে থাকার বিপরীতে সংলাপের খবরে স্বস্তি ছড়ালেও এই সংলাপ শেষ পর্যন্ত কতটা ফলপ্রসূ হয়, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে, এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক পটভূমিতে সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হওয়া এবং সংলাপে বসেও কোনো ফল বের করে নিয়ে আসতে না পারার নজিরগুলোই ঘুরে ফিরে আসছে।
দেশের রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এর আগেও দফায় দফায় রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নিলেও সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংলাপে বসানোই সম্ভব হয়নি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোকে। সত্তরের দশকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও আশির দশকে আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে সংলাপের একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো ব্যর্থ হয়।
পরে ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনে কারচুপির ঘটনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল-অবরোধ শুরু করে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। পরে ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর কমনওয়েলথ মসহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা ও তার বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান সমঝোতার জন্য ঢাকায় আসেন। তার মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ওই সময় ব্যর্থ হয়। পরে ১৯৯৫ সালে সংকট নিরসনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, ফখরুদ্দীন আহমদ ও ফয়েজ আহমদ। সেই মধ্যস্থতাও সাফল্যের মুখ দেখেনি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাব্কে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হননি। আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ ও তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হয় আওয়ামী লীগের আন্দোলন। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বৈঠকে বসেন। তাদের মধ্যেকার এই বৈঠকও ফলপ্রসূ হয়নি।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের সময় জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো আসেন ঢাকায়। তার মধ্যস্থতায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তবে আওয়ামী লীগের ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সে বৈঠকও কোনো ফল আনতে পারেনি।
ফলে এবারের এই চলমান সংলাপ প্রক্রিয়া কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা নিয়েও শঙ্কা কাজ করছে।
আরও পড়ুন-
সংলাপ কি ধাপ্পাবাজির? প্রশ্ন মান্নার
সন্ধ্যায় সংলাপ, সবার চোখ গণভবনে
সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ জন
অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য সংলাপ হবে: ড. কামাল
সংলাপে ১৬ সদস্য, নেতৃত্বে ড. কামাল, বিএনপির ৫
সংলাপে কী মেন্যু পছন্দ? জেনে নেওয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর!
খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না: বিএনপি
সারাবাংলা/টিআর