করোনায় স্থবির মোসাদ্দেকের স্বপ্ন
৮ এপ্রিল ২০২০ ১৬:২১
গেল বছরের নভেম্বরে ভারতে সিরিজ চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের মা। অসুস্থ মা এর পাশে থাকতে রাজকোট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটি খেলেই তাই দেশে ফিরে আসেন লাল সবুজের এই লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ওই ম্যাচটিই ছিল তার শেষ। কেননা পরের মাসে বিপিএলের শেষ দিকে কাঁধের চোট পেয়ে প্রায় দুই মাস থাকতে হয় মাঠের বাইরে। এই সময়েটিতে বাংলাদেশ খেলেছে দু’টি আন্তর্জাতিক সিরিজ। একটি পাকিস্তানের বিপক্ষে আর অপরটি ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেখানে মোসাদ্দেকের বদলীও পেয়ে গেছে টাইগার টিম ম্যানেজমেন্ট। এতে করে ২৪ বছর বয়সী এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার পড়ে গেছেন অনিয়মিতদের খাতায়।
ভেবেছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০১৯-২০২০ মৌসুমে পারফর্ম করে হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করবেন। স্বপ্ন বুনেছিলেন লাল সবুজের জার্সি গায়ে আবারো নিয়মিত হয়ে ব্যাট হাতে প্রলয় তুলবেন। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস তার সেই স্বপ্ন স্থবির করে দিয়েছে। প্রলম্বিত করেছে টাইগার্স ডেনে ফেরার পর। হয়ত সবাই জানেন, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়াদের নিয়মিত হতে ঘরোয়া ক্রিকেটের বিভিন্ন আসরই একমাত্র (এনসিএল, বিসিএল, বিপিএল, ডিপিএল) সম্বল। কিন্তু করোনা শেষে কবে লিগ ফিরবে সেটাও অনিশ্চিত। আদৌ গড়াবে কিনা তা নিয়েও আছে শঙ্কা। সেই অনিশ্চয়তা তার ললাটে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। তবে তাতে বিমর্ষ হয়ে পড়েন না, হাল ছাড়েন না দুরন্ত এই তরুণ। বরং প্রত্যয় রাখে আরো প্রবল বিক্রমে ফেরার।
নিজ শহর ময়মনসিংহ থেকে মুঠোফোনে সারাবাংলার সঙ্গে একান্তে আলাপকালে কথাগুলা জানাচ্ছিলেন মোসাদ্দেক। কথা বলেছেন জাতীয় দলের বিভিন্ন ইস্যু ও করোনা কালে দৈনন্দিন কর্মকান্ড নিয়েও। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা তুলে ধরা হলো-
সারাবাংলা: আমরা জানি ভারত সিরিজের সময় আপনার আম্মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপনি টি-টোয়েন্টি খেলেই অসুস্থ মায়ের পাশে থাকতে ছুটে এসেছিলেন। এখন কেমন আছেন আপনার আম্মা?
মোসাদ্দেক: এখন ভালো। তবে যেহেতু অপারেশন হয়েছে একটু ব্যথা আছে।
সারাবাংলা: ভারত সিরিজের পর জাতীয় দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। সব মিলে সময়টা কেমন যাচ্ছে?
মোসাদ্দেক: যখন আম্মা অসুস্থ হলো আমি নিজেই ম্যানেজমেন্টকে বলে এসেছি এই সময় দলের সঙ্গে থাকা সম্ভব না। ভারত থেকে টেস্ট না খেলেই চলে এলাম। তখন কিন্ত আমি দলের নিয়মিত সদস্য। আম্মার অপারেশনের পরে শুরু হলো বিপিএল। বিপিএলে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ভালো খেলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই কাঁধে চোট পেলাম। সেরে উঠতে প্রায় দুই মাসের মতো সময় লাগল। যখন ফিট হলাম তখন শুরু হলো করোনা। তাই নিজেকে অনিয়মিত বলতে চাইছি না। তবে আমি করছি যেহেতু একটা বিরতি গিয়েছে সেটা হোক ছোট। কিন্তু তারপরেও দলে ফেরাটা সহজ হবে না। অবশ্যই আমাকে ভালো খেলে ফিরতে হবে।
সারাবাংলা: সেই ফেরাটা কী প্রিমিয়ার লিগ দিয়েই হত?
মোসাদ্দেক: অবশ্যই তাই! কারণ আমরা যারা জাতীয় দলে সুযোগ পাই না এদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম আছে বিপিএল, আরেকটা আছে ডিপিএল বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। এই মুহুর্তে ডিপিএল ছাড়া কিন্তু আর কোনো ক্রিকেটই নেই। অতএব শুধু আমিই নই সবারই এখানে ফোকাস থাকে। তবে আমার জন্য ডিপিএল (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম এই জন্য যে এখানে ভালো খেললে হয়ত আমার জন্য আবার সুযোগ আসবে। তো এটা আমার জন্য একটা ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু দেখেন করোনায় সব পিছিয়ে গেল।
সারাবাংলা: যে কারণেই হোক একবার জাতীয় দলের বাইরে চলে গেলে আত্মবিশ্বাসটা কি কমে যায়?
মোসাদ্দেক: সত্যি বলতে বড় চ্যালেঞ্জ কাজ করে। যখন একজন প্লেয়ার দল থেকে বের হয় তখনকার সময়টা তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং থাকে। কেননা তার মধ্যে সবসময়ই কাজ করতে থাকে কি করে আবার দলে ঢুকব? এইসব ভাবনা। দিনশেষে একটু অন্যরকম চিন্তা অবশ্যই কাজ করে। কারণ আমরা যারা খেলি সবাই ভাবি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। এবং দেশকে ভালো কিছু দিতে চাই।
সারাবাংলা: আপনার জায়গায় এই মুহুর্তে আফিফ হোসেন ধ্রুব খেলছে। তার আসা আপনাকে কতটা ভাবনায় ফেলে দিয়েছে?
মোসাদ্দেক: সত্যি বলতে সহজ হবে না। আবার এটাও সত্যি আমি ভালো খেললে আবার আমার জায়গা ফিরে পাব এতটুকু বিশ্বাস আমার মধ্যে আছে।
সারাবাংলা: জাতীয় দলে আপনি যে জায়গায় ব্যাটিং করেন সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ বা অসন্তোষ আছে?
মোসাদ্দেক: দেখেন, প্রায় চার বছর হলো আমি জাতীয় দলে খেলছি। আমার যদি ভুল না হয় এক থেকে দুইটা ম্যাচে আমি ওপরে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছি। এই চার বছরে আমি যদি ঢাকা লিগ ও অন্যান্য লিগে চিন্তা করি সেই হিসেবে জাতীয় দলে ওপরে খেলার সুযোগ খুবই কম পেয়েছি। তবে বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমি এখানে (৭, ৮ নম্বরে) খেলছি। জোরাজুরির কিছু নেই বা এটা আমার হাতেও নেই। আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে কাজটা খুবই কঠিন, শুধু আমার জন্যই নয়, সারা পৃথিবীতে যারা ক্রিকেট খেলে তাদের সবার জন্যও। আক্ষেপ তো অবশ্যই থাকে যে ঘরোয়া লিগে আমি ওপরে ব্যাটিং করি। সেই জায়গা থেকে পাঁচটা বা দশটা ম্যাচ সুযোগ পেলে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারতাম। এবং আমি যদি খারাপও খেলতাম আক্ষেপও থাকত না যে খারাপ খেলছি বলেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি সাধারণত পাঁচে ব্যাটিং করি। এখানে আমাকে সুযোগ দিলে প্রমাণ করতে পারতাম।
সারাবাংলা: বিশ্বকাপে আরেকটু ভালো করা সম্ভব ছিল?
মোসাদ্দেক: বিশ্বকাপের সময় সাকিব ভাইর সঙ্গে আমি অনেক কথা বলেছি। সাকিব ভাই আমার সাথে একমত পোষণ করেছেন যে আমি যদি আমার নিজের জন্য ব্যাটিং করতাম দুই তিনটা ফিফটি হতো। কিন্তু আমি ভেবেছি দলের কথা। তাছাড়া ওই সময় নিজের চিন্তা করাটাও একরকম অপরাধই হত। আমি হয়ত ১০ কি ১২ ওভার পেয়েছি। তখন তো আর ৬০ বা ৭০ রান করা সম্ভব না।
সারাবাংলা: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আপনি এক মৌসুমে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান। কিন্তু তিন বছর টেস্ট খেলেছেন মাত্র তিনটি! অদ্ভুত না? আবার যে তিনটা টেস্ট খেলেছেন গড় ৪১ এর ওপরে!
মোসাদ্দেক: আপনি দেখেন আমার অভিষেক ম্যাচটি যেটি কলম্বোতে খেললাম (শততম টেস্ট) ম্যাচটা আমরা জিতেছি। প্রথম ইনিংসে আমি ৭৫ করেছি, দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩। এরপরে যে টেস্ট ম্যাচটা খেলেছি সেটা প্রায় এক বছর পরে। এই সময়টায় আমি কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে খারাপ খেলিনি। আমি জানি না কেন? তবে বাংলাদেশ টেস্ট কম খেলে বলেই হয়ত। আবার অনেক সময় হয়ত টিম কম্বিনেশনের কারণে নাও আসতে পারি। সবার ওপরে দেশ। দেশের প্রয়োজনে টিম ম্যানেজমেন্ট যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা মেনে নেওয়া উচিত। তবে হ্যাঁ, একটা আক্ষেপ আছে দ্বিতীয় টেস্টের লম্বা সময় আমি তৃতীয় ও শেষ টেস্ট ম্যাচটি (আফগানিস্তান টেস্ট) খেলেছি এবং সেই ম্যাচে দলের সবার মধ্যে আমিই সর্বোচ্চ রান করেছিলাম। এরপরে তো আমার মা অসুস্থ হলেন, আমি ইনজুরড হলাম। তাই শেষ তিনটি সিরিজ (ভারত টেস্ট, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে) নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই।
সারাবাংলা: তার মানে অভিষেকের পর আফগানিস্তান টেস্ট পর্যন্ত খেলা সংখ্যা (৩টি টেস্ট) নিয়ে আপনার অসন্তোষ আছে?
মোসাদ্দেক: থাকাটা কি অস্বাভাবিক বলেন? তিন বছরে আমি মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেছি। আমি যদি খারাপ খেলতাম তাহলে এক বিষয় ছিল। যেহেতু আমি ভালো খেলেছি আশা তো করতেই পারি। এটা তো আর আমার ভুল না।
সারাবাংলা: করোনার সময়টা কী করে কাটছে?
মোসাদ্দেক: যেহেতু এই সময়ে অন্য কোনো কাজ নেই তাই ফিটনেস নিয়ে কাজ করছি। মাঝে মধ্যে মা’কে ঘরের কাজে সাহায্য করি। তবে আমার বিশেষ একটি সময় কাটে পাখিদের সঙ্গে। আমি বাসায় পাখি পুষি। ওদের সঙ্গে খেলি, যত্ন নেই। এভাবে কেটে যায়।
সারাবাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোসাদ্দেক: আপনাকেও।
আরো পড়ুন:
মিডল অর্ডারেই স্বাচ্ছন্দ্য মিঠুনের
নিজের জায়গা ধরে রাখতে আত্মবিশ্বাসী সাদমান
বাতাসে বল ঘুরাতেই নাঈমের যত আনন্দ
করোনা থামিয়ে দিয়েছে সৌম্য’র বিশ্বকাপ ভাবনা
পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই আমাদের টার্নিং পয়েন্ট ছিল: আকবর
বিশ্বকাপে আমাদের এক-দুইটা ম্যাচ জেতা সম্ভব ছিল: জেসি
‘এমনভাবে ফিরতে চাই যেন আর বের হতে না হয়’
নেইমারের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পান সাইফউদ্দিন
করোনাভাইরাস ক্রিকেটার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত