বিজ্ঞাপন

প্রিয়ভাষিণীর সন্তান আমি, এটা আমার গর্ব : ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী

March 8, 2018 | 6:58 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা:  জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনটি ততোক্ষনে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। তারপরও সারি বেঁধে থাকা শ্রদ্ধা জানানো মানুষের লাইনটি ছিল অনেক দূর। একটি মাত্র গোলাপ আর ফুলের তোড়ায় আড়াল হয়েছে কফিনটি। কফিনের ওপাশে দাড়েনো কারু তিতাস আর ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনীর গাল বেয়ে পানি ঝরছে। তাদের চোখে পানির ফোয়ারা। সারাক্ষণ ঝরে চলেছে।

পূর্ব নির্ধারিত সময় ছিল ১২ টা পর্যন্ত, কিন্তু তারপরও যেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল কমছিলো না। মাইক থেকে বারবার সেটা বলাও হচ্ছিল। সময় নেই-তাকে নিতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদে। যেখানে জানাজা শেষে অন্তিম যাত্রায় নিয়ে যাওয়া হবে মীরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানেই শায়িত হবেন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

বিজ্ঞাপন

দুপুর ১২টার কিছু পরেই শ্রদ্ধা জানানো শেষ করা হয়। কফিন নিয়ে যাবার আগে এক মিনিট নীরবতাও পালন করা হয়। তার আগে ফুলেশ্বরী মাইকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। চোখে জল আর ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘তার মা গত চারমাস ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তিনি এবারের ফাল্গুন দেখেননি, আকাশ দেখেননি কতোদিন। কিন্তু এতো এতো ফুলে মাকে শ্রদ্ধা জানানোয় সে আক্ষেপটা যেন কিছুটা হলেও লাঘব হয় ফুলেশ্বরীর। তিনি বলেন, আমার মাকে আপনারা এতো ফুল ও ভালোবাসা দিয়েছেন যেন মাকে পুরো ফাল্গুনটাই এনে দিয়েছেন।

 

বিজ্ঞাপন

 

এরপর প্রিয়ভাষিণীকে নিয়ে সবাই রওনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদের দিকে। মায়ের পিছু নিয়ে আবার চোখ মোছেন ফুলেশ্বরী। এরই ফাঁকে ফুলেশ্বরী কথা বলেন সারাবাংলার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমি রাজাকারের সন্তান নই। আমার বুকে বাংলাদেশ। আমি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সন্তান-এটা আমার গর্ব, প্রিয়ভাষিণীর সন্তান হয়ে আমি গর্বিত। আমি প্রিয়ভাষিণীর সন্তান সেটা বলতে পেরে সারাজীবন ধন্য হবো।’

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্য যখন এক মিনিট নীরবতা পালন করা হচ্ছিলো তখন কফিনের পাশে দাড়িয়ে কাঁদছিলেন লাল সবুজের শাড়ি পরা এক নারী। তার মাথায় লাল সবুজ পতাকা, বুকের বাম পাশে লাল সবুজ ব্যাজ। কোনওভাবেই তিনি কান্না চাপাতে পারছিলেন না। নীরবতা পালনের সময়ে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেলেও তারপরই যেন বাঁধ ভেঙ্গে যায়। কিছুটা থিতু হতেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধে প্রথমে দুই নম্বর সেক্টর ছিলাম, পরে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নয় নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি। আজকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা চলে যাচ্ছন চিরদিনে মতো, তিনি আমাদের পথ প্রদর্শক ছিলেন। পাক আর্মি তাকে নির্যাতন করেছিল, তারপর তার সমালোচনা হয়েছিল অনেক। কিন্তু তিনি তার ভাস্কর্যের মাধ্যমে সবকিছুর জবাব দিয়েছেন, সব প্রতিকূলতাকে তিনি জয় করেছেন।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বন্ধু নিশাত জাহান রানা সারাবংলাকে বলেন, ‘কোনও কাছের মানুষকে বিদায় দেওয়াটা জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। যদিও সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা জীবনের একইসঙ্গে-যেতে দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত ধরেতো রাখা যায় না। তার মতো মানুষ যখন চলে যায় তখন এই পৃথিবীরই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। যারা পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে চায়, নান্দনিক রাখতে চায়, প্রতিদিনের জীবন যাপন সুন্দর করে তুলতে চায়, তিনি ছিলেন সেই মানুষ। তার কাজের ভেতর দিয়ে, ব্যক্তিগত চর্চার ভেতর দিয়ে সকলকে ভালবাসা দিয়ে গেছেন।’

নিশাত জাহান বলেন, ভালবাসা ছাড়া ঘৃণা দেওয়ার ক্ষমতাই তার ছিল না।  সে জায়গাটায় আসলে পৃথিবীরই ক্ষতি হয় যখন এরকম মানুষ চলে যান। ফেরদৌষী প্রিয়ভাষিণী আমাদেরকে সেই ক্ষতির ভেতরে রেখে গেলেন।’

‘কঠীন পরিস্থিতিতে দাড়িয়েও লড়াই করবার যে সাহস, যে প্রেরণা তিনি দিয়েছেন তা বহুদিন আমাদের লড়াইকে উজ্জীবিত করবে।’-বলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে তার ভুমিকাই কেবল শেষ কথা না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে  যে আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক শক্তি, জঙ্গীবাদ তাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তার অন্যতম সংগঠক ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। তার কাছ থেকেই তরুন প্রজন্ম এবং বর্তমান প্রজন্ম প্রেরণা লাভ করেছি।

‘তিনিই প্রথম উচ্চারন করেছিলেন, বীরঙ্গনা লজ্জার নয়, সম্ভ্রমহানির বিষয় নয়, শ্লীলতাহানির বিষয় নয়-এটা গর্বের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌন হয়রাণী করেছিল এ দেশের নারীদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেবার জন্য। তাদের অত্যাচারের এক নাম ধর্ষণ। আর কিছু নয়,এ বিষয়টি নিয়ে যিনি প্রথা ভেঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।’- শ্রদ্ধা জানাতে এসে সারাবাংলাকে এসব কথা বলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট কানিজ আকলিমা সুলতানা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রিয়ভাষিণীকে। কানিজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা এমন কোনও মানুষ নাই-যার সঙ্গে তার ছবি নেই। যাকে তিনি পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেননি, এরই নাম ভালোবাসা, এরই নাম প্রেরণা-সাহস। তিনি আমাদের সেই সাহস দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের শিখিয়ে গেছেন, যাই হোক না কেন মাথা উঁচু করে চলতে হবে। থেমে যাওয়া যাবে না, হেরে যাবার কিছু নেই-জিততে হবে- যোগ করেন কানিজ আকলিমা সুলতানা।

সারাবাংলা/জেএ/এমএস

অারও পড়ুন:

অন্তিম শয়ানে প্রিয়ভাষিণী

ফাল্গুনের ফুল ও ভালোবাসায় প্রিয়ভাষিণীকে বিদায়

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন