বিজ্ঞাপন

শত প্রতিকূলতা, তবু অমলিন রোহিঙ্গা শিশুদের হাসি

May 22, 2018 | 9:51 pm

।। জান্নাতুল ফেরদৌসী ও জাকিয়া আহমেদ ।।

বিজ্ঞাপন

কক্সবাজার থেকে: শুকনো হাড্ডিসার শরীর, তেল দেওয়া চুলে ফ্যান্সি ব্যান্ড। মেরুন রঙের জামা পরা, কিন্তু খালি পা। কোলে ছোট ভাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৮ বছরের ফাতিমা আক্তার। কথা বলতে এগিয়ে গেলে ধীরে ধীরে কথা বলে; কিন্তু মোবাইলে ছবি তুলতে গেলেই জড়তা কাজ করে। অনেক অনুরোধের পর পাওয়া গেল তার ছবি তোলার অনুমতি, মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে দাঁড়ায় ক্যামেরার সামনে।

এমন সময় পাশে থাকা ২৩ বছরের রোহিঙ্গা তরুণ মো. ইউনুস বলে ওঠেন, ‘পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুদের এ হাসিটাই একমাত্র সৌন্দর্য। এদের কোনো চাওয়া-পাওয়া বা কষ্টের বোধ নেই!’

সরেজমিনে বালুখালি-কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে ইউনুসের এ কথার সত্যতা মেলে। ক্যাম্পগুলোতে দলে দলে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের বেশিরভাগেরই গায়ে নেই কাপড়, পায়ে নেই স্যান্ডেল। নিজ দেশ হারিয়েছে, হারাতে বসে নিজেদের ভাষা, হারিয়েছে পরিবারের অনেককে। ঘরে খাবার নেই, পানির অভাবে নিয়মিত গোসল হয় না। তারপরও তাদের চঞ্চলতায় কোনো কমতি নেই। দূর-দূরান্ত থেকে ছোট ছোট শিশুরাই পাহাড়ি পথ বেয়ে ঘরে আনছে ত্রাণ, শরীর বাঁকিয়ে হাসি মুখে কাঁধে তুলে নিচ্ছে পানির কলসি, মাথায় কাঠের জ্বালানি কাঠের বোঝা। অপরিচ্ছন্ন, ঘুপচি পরিবেশের মধ্যেও সত্যিই এসব রোহিঙ্গা শিশুর হাসিই যেন প্রাণসঞ্চার করে রেখেছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেল, বালুখালি-কুতুপাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৭৫ ভাগই নারী ও শিশু। ঘরবাড়ি ছেড়ে এলেও এই ক্যাম্পেই হয়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখা আর বিনোদনের ব্যবস্থাও। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পাঠদান কেন্দ্রগুলোতে চোখে পড়ে রোহিঙ্গা শিশুদের কোলাহল। পড়ালেখার পাশাপাশি লুডু খেলা, ছবি আঁকার ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের জন্য। কেউ কেউ আবার গল্প করতে ব্যস্ত।

এমন একটি স্কুলে কথা হয় ৯ বছরের হোসনে আরার সঙ্গে। গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গারা যখন প্রথম আসতে শুরু করে, তখনই বাবা-মা আর পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে হোসনে আরাও এসেছে বাংলাদেশে। থাকছে এই ক্যাম্পে। এখন ক্যাম্পের ভেতরের স্কুলেই চলছে তার পড়ালেখা আর ছবি আঁকা।

সেই স্কুলেই কথা হয় রোহিঙ্গা তরুণ মো. ইউনুসের সঙ্গে। ঢাকা আহসানিয়া মিশন পরিচালিত এই স্কুলে তিনি শিশুদের মিয়ানমারের ভাষা শেখাচ্ছেন। ইউনুস সারাবাংলা’কে বলেন, মিয়ানমারেও তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ২৫ আগস্টের পর তিনিও মিয়ানমারের মংডুর নাইসাফু এলাকা থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন বালুখালি শরণার্থী শিবিরে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় রাবেয়া বসুও পড়ান এই স্কুলে। এর মধ্যে আরবি ও মিয়ানমারের স্থানীয় ভাষা শেখান ইউনুস, রাবেয়া শেখান ইংরেজি-গণিত। তারা জানান, সকাল ৯টা থেকে সকাল ১১টা, সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা এবং দুপুর দেড়টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ক্লাস হয় এই স্কুলে।

স্কুলের চাকরি করে ইউনুস বেতন পাচ্ছেন সাড়ে সাত হাজার টাকা, তাতে করে কোনোমতে চলছে তার সংসার। স্কুলগুলোতে কেন বাংলা শেখানো হচ্ছে না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশে ফিরে যাব, এমন আশাতেই শিশুদেরকে বাংলা শেখানো হচ্ছে না।’

স্কুলে শিশুদের উপস্থিতি কেমন— এ প্রশ্নের জবাবে ইউনুস বলেন, ‘ক্যাম্পে তো সমস্যার শেষ নেই। নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে, ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না। তবে তারপরও এসব শিশুরা স্কুলে আসছে। এখানে ইংরেজি, অংকসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাচ্ছে। শিশুরা ছবি আঁকছে, নিজেদের ভাষায় গান করছে— এটুকুই ওদের বিনোদন।’

ক্যাম্প ঘুরে আরেকটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে ছবি আকঁছে, লুডু খেলছে। স্কুলটির শিফট করা হয়েছে দিনের তিন ভাগে। এই তিন শিফটে শিক্ষার্থী রয়েছে মোট ৫৭৩ জন।

বিজ্ঞাপন

এই স্কুলের শিক্ষার্থী ১৫ বছরের মিম। ‘আমাদের তো কিছু নাই’— মন্তব্য করে মিম বলে, ‘এই ক্যাম্পর বাইরে যেতে পারি না। এখানে খাঁচার মতো লাগে। তার ভেতরে স্কুলে ছবি আঁকি, লেখাপড়া করি— এই সময়টা একটু আনন্দ পাই। বাকি সময় তো ঘরের ভেতরে বসে থাকতে হয়।’

নিজেদের দেশে যেতে চাও? এমন প্রশ্নে মিমের উত্তর, ‘দেশে গিয়েও যদি ক্যাম্পে থাকতে হয়, তাহলে যেতে চাই না। নিজেদের মতো করে থাকার সুযোগ পেলে যেতে চাই। তা না হলে এখানেই থাকব।’

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন