বিজ্ঞাপন

আমরা বেপরোয়া জাতিতে পরিণত হয়েছি: সুলতানা কামাল

June 29, 2018 | 1:15 pm

।।স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘আমরা বেপরোয়া জাতিতে পরিণত হয়েছি। যা কিছু হয় বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে তা সমাধান করার চেষ্টা করি এবং জনগণ এতে বাহবা দেয়। আমরা আইন মানতে চাই না, আমরা আত্ম-শৃঙ্খলার প্রতি নজরদারি করি না। আমরা সভ্য এবং দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের দিকে মনোযোগী হই না। এই জায়গায় পরিবর্তন আসতে হবে। অবশ্যই নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। কেননা, এ অবস্থা একটি সভ্য জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন। ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে (ডিআরইউ)  ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার (২৯ জুন) এসব মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবারের ঈদুল ফিতরের যাত্রায় দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ২৭৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত এবং ১২৬৫ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সম্মিলিতভাবে ৩৩৫টি দুর্ঘটনায় ৪০৫ জন নিহত ও ১২৭৪ জন আহত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সুলতানা কামাল বলেন, ‘আইন অমান্য করার প্রবণতা থেকেই দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে যে, কে কতো আইন অমান্য করে সবার আগে যেতে পারে। আর এই আইন না মানার প্রবণতা তৈরি হয় মৌলিক অনিরাপত্তাবোধ থেকে। সামগ্রিকভাবে আমরা সমাজে, রাষ্ট্রে এমন একটা পরিবেশে বাস করি যেখানে আমাদের কারোর কোনো নিশ্চয়তাবোধ নাই। আমাদের সময়, জীবন, চিন্তাভাবনার কোনো মূল্য নাই। অথচ মানুষ পথে-ঘাটে নিরাপদে চলতে পারবে, এই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই মৌলিক দায়িত্ব।’

তিনি আরো বলেন, ‘জবাবদিহিতার অভাবে সারাদেশে আইন অমান্য করার প্রবণতা দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনারোধে যে কয়টি সুপারিশ পেশ করেছেন আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। যিনি নেত্রীর প্রসংশা সকাল-বিকেল করেন, আশা করি তিনি নেত্রীর এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন।’

অনুষ্ঠানে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৮ এর তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘এবারের ঈদের আগে যাত্রাপথে সকল তদারকি সংস্থার সক্রিয় অবস্থানের কারণে ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হলেও ঈদ শেষে ফেরার পথে তদারকি না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। গত ২৩ জুন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৬ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫২ জন নিহত ও ১৫০ জন আহত হয়। ঈদ যাত্রা শুরুর দিন ১১ জুন থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ২৩ জুন পর্যন্ত গত ১৩ দিনে ২৭৭ টি সড়ক দূর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত ১২৬৫ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে নৌ-পথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ৫৫ জন নিখোঁজ ও ০৯ জন আহত হয়েছে। রেল পথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩৫জন, ট্রেনের ধাক্কায় ৪জন ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ০২ জনসহ মোট ৪১ জন নিহত হয়।’

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এই সময়ে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলার প্রধান সাক্ষী সিএমপির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হেলাল উদ্দিন ভুইয়া, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ভারতীয় নাগরিক প্রকাশ মালিক, জামালপুরে ডিএমপির এএসআই হেলেনুর রহমান, শেরপুরে জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ, চট্টগ্রামের পটিয়ায় চকরিয়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক হৃদয় রঞ্জন দাস, পটুয়াখালীর বাউফলে লঞ্চ থেকে পড়ে পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক মাসুম বিল্লাহ, নারায়নগঞ্জ সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিক রমজান ভুইয়া নিলয়, ফেনীর দাগনভুঞায় পল্লী চিকিৎসক ডা. মজিবুল হক, নেত্রকোনার মদনে পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারেছুর রহমান, লক্ষীগঞ্জে নেত্রকোনা হোমিও কলেজের অধ্যক্ষ এমএ কুদ্দুস, নাটোরের লালপুরে কদিমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি সামসুল আরফিন শাহেদ, চট্টগ্রামে অভিনেত্রী তিথি বড়–য়া, ময়মনসিংহের নান্দাইলে কিশোরগঞ্জ শহরের এসভি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আকলিমা আক্তার, কুড়িগ্রামের উলিপুরে বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য জাহেদুল হক নিলু, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে পৌরসভা ছাত্রদলের সহ-সম্পাদক জুয়েল মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

এ ছাড়া নরসিংদীর বাদুয়ারচর রেলসেতুতে সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় পিতা ও দুই কন্যা। শরিয়তপুরের পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম স্পিডবোড দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।

সংগঠিত দুর্ঘটনার যানবাহন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮.৮৯ শতাংশ বাস, ১৬.৩৯ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ১২.২২ শতাংশ নছিমন-করিমন, ১৩.০৬ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক, ৬.৬৭ শতাংশ অটোরিক্সা, ৮.৩৩ শতাংশ কার-মাইক্রো ও ১৫.২৮ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৯.১৬ শতাংশ অনান্য যানবাহন দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।

মোট সংগঠিত দূর্ঘটনার ৩৪.০২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩২.৭২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা, ১৩.২৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ১.১০ শতাংশ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে, ০.৭৩ শতাংশ চাকায় উড়না পেছিয়ে ও ১৮.২০ শতাংশ অনান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন,  বিরতিহীনভাবে যানবাহন চালানো, অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিক্সা, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, নসিমন-করিমন ও মোটর সাইকেল অবাধে চলাচল, মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা এবং সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

দূর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি অনুষ্ঠানে ১০টি সুপারিশ দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। প্রশিক্ষিত চালক গড়ে তোলার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সরকারী ভাবে “চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” গড়ে তোলা। নিয়মিত রাস্তার রোড সেফটি অডিট করা। ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা। ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা। মহাসড়কে ধীরগতির যান ও দ্রুত গতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেইনের ব্যবস্থা করা। মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, অটোরিক্সা বন্ধে সরকারের গৃহিত সিদ্ধান্ত শত ভাগ বাস্তবায়ন করা। ভাঙ্গাচোড়া রাস্তাঘাট মেরামত করা। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুটপাত, আন্ডারপাস, ওভারপাস তৈরি করে পথচারীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা।

অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, বিআরটিএ এর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান, ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়া, বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মাহবুব আলম তালুকদার এবং সইফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট এলায়েন্স এর সমন্বয়ক সদরুল হাসান মজুমদার।

সারাবাংলা/জেআইএল/জেএএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন