বিজ্ঞাপন

স্কুলটির মাঝেই যেন বেঁচে আছেন রবিউল

June 30, 2018 | 8:21 pm

।। জাকিয়া আহমেদ ও আরিফুল ইসলাম ।।

বিজ্ঞাপন

মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে: মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার এলাচীপুর গ্রামের আফজাল খোন্দকার তার ১১ বছরের ছেলে পারভেজকে এনেছেন ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুলে।

শুক্রবার (২৯ জুন) কাটিগ্রামের এই স্কুল প্রাঙ্গণেই সারাবাংলার প্রতিবেদকদের সঙ্গে কথা হয় আফজাল খোন্দকারের। তিনি বলেন, চার বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া পারভেজ যখন ফিরে এলো তখন কেমন চুপচাপ, কথা বলে না, ক্ষুধা পেলেও বলে না। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে  ছেলেকে নিয়ে আছি বিশেষায়িত স্কুলটিতে। কিন্তু ভর্তি করাতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় দূরত্ব। আমার বাড়ি থেকে এই স্কুলের দূরত্ব ২০ মাইল! তাই নিরাশ হতে হয় আফজাল খোন্দকারকে। কিন্তু বাক প্রতিবন্ধী আঁখি আকতার (১৪), বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মো. রবিউল (১০), সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত তোয়া (১২), শারীরিক প্রতিবন্ধী ঊর্মিলা সূত্রধরের (০৮) মতো অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পরিবারের ভরসায় পরিণত হয়েছে এই স্কুলটি।

নিহত রবিউল

বিজ্ঞাপন

গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিম কামরুল ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান হামলায় নিহত হন। আর তার স্বপ্নের স্কুল- বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি বা ব্লুমস। ২০১১ সালে কাটিগ্রামের ১২ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু নিয়ে স্কুলটি শুরু করেন কামরুল। তার মৃত্যুর পর পেরিয়েছে দুই বছর, রবিউল ইসলামের স্বপ্নের স্কুলটির দায়িত্ব নিয়েছেন তার পরিবার, বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ছেলের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে স্কুলটির জন্য ২৯ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন কামরুলের মা করিমন নেছা।

হলি আর্টিজানে নিহত রবিউলের গড়া ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুল’

ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা

‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল এসব শিশুদের নিয়ে, সে স্বপ্ন পূরণে যা করতে হবে- সাধ্যমতো সেসব চেষ্টা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ২৯ শতাংশ জমিটা আগেই দিয়েছিলাম মৌখিকভাবে কিন্তু যখন জানলাম, রেজিস্ট্রেশনের জন্য লিখিত দিতে হবে- দিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা চলে গেছে, কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা আমরা সবাই মিলে করব, তাতে করে আমার ছেলেটা বেঁচে থাকবে মানুষের মনে, অন্তরে। মা হিসেবে সেটা দেখতে চাই আমি।

ইতোমধ্যেই স্কুলটির সহযোগী হিসেবে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুরা হাতে রং পেন্সিল তুলে নিয়েছেন। ১ জুলাই রবিউল ইসলাম কামরুলের মৃত্যুদিন স্মরণে আয়োজিত এই বিশেষ চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তারা। মনের খুশিতে ছোট ছোট হাতে আঁকছে গ্রামের দৃশ্য, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ফুল-পাখি-প্রজাপতি।

বিজ্ঞাপন

অস্বচ্ছল এসব শিশুদের পরিবারের সদস্যরা  বলছেন, জঙ্গি হামলায় কামরুলের মৃত্যু তাদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের নাম হলেও  কামরুল বেঁচে আছেন তাদের মনে, তার স্কুলের মাঝে। তারা নিজেরা যতদিন বেঁচে থাকবেন- রবিউল ইসলাম কামরুল তাদের আত্মার হয়ে বেঁচে থাকবেন।

কামরুলের মা এবং স্ত্রী জানান, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুদের নিয়ে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন কামরুল, সে স্বপ্ন তারা সফল করবেন, কামরুলের স্বপ্নকে তারা বাস্তবায়িত করবেন, দিনে দিনে আরও বড় হবে এই স্কুল, আরও মানুষের মনে জায়গা করে নেবেন কামরুল।

হলি আর্টিজানে নিহত রবিউলের গড়া ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুল’

এখানে শিশুরা পায় স্বজনের মমতা

কামরুলের প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবক এবং বিভিন্ন পেশার শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে ১৫ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়। গত বছর সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতরে ব্লুমস কাটিগ্রাম নামে একটি অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত হয় বলে জানান রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস।

শামস আরো বলেন, বর্তমানে ব্লুমস কাটিগ্রামের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ৪০ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের নিয়ে চলছে ব্লুমস স্পেশালাইজড স্কুলটি। এর মধ্যে রয়েছে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, সেরিব্রাল পালসি, অটিজমসহ একাধিক প্রতিবন্ধীতে আক্রান্ত শিশু।

বিজ্ঞাপন
হলি আর্টিজানে নিহত রবিউলের গড়া ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুল’

ওরা এখন সব কথা বুঝতে পারে

গত সাড়ে চার বছর ধরে স্কুলটিতে শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন শামীমা নাসরিন। তিনি জানালেন, বিশেষায়িত এই স্কুলটিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, খেলাধুলা, অংকনসহ প্রাথমিক বর্ণমালা শেখানো হয়। প্রথমদিকে এসব শিশুদের কথা শোনাতে খুব বেগ পেতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন প্রতিটি বাচ্চা খুব ভালো রয়েছে, আমাদের সঙ্গে ওদের মানসিক যোগাযোগটা খুব শক্ত।

হলি আর্টিজানে নিহত রবিউলের গড়া ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুল’

অস্বচ্ছল পরিবারের এসব শিক্ষার্থীদের রোজা বা ঈদেও নানা রকম সহায়তা করা হয়।

তবে শুরুর দিকে, গ্রামের এসব শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসার কাজটা সহজ ছিল না মন্তব্য করে শামীমা নাসিরিন বলেন, স্কুল শুরুর দিকে কামরুল ভাই পুরো গ্রামে পায়ে হাঁটতেন, হেঁটে-হেঁটে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়েদের বোঝাতেন।

শনি, সোম, মঙ্গল এবং বৃহস্পতি সপ্তাহে এই চারদিন স্কুলের ভ্যানে করে আসে শিক্ষার্থীরা। সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে তাদের ক্লাস। প্রতি বছর দুইবার মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এখানে এসে এসব শিশুদের চিকিৎসা দেন, ওষুধও দেওয়া হয় বিনামূল্যে। স্কুল ড্রেস, ঈদের জন্য নতুন পোশাক, ঈদের জন্য খাবারও দেওয়া হচ্ছে স্কুল থেকে।  তিনি জানান, অস্বচ্ছল পরিবারের এসব শিক্ষার্থীদের রোজা বা ঈদেও নানা রকম সহায়তা করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি সহয়তায়।

হলি আর্টিজানে নিহত রবিউলের গড়া ‘ব্লুমস কাটিগ্রাম স্পেশালাইজড স্কুল’

এরকম একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে আসার জার্নিটা ছিল রবিউলের জীবনের অত্যন্ত কঠিন এক কাজ।

ওদের জন্য অনেক খাতা, কলম, রং পেন্সিল কামরুল ভাই (রবিউল ইসলাম) জমা করে রেখেছিলেন। সেগুলো দিয়েই এখনো চলছে- অন্যমনস্কভাবে বলেন শামীমা নাসরিন।

প্রশাসনিক পরিচালক এবং শিক্ষক হিসেবে ২০১২ সালে এই স্কুলে যোগ দেন জাহাঙ্গীর আলম। শুরুর দিকে এরকম একটি প্রত্যন্ত  গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে আসার জার্নিটা ছিল রবিউলের জীবনের অত্যন্ত কঠিন এক কাজ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই বাচ্চাগুলো যখন সংগ্রহ করতে যাই, তখন বাবা-মায়েদের বোঝাতে পারিনি। তারা আমাদের সরাসরি বলেছেন, এদেরকে স্কুলে নিয়ে তোমরা কী করবা, কী দরকার, কী হবে? তারা আমাদের ভুল বুঝেছে, কিন্তু রবিউল হাল ছাড়েনি। বিনা পয়সায়  শিক্ষার উপকরণ, উপহার, দুপুরের খাবার দেওয়াসহ নানাভাবে পরিবারগুলো আরো সচেতন করেছে রবিউল।

কিন্তু শিশুদের যথাযথ যে চিকিৎসা দেওয়া দরকার তার ঘাটতি রয়েছে এবং বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের সমস্যা হওয়াতে এতো বিশেষজ্ঞ তৈরি করা অনেক সময় সাপেক্ষ, কষ্টসাধ্য এবং অনেক ব্যয়বহুল মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, সেজন্য দুজন শিক্ষককে ইশারা ভাষা শেখানো হয়েছে, একজন শিক্ষককে কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার নিয়ে লেখাপড়া করানো হয়েছে।

সিডিডির (সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট) সহায়তায় প্রতিটি শিশুকে পরীক্ষা করার পর ১৪টি শিশুকে হিয়ারিং এইড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যাদের বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধীতা রয়েছে তাদের সমস্যা অনুযায়ী চেষ্টা করা হচ্ছে কিছু সমাধান করার। কারও কারও থেরাপি দেওয়ার দরকার- সেসবও করা হবে।

একইসঙ্গে কামরুলের স্বপ্ন ছিল গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত এসব বাচ্চাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা, কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা, সমাজে তাদেরকে স্বাভাবিক অবস্থান ফিরিয়ে দেওয়া। সেই চেষ্টাটা নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সকলের প্রচেষ্টায় আমরা সফল হবো বলে আশা করি।

কামরুল সব সময় অন্য রকম কিছু করতে চেষ্টা করতো মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানুষকে বিমোহিত করতে চাইতো, মানুষকে কাছে টানতে পারতো খুব, মানুষের ভেতরে চলে যেত সে তার ব্যবহার দিয়ে। বেঁচে থাকতে কামরুলের সেসব পাগলামিই এখন গ্রামের মানুষের কাছে, তার কাছের মানুষের কাছে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের হৃদয়ের কাছে রেখেছে।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ/এটি

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন