বিজ্ঞাপন

‘বাবা কি আর ফিরবে না’

July 1, 2018 | 8:44 am

।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ‘ছেলেটা তো খুব ছোট, তাই হয়তো সেভাবে বোঝে না। কিন্তু মেয়েটা বাবার অভাব বোধ করে খুব। এখনও বাবার কথা মনে হলেই কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই কখনও নিশ্চুপ হয়ে যায়। আবার কখনও বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, ‘মা, বাবা কি আর কখনও ফিরে আসবে না?’

কথাগুলো বলছিলেন দুই বছর আগে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় নিহত বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন খানের স্ত্রী কিম। তিনি বলেন, জঙ্গি হামলায় বাবাকে হারানোর শোক ও-লেভেলে পড়া মেয়ে সামান্তা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ভয়াবহ সেই হামলার পর পুলিশ ও প্রশাসনসহ সবার সহযোগিতা পেলেও পরিবারের মূল ব্যক্তিটিকে হারানোর যে শূন্যতা, তা কখনও কাটিয়ে ওঠার নয়— সে কথাও বলেন কিম।

শুক্রবার (২৯ জুন) সালাউদ্দিনের স্ত্রী কিমের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলা’র এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তাদের সন্তান দু’টি। দু’জনেই পড়ছে মোহাম্মদপুর গ্রিন হেরাল্ড স্কুলে। বড় সন্তান মেয়ে সামান্তা, এবার ও-লেভেল পরীক্ষা দেবে; ছোটটি ছেলে শ্যাম, পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আসাদ অ্যাভিনিউয়ে থাকছেন ওসি সালাউদ্দিনের স্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

কিম সারাবাংলা’কে বলেন, ‘সালাউদ্দিন মারা যাওয়ার পর গত বছরের ওই দিনটিতে (১ জুলাই) বনানী কবস্থানে গিয়ে পরিবারের সবাই মিলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে মিলাদ মাহফিল করা হয়েছে, গরীবদের খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ওই দিন ছেলে-মেয়েদের কষ্ট যেন বেশি হয়েছে। বাবার কথা মনে করে ওই দিন খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করেনি। ছেলে ছোট বলে হয়তো বাবার অভাব সেভাবে বুঝতে পারছে না; কিন্তু মেয়েটা বাবার অভাব অনুভব করে অনেক বেশি।’

সালাউদ্দিনের মৃত্যুর পর জীবনযাপনের ধারায় বড় ধরনের বদল এসেছে কিম-সামান্তা-শ্যামদের জীবনে। এখন যেন এক রুটিনের ঘোরটোপে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এই তিনজনের জীবন। কিম বলেন, ‘সালাউদ্দিনের রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছি। এখন আর বাসা থেকে খুব একটা বের হওয়ায় হয় না। অনেকটা বন্দি জীবনযাপন করতে হয়। ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা, স্কুলে যাওয়া-আসা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।’

এর মধ্যে মেয়েটা বাবার অভাব অনেক বেশি অনুভব করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সালাউদ্দিন ছুটি কিংবা অবসর সময় পেলেই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। সুযোগ পেলেই এখানে-ওখানে ঘুরতে নিয়ে যেত, বাইরে খেতে নিয়ে যেত, অনেক মজা করত। ছেলে-মেয়েকে অসম্ভব আদর করত। ছেলেটা তো ছোট, অত বুঝত না। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণ স্বপ্নের কথা বলত। মেয়েটাও বাবার খুব ন্যাওটা ছিল। এখনও বাবার কথা মনে হলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সামান্তা।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরো বলেন, ‘সালাউদ্দিনের একটা সাদা বিড়াল ছানা ছিল। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ওই বিড়াল ছানাটি এনেছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর বিড়াল ছানাটিকে অনেক আদর করত সামান্তা। গত মাসে কুকুর কামড়ে দিলে বিড়াল ছানাটি মারা যায়। সেটা নিয়েও সামান্তা অনেক কান্নাকাটি করেছে।’

সালাউদ্দিনের স্ত্রী বলেন, ‘বাবার অভাব তো আর পূরণ হওয়ার নয়। বাবা, বাবা-ই। আমার ছেলে-মেয়ের বেলাতেও সেটাই হয়েছে। মেয়ে অনেক সময় খেত না। বাবা এলে ঠিক একসাথে বসে খেত। সময় পেলে মেয়ে পড়তে বসলেও বসে থাকত মেয়ের পড়ার টেবিলে। এসব স্মৃতি মনে করলে সামান্তা নিজেকে সামলে রাখতে পারে না।’

কিম বলেন, “কখনও কখনও ছেলে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায় গেছে? আসবে কখন? সামান্তা তখন ওকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মাঝে মধ্যে রাগও করে। বলে, ‘বাবা কেন ওই চাকরি করতে গেল। আমাদের ছেড়ে কেন চলে গেল। আমাদের কথা কি বাবা একবারও ভাবেনি?’ আবার একটু পরই বাবার জন্য দোয়া করে আল্লাহর কাছে। বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিও।”

নিজেদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সালাউদ্দিনের স্ত্রী বলেন, ‘সারাবছর কোনোভাবে কাটলেও ১ জুলাইয়ের আগে ও পরের সময়টা খুব খারাপ যায়। এই দিনটাকে তো মেনে নেওয়া যায় না। সবকিছু ভুলে যেন ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখায় মন দিতে পারে, মানুষের মতো মানুষ হতে পারে, শত্রুরা যেন কোনো সুযোগ নিতে না পারে; সেজন্য মিডিয়ার সাথেও কথা বলা বন্ধ। বাসাতেও কাউকে আসতে দেওয়া হয় না।’ তিনি বলেন, এখনও হয়তো শত্রু পিছু ছাড়েনি। সালাউদ্দিন মারা যাওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জেও আর যাওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

গুলশান ট্র্যাজেডির পর পুলিশের সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা- জানতে চাইলে কিম বলেন, ‘ওই সময়ের পর থেকেই পুলিশ আমাদের পাশে ছিল, আছে। কিছু বলার আগেই তারা এসে হাজির হচ্ছেন। খোঁজ নিচ্ছেন, কিভাবে যাচ্ছে দিন। ডিএমপি কমিশনার থেকে শুরু করে আইজিপিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরাও আমাদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। ঈদের সময় সবাই নতুন কাপড়-চোপড় দিয়ে গেছেন। অন্যান্য উৎসবেও বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘সালাউদ্দিন মারা যাওয়ার পর অনেক আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু টাকাই কি সব? টাকা কি একজন মানুষের অভাব পূরণ করতে পারে? টাকা কি ছেলে-মেয়ের বাবা ডাক এনে দিতে পারে, ভালোবাসা, আদর-স্নেহের অভাব পূরণ করতে পারে? আমার ছেলে-মেয়ে তো বলে, কোনো টাকা-পয়সা-সম্পত্তির দরকার নেই, তুমি আমার বাবাকে এনে দাও।’

নিহত সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ স্বজন মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শিবলী নোমান সারাবাংলা’কে বলেন, সালাউদ্দিন মারা যাওয়ার পর সবসময় তার পরিবারের খোঁজ-খবর রাখছেন। ছেলে-মেয়েরা কী করছে, কেমন করছে- সব খবর রাখছেন তিনি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোঁরায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শুরুতেই তৎকালীন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান রেস্তোরাঁটিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন তিনি। এরপর জঙ্গিদের ছুঁড়ে দেওয়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রচণ্ডভাবে আহত হন ওসি সালাউদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল করিম। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে রাজধানীর গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

ভয়াবহ ওই জঙ্গি হামলার ঘটনায় ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় ও দুই বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন। সারারাত রেস্তোরাঁর অতিথি ও কর্মীদের জিম্মি করে রাখে জঙ্গিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাধিকবার চেষ্টা চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি জঙ্গিদের। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। পরে সেখান থেকে পাঁচ জঙ্গির সাথে রেস্তোরাঁর প্রধান শেফ সাইফুল ইসলামের লাশ উদ্ধার হয়। আর সাইফুলের সহকারী জাকির হোসেন শাওন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরে তাদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন