বিজ্ঞাপন

আনন্দ উদ্যানে অবিন্তার স্বপ্নের শিশুরা

July 1, 2018 | 10:15 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: অবিন্তার জীবনে তার মায়ের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। মাকে সে জীবনের রোল মডেল মনে করতো। মনে করতো যদি মেয়েদের ভালো শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে বড় হয়ে তারা পরিবারের সঠিক ভুমিকা রাখতে পারবে। সেসব কথা মাথায় রেখেই অবিন্তা মারা যাবার পর এই  অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ।

তবে অবিন্তার এ ইচ্ছার কথা পরিবার জানতে পারে সে চলে যাবার পর। কীভাবে, জানতে চাইলে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ও অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের এডুকেশন প্রোগ্রাম অফিসার মালিহা আহসান বলেন, অবিন্তা মারা যাবার পর তার ইমোরি ইউনির্ভাসিটি অক্সফোর্ড এর শিক্ষকরা অবিন্তার মা রুবা আহমেদের কাছে মেয়ের লেখা কিছু প্রবন্ধ পাঠান। সে প্রবন্ধে অবিন্তা সুবিধা বঞ্চিত মেয়ে শিশুদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল অবিন্তা।

বিজ্ঞাপন

অবিন্তা সেখানে লিখেছিল, মা ছিলো তার রোল মডেল। লিখেছিল, মা ওর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে। তাই সে বুঝতে পেরেছিল, ছোট মেয়েদের যদি একটি ভালো স্কুলে ভালো শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে ও যখন মা হবে তখন সেও সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

অবিন্তার সে ইচ্ছা আর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গত বছর ৫ জুলাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজধানীর ভাটারার সায়েদনগরে গড়ে উঠেছে এই স্কুল।

বিজ্ঞাপন

স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো স্কুল জুড়ে কেবল রঙের খেলা। শিশুদের হাতে আঁকা চিত্রাংকন গাঁথা রয়েছে স্কুলের দেয়াল জুড়ে, দেয়াল জুড়ে রয়েছে শিশু অবিন্তার আঁকা দৃশ্য।

সেখানেই পড়ছে, খেলছে সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা। স্কুলটি এসব শিশুদের কাছে এতোটাই জনপ্রিয় যে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে যেতে চায় না। তেমনি এক শিক্ষার্থী ছিল প্রথম শ্রেণির হোসনা। চলতি বছরের এপ্রিলে ৭ বছরের হোসনাকে নেত্রকোণাতে নিজের কাছে নিয়ে যান হোসনার বাবা। কিন্তু হোসনা সেখানে থাকতে নারাজ। কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা, তাকে কোনোভাবেই রাখা যাচ্ছে না গ্রামের বাড়িতে। তাই হোসনাকে নিয়ে আসা হবে ঢাকায়, সে লেখাপড়া করবে এই স্কুলে। হোসনার মতো হাবীব নূরী, বীথি আক্তার, কেয়া আক্তার, রিয়া আক্তারের মতো ভাটারা এলাকার সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নির্ভরতার নাম অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুল।

স্কুলের টিচাররা অনেক আদর করে, তারা বকে না, খুব সুন্দর করে সবকিছু শেখায়—সারাবাংলাকে জানায় দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবীবা নূরী। সে বলে, স্কুলে না এলে ভালো লাগে না, কারণ এখানে ‘মজাসহকারে’ লেখাপড়া করানো হয়।

বিজ্ঞাপন

২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস জঙ্গি হামলায় নিহত হন অবিন্তা কবির। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করতে পারার আকুলতা থেকেই তার পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুল। প্রচলিত স্কুলের চেয়ে এর ধরণ আলাদা সেটি বোঝা যায় স্কুলে প্রায় দেড় ঘণ্টা থেকেই। বিশাল প্লে গ্রাউন্ডে তারা খেলছে, নাঁচছে, বিভিন্ন লেগো দিয়ে বানাচ্ছে ঘরসহ নানান কিছু। দুপুরের মিল হিসেবে দেওয়া হয়েছে নুডলস, কাল হবে খিঁচুরি, পরশু স্যান্ডউইচ। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাবার খাচ্ছে, খেলছে, পড়ছে, আঁকছে-এ যেন শিশুদের এক আনন্দ উদ্যান।

মালিহা জানালেন, পাঁচ শিক্ষকের এই স্কুলটিতে প্রথম বছর ৩৬ জন শিক্ষার্থী প্রি কিন্ডার গার্টেনে দুটি সেকশন এবং কিন্ডার গার্টেনে একটি সেকশন নিয়ে শুরু হলেও চলতি বছরেই স্কুলে বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তবে প্রথম বছরে তাদেরকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না দিয়ে নানা ধরণের স্বাস্থ্য সচেতনামূলক, ভাষার ব্যবহারসহ প্রাত্যহিক জীবনের নানা আনুসঙ্গিক বিষয় শেখানো হলেও চলতি বছরে সিলেবাস মেনে লেখাপড়া শুরু হয়েছে।

প্রতি ক্লাসে এখন ১৬ জন করে প্রি কিন্ডার থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৬৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রতিবছর শ্রেণির কক্ষের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি করে গ্রেডও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন মালিহা। প্রথমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত থাকার কথা বলা হলেও কোনো মেয়ে যে পর্যন্ত পড়তে চাইবে সে পর্যন্ত তাকে পড়ানো হবে বলে জানান রুবা আহমেদ। সে শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা হবে।

কেমন করে এই এলাকা শিক্ষার্থী সংগ্রহ করলেন এ প্রশ্নে মালিহা বলেন, অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের কোর সদস্যরা এলাকাতে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু চলতি বছরে আমাদেরকে যেতেই হয়নি বরং তারা নিজেরাই এসছে এবং প্রকৃত দরদ্রি শিক্ষার্থী বাঁছাই করার জন্য অভিভাবকদের ইনটারভিউ এবং শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষাও দিতে হয়েছে।

স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে মাসিক হেলথ চেকআপ, ডেইলি মিল, পোশাক পরিচ্ছদসহ আনুসঙ্গিক সব কিছু দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। স্কুলটির লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রায় ৩ হাজরের মতো শিশুতোষ বই।

কেবল এই স্কুলটিই নয়, মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে রয়েছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। জানা গেল, অবিন্তা যেখানে পড়তেন সেই ইমোরি ইউনির্ভাসিটি অক্সফোর্ড কলেজ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য অবিন্তার নামে চালু করেছে একটি বৃত্তি। সেখানে অগ্রাধিকার পাবে বাংলাদেশের দরিদ্র কেউ, এরকম না পাওয়া গেলে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের শিক্ষার্থী। এই বৃত্তিতে কলেজের টিউশন ফি, বাসস্থান সুবিধাসহ আনুসঙ্গিক সুবিধাদি। চলতি বছরের ভারতের হায়দরাবাদের মোহাম্মদ সায়েদ নামের একজন এই বৃত্তি পেয়েছেন জানালেন মালিহা আহসান

কেবল মেধাবী শিক্ষাথীদের পাশেই নয়, অবিন্তা ফাউন্ডেশন কাজ করছে বৃদ্ধাশ্রম নিয়েও, যেখানে স্থান হবে শিশুদেরও-যেটি অবিন্তার আরেকটি স্বপ্ন ছিল।

একইসঙ্গে ফাউন্ডেশন বাড়ি করে দিয়েছে ১২টি গৃহহীন পরিবারকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ১০ জন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হচ্ছে অর্থনৈতিক সহায়তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে করা হয়েছে অবিন্তা সাইবার সেন্টার। এখন পর্যন্ত এই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা করা হয়েছে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষকে।

অবিন্তার জন্ম থেকে শুরু করে তার লেখা, আঁকা, স্বজনদের নিয়ে ভাবনা এবং অবিন্তা মারা যাবার তাকে নিয়ে লেখা সম্বলিত একটি বই ‘অ্যান ইনটিমেট পোট্রেট অব অবিন্তা কবির’।

সেখানে মাই ফিউচার ক্যাপশন দিয়ে অবিন্তার হাতে লেখা রয়েছে, ‘হোয়েন আই গ্রো আপ, আই উইল বি অ্যা টিচার। বিকজ, দ্যা কিডস ক্যান লার্ন রুলস অ্যান্ড বিহেভিয়র ফ্রম মি। আই উইল চিট দেম টু রিড অ্যান্ড রাইট। দেন দে উইল বি গুড কিডস। আই উইল বি হ্যাপি ইফ আই অ্যাম এ টিচার।’

পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিলো অবিন্তার ছোটবেলা থেকেই। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো ঠিক এই সময়ে এই পৃথিবীতে এ কারণেই জন্ম নিয়েছি যেন আমি আমার চেয়ে কম সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের জন্য কিছু না কিছু সহায়তা করতে পারি।’ এই কথাগুলো লেখা রয়েছে অবিন্তাকে নিয়ে করা ‘অ্যান ইনটিমেট পোট্রেট অব অবিন্তা কবির’ বইতে।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন