বিজ্ঞাপন

‘পাকিস্তান আমলেও শিক্ষার্থীদের ওপর এমন হামলা হয়নি’

July 8, 2018 | 4:43 pm

।। ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাবি: কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা পাকিস্তান আমলেও ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এমন হামলাকে হামলাকে দুঃখজনক, লজ্জানক ও অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটবে— এটা আমরা কখনও ভাবিনি। এমন ঘটনা পাকিস্তান আমলে ঘটেনি, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও ঘটেনি।’

রবিবার (৮ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দের’ পদযাত্রা শেষে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলন যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। সে জন্যই আমরা এর প্রতি ব্যাপক সমর্থন দেখেছি। ছেলেমেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, সমাজের অভিভাবকরা যেভাবে এতে সমর্থন দিয়েছে, তাতে বোঝা যায় ৫৬ শতাংশ কোটা অত্যন্ত অসঙ্গত এবং অন্যায়। সরকারও সেটা স্বীকার করেছে। স্বীকার করে কমিটি গঠন করবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু কমিটি গঠনে দেরি করায় শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলন করেছে। আমরা জানি, তারা আন্দোলন করেছে বলেই কমিটি গঠিত হয়েছে। আন্দোলন অব্যাহত না রাখলে কমিটি গঠিত হতো না। কিন্তু তারপর যে ঘটনা ঘটলো, তা নৃশংস, বর্বর এবং অবিশ্বাস্য।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা দেখলাম, যারা আহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে, রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া মানে কী ধরনের বর্বর অত্যাচার, আমরা জানি। মানুষের কোনো নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নেই, সেটা আমরা অনুভব করি।’

আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘তাদেরকে আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আহত শিক্ষার্থীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, সে ঘটনার তদন্ত করতে হবে।’ কোটা সংস্কারের দাবি সম্মানজনকভাবে দ্রুত সমাধানে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবাদ করলাম। সমাজে যে প্রতিবাদ চলে এবং চলছে, সেটি প্রমাণিত হবে।’

এর আগে, রোববার সকাল ১১টায় ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দের’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে পদযাত্রা বের করেন। কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনরতদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা এই পদযাত্রায় অংশ নেন। পরে শহীদ মিনারে গিয়ে পদযাত্রাটি শেষ হলে ঢাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খানের সঞ্চালনায় শিক্ষকদের একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞাপন

এ সময় উন্নয়ন অধ্যাপক বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘মৌলিক মানবাধিকারগুলো সমুন্নত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। মর্যাদা নিয়ে, জীবনের অর্থ নিয়ে বাঁচার সুযোগ যেন আমাকে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকারের কাছে আমাদের দাবি, নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক মানবাধিকার আমাদের দিতে হবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সদ্য সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি, বাংলাদেশ আসলে একটি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যখনই জনগণের একটি অংশ কোনো দাবি তোলেন তখন তাদের বলা হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপন্থী। বাংলাদেশ পাকিস্তানি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তার একটি দাবি ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু সেই চেতনা ভুলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেই হবে।’

ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ বলেন, ‘আমরা শিক্ষক ও ছাত্রদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। ভিন্নমতাবলম্বীদের গলা চেপে ধরার যে প্রচেষ্টা, তার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করছি। শিক্ষকদের উচিত ছিল ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে সমর্থন জানানো। কিন্তু আমরা দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারিনি। হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দায়িত্ব নেয়নি। ছাত্রদের হাসপাতাল থেকে বের করা দেওয়া হয়েছে, নিন্দাটুকুও জানানো হয়নি। আমরা কি আসলে একটা স্বাধীন দেশে বসবাস করছি? আমরা এই অবস্থার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

সংক্ষিপ্ত সমাবেশের সঞ্চালক ঢাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘আজ শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, মিথ্যা মামলা, গুম, গ্রেফতারের শিকার হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সেই শিক্ষর্থীদের দায় তারা নেবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, শিক্ষকদের এই অবস্থান অনৈতিক, ভয়ংকর, অমানবিক। এই অবস্থা ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় এবং বাংলাদেশে চলতে পারে না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ও ছেলেদের  হলগুলো যেন হিটলারের একেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প (বন্দি শিবির)। রাজশাহীতে সবার সামনে তরিকুলকে হাতুড়িপেটা করা হলো। এই হাতুড়ি প্রকৃত অর্থে প্রতিনিয়ত মারা হচ্ছে বাংলাদেশের মেরুদণ্ডে। যে মানচিত্র ১৯৭১ সালে তৈরি হয়েছিল, আজ সেই মানচিত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। সে কারণেই আমরা দেখছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যারা আছেন, তারা মেরুদণ্ডহীন ভাষায় কথা বলছেন। ক্ষমতার অন্ধত্ব যাদের মস্তিষ্কে পচন ধরিয়ে দেয়, তারা সাধারণ মানুষকে চিনতে পারে না। তারাই আজকে আমাদের নেতৃত্বে। এটি দুঃখজনক যে বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রশাসনে মস্তিষ্কহীন নেতৃত্ব। আমরা মনে করি, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কেউ নিরাপদ নই। এ জন্যই আজ আমরা সমবেত হয়েছি। একটি মানবিক বাংলাদেশের জন্য এভাবে সবাইকে সমবেত হতে হবে।’

ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাাকাল্টি অধ্যাপক আজফর হোসেন বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কথা বললেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল? মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষিত নীতি ছিল— সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার। কোথায় বাংলাদেশে আজ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাম্য, কোথায় আজ ন্যায়বিচার?’

তিনি বলেন, ‘যখন শিক্ষার্থীর ওপর হাতুড়ি পড়ে, তখন হাতুড়ি পড়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হাতুড়ি পড়েছে। আমরা দেখেছি ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছে, রাষ্ট্রের পুলিশসহ সব অ্যাপারেটাস সরকারের পক্ষে থেকে তাদের নিরাপত্তাকে দারুণভাবে বিঘ্নিত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে। কিন্তু আজকে তারা ছাত্রদের জন্য দাঁড়াচ্ছে না। একদল আছে সরকারের চামচা, তারা তো আসবে না। আরেকদল ভয় পাচ্ছে। প্রতিবাদ না থাকলে আমাদের পরাজয়।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা চার ধরনের অন্যায়ের স্বীকার হয়েছেন উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রথম অন্যায় হলো- তাদের হাতুড়ি পেটা করা হয়েছে, মেয়েদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অন্যায়, তাদের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জনগণের অর্থে পরিচালিত হাসপাতাল কাউকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। তৃতীয় অন্যায়, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ অন্যায়, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপবাদ দেওয়া হয়েছে।’

আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘এ দেশ এখনও মুসোলিনি বা হিটলারের দেশ হয়ে যায়নি। এ দেশে এখনও সংবিধান স্থগিত করা হয়নি, মার্শাল ল জারি করা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে যারা ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে ভয় পায়, লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে; আমরা মনে করি তারা নিন্দার যোগ্য।’ ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রতি নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি ছাত্ররা আক্রান্ত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, এমনকি প্রশাসনও তাদের পাশে এসে দাঁড়াত। সেখানে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।’

সারাবাংলা/কেকে/টিআর

আরও পড়ুন-

হামলার প্রতিবাদ করায় জবিতে ছাত্রলীগের হামলা

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন