বিজ্ঞাপন

আটক স্বর্ণ ভল্টে যেতে ৬ স্তরে নিরাপত্তা, ৩ স্বর্ণকারে যাচাই

July 24, 2018 | 12:12 pm

।।স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: চোরাই পথে আসা স্বর্ণ ধরা পড়ে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দরে। এছাড়াও বন্দর ইমিগ্রেশনকে ফাঁকি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া স্বর্ণও ধরা পড়ে কখনো কখনো। গোয়েন্দা পুলিশ ধরে গোপন খবরের ভিত্তিতে। শুষ্ক গোয়েন্দা, গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার নানা সংস্থাই স্বর্ণ ধরে। আর জব্দ কিংবা আটক হওয়া এসব স্বর্ণের একটাই গন্তব্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট। তবে মাঝে পার করতে হয় অনেকটা পথ অনেক প্রক্রিয়া।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত কাস্টমস,শুল্ক গোয়েন্দা বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্বর্ণ আটক করে। আর স্বর্ণ আটকের পর আইন অনুযায়ী নিকটস্থ কাস্টমস গুদামে স্বর্ণগুলো জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এজন্য কোনো সংস্থা স্বর্ণ আটক করার পর বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি কর্তৃক সার্টিফিকেটধারী স্বর্ণকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। আটককৃত স্বর্ণ পাকা বা খাঁটি কিনা সেটা নিশ্চিত হতেই এই বিধান।

সূত্র জানায়, সার্টিফিকেট ও আটক প্রতিবেদনসহ নিকটস্থ কাস্টমসের মূল্যবান শুল্কগুদামে সাময়িকভাবে জমা রাখতে নিয়ে যাওয়া হয় স্বর্ণগুলো। তখন কাস্টমস হাউসের গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও একবার স্বর্ণকার ডেকে স্বর্ণগুলো যাচাই বাছাই করে বুঝে নেন।

বিজ্ঞাপন

কাস্টমস হাউসের গুদাম কর্মকর্তা এসময় স্বর্ণ আটককারী সংস্থাকে একটি রিসিভ বা জিআর নম্বর (গোডাউন রেজিস্টার নাম্বার) দেন। আর সেই জিআর নম্বরে (রেজিস্ট্রার নাম্বারে) লেখা থাকে, কার কাছ থেকে পণ্যগুলো জমা রাখা হলো, কে জমা দিলো, কতো নম্বর সিরিয়ালে পণ্যটি রাখা হলো, পণ্যের বর্ণনা ও মূল্য। আর আটক প্রতিবেদনে বর্ণনাসহ গুদাম কর্মকর্তা পণ্যগুলো বুঝে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ থাকে এ সংক্রান্ত নথিতে।

এদিকে স্বর্ণ যখন কাস্টমস গুদামে যায়, অন্যদিকে একই সঙ্গে চলতে থাকে মামলার প্রক্রিয়া।

সূত্র জানায়, আটককৃত স্বর্ণের বিষয়ে সাধারণত দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটি ফৌজদারি মামলা, অপরটি কাস্টমস আইনে বিভাগীয় মামলা।

বিজ্ঞাপন

ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে নিকটস্থ থানায় গিয়ে কাস্টমসের এফআইআর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) ও আটক হওয়া নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন দাখিল করে মামলা দায়ের করা হয়। তবে এসব মামলার নিস্পত্তি হওয়ার আগেই আটককৃত স্বর্ণ শুল্কগুদাম থেকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখতে হয়।

এ লক্ষ্যে কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা আগেই বিভাগীয় কমিশনারের অনুমতি নেন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণ নিয়ে যাওয়ার আগে কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা নিকটস্থ থানায় নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহায়তা চান। এরপর পুলিশের একটি ইউনিট ও কাস্টমসের একটি ইউনিট সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ নিয়ে যায়। আটককৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে যেতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়োগকৃত চালক এবং গাড়িও রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পৌঁছানোর পর ভল্ট পর্যন্ত যেতে ছয় স্তরের নিরাপত্তার জাল পেরোতে হয়।

বিজ্ঞাপন

সে অবস্থার বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, ভল্টের চাবি থাকে দুইজনের কাছে। একজন জিএম পদ মর্যাদার কারেন্সি অফিসার। অপরজন ক্যাশ বিভাগের ডিজিএম। যিনি ক্যাশ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। ভল্টের দায়িত্বে থাকেন দুইজন জয়েন্ট ম্যানেজার। এদের একজন সাধারণ বিভাগের অপরজন ক্যাশ বিভাগের। চাবি হাতে পেতে এই দুই জয়েন্ট ম্যানেজারকে যৌথভাবে লিখিত আবেদন করতে হয়। এরপর তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের ভল্ট খুলতে পারেন।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে ঢুকতেই রয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপর ভল্টে যেতেও রয়েছে পাঞ্চ কার্ড, কলাপসিবল গেট ও তিনটি ডিজিটাল ও ম্যানুয়াল নিরাপত্তা সম্বলিত প্রবেশ পথ। এ নিয়ে ছয় স্তরের নিরাপত্তা পেরিয়েই ভল্টে পৌঁছা যায়।

আটককৃত স্বর্ণ সে পর্যন্ত পৌঁছালেই যে তা ভল্টে রেখে দেওয়া হবে তা নয়, জানায় সূত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেরও রয়েছে স্বর্ণ পরীক্ষা করার জন্য নিজস্ব নিয়োগকৃত স্বর্ণকার। যিনি প্রত্যেকটি স্বর্ণ একএক করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রত্যেকটি স্বর্ণের ক্যারেট ও মান নির্ণয় করেন। এতেও ব্যবহার করা হয় ম্যানুয়াল ও ডিজিটাল উভয় মাধ্যম। কষ্টিপাথরে স্বর্ণের খাঁটিত্ব নিরূপণ করার প্রচলিত ধারা রয়েছে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিখুঁত মাপের ব্যবস্থাও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আটককারী সংস্থার দাবির সঙ্গে ব্যাংকে আনা স্বর্ণের পরিমাণ ও গুনগত মান নিশ্চিত করেই স্বর্ণগুলো আলাদা আলাদা আলমারিতে রাখেন ভল্ট কর্মকর্তারা।

সূত্রটি জানায়, এসময় ভল্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা স্বর্ণের বিবরণ লেখেন। এরপর স্বর্ণের যাবতীয় বিবরণসহ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কাস্টমস হাউসের গোডাউন কর্মকর্তাকে একটি প্রত্যায়নপত্র দেয়া হয়। যে প্রত্যায়নপত্রে স্বর্ণকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে দায়িত্বরতরা ও কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তাও স্বাক্ষর করেন। আর সেই প্রত্যায়নপত্রেও স্বর্ণের মান, মূল্য, পরিমাণ সবকিছু লেখা থাকে। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা প্রত্যায়নপত্রটি তার নথিতে লিপিবদ্ধ করেন এবং তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেন।

কেবল যে নিরাপত্তা বেষ্টণী তাই নয়, ভল্টে গচ্ছিত মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট রয়েছে। যারা সার্বক্ষণিক ভল্টের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন। এর পাশাপাশি পুরো ভল্ট এলাকা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েও চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গুদামে স্বর্ণগুলো এতটা নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাখা হলেও এটিও একটি প্রাথমিক অস্থায়ী ব্যবস্থা। আটককৃত স্বর্ণের ওপর ফৌজদারি বা কাস্টমস আইনে বিভাগীয় মামলা চুড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বর্ণগুলো এই অস্থায়ী ভল্টে রাখা হয়। আর মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী ভল্টে জমা থাকা স্বর্ণ চলে যায় স্থায়ী ভল্টে। আর একটি নির্দিষ্ট সময় পর স্বর্ণগুলোর অকশন (নিলাম) হয়। অথবা নির্দিষ্ট একটি দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই স্বর্ণগুলো কিনে নেয়। আর সেই অর্থ আটককারী সংস্থার হিসাবে যুক্ত হয়।

এতটা সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমাকৃত স্বর্ণে হেরফের কেন? সে নিয়ে সারাবাংলার কথা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এতো নিরাপত্তা ও সতর্কতার মাঝে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। আর এটা বিশ্বাসযোগ্যও নয়। তবে যাই ঘটুক না কেন তদন্ত করে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভল্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে চাইলে যেকেউ ঢুকতে পারে না। আর ব্যবস্থাটিও অত্যন্ত পাকা।

তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় কোষাগার নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়েছে সরকারের উচিত দ্রুত তদন্ত কমিটি করে বিষয়টির সমাধান করা, বলেন এই সাবেক গভর্নর।

এতো নিরাপত্তা ও প্রক্রিয়ার পরও ভল্টে জমা থাকা স্বর্ণের মান ও পরিমান নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এর বাইরে এখন কিছুই বলা সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত স্বর্ণের ধরন ও পরিমাণ বদলে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ তুলকালাম হয়েছে। একটি জাতীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশের পরপরই তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পরে এ অভিযোগের জবাব দিয়েছে ব্যাংকটি। তারা বলেছে, বিষয়টি হিসাব নিকেশের গণ্ডগোল ছাড়া কিছু নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ খুরশিদ ওয়াহাব গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের ওই ভল্টে ঢোকার অধিকার চূড়ান্তভাবেই সংরক্ষিত। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও ঘাটতি নেই বলেই জানান তিনি।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন