বিজ্ঞাপন

টিজি-৩২১’র পাইলটের দক্ষতাকে বড় করে দেখছেন সবাই

July 28, 2018 | 6:07 pm

||জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট||

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: পাইলটের দক্ষতা, এয়ারক্রাফটের বড় আকার, দিনের আলো এমন নানা সমীকরণেই গত ২৫ জুলাই বড় একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছে থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩২১। তাতে বেঁচেছে কয়েক শ’ মানুষের প্রাণ।

তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা সব কিছু ছাপিয়ে মূল কৃতিত্ব দিতে চান ক্যাপ্টেনকেই। একটি উড়োজাহাজ অবতরণের সময় প্রধান নির্ভরতাই হচ্ছে এর চাকা। বলা হয় চাকাই সব। সেই চাকাই যখন ক্রটিযুক্ত তখন অবতরণ সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পড়ে। এমন সময় পাইলটের দক্ষতাই পারে ফ্লাইটের যাত্রীদের রক্ষা করতে। আর সে কারণে এভিয়েশন বিশেজ্ঞরা বারবার উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন পাইলটের। তারা বলছিলেন, খুব দক্ষ হাতে সামলানো হয়েছে বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।

সেই দুপুরে ফ্লাইটটিতে ছিলেন বিলাস দাশ। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই ছেলে। ঘটনার পরপরই বিলাস দাশ সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন। তিনি বলছিলেন, ‘বেঁচে থাকার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। আমাদের সবার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। আমরা যারা ছিলাম সকল আশা ছেড়ে দিয়েই ফ্লাইটে বসেছিলাম। আমাদের ওপর বিশেষ রহমত ছিল বলেই হয়তো আজকে বেঁচে বাসায় ফিরতে পেরেছি।’

বিজ্ঞাপন

থাই এয়ারওয়েজের শিডিউল অনুযায়ী, সেদিন বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা ছিল টিজি-৩২১ এর। কিন্তু শেখ পর্যন্ত সেটি দুপুর ১২টা ১৮ মিনিটে অবতরণ করাতে সক্ষম হন এর ক্যাপ্টেন।

কী ঘটেছিল ওই ২০ মিনিটে? সে প্রশ্ন করতে যাত্রী বিলাস দাশ বলছিলেন ‘আমাদের ফ্লাইটটি রানওয়েতে নামতে গিয়েও নামতে পারেনি। টাচ-ডাউনের ঠিক আগে আগেই পাইলট আবার উড়োজাহাজটি উপরে উঠিয়ে নিয়ে যান। পরপর তিনটি ল্যান্ডিং প্রচেষ্টা চালান।

বিলাস বলেন, আমি জানালার পাশে ঠিক চাকার কাছের সিটটিতে ছিলাম। বাইরে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাই, চাকা মাটিতে পড়ে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

মূলত অবতরণের সময় উড়োজাহাজটির একটি চাকা ফেটে গেলে সেটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিকটার রানওয়ের পাশের ঘাসের ওপর ছিটকে পড়ে। এতে ফ্লাইটের একটি চাকা ঘর্ষণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়, পরে ফেটে যায় অপর চারটি চাকাও। তবে ঘাসের ওপর ছিকটে পড়ার কারণেই উড়োজাহাজটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এবং তারা নিরাপদে এয়ারক্র্যাফট থেকে নেমে আসেন।

নাম প্রকাশ না করে একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ সারাবাংলাকে বলেন, আকাশে যখন একজন পাইলট জানতে পারেন তার চাকায় কোনও সমস্যা রয়েছে, তখন তিনি অবতরণের আগে কয়েকবার লো ফ্লাই করবেন। এটাই নিয়ম। উড়োজাহাজ লো ফ্লাই করলে গ্রাউন্ড থেকে ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দূরবিক্ষণে চাকার অবস্থা দেখে নেয় এবং ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলে। সেই ছবি চাকার কতোটুকু ড্যামেজ হয়েছে এবং কোন চাকার সমস্যা রয়েছে সেটা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে শেয়ার করা হয়। একই সঙ্গে বলে দেওয়া হয়, কোন চাকায় ভর দিয়ে ল্যান্ডিং হবে। সিস্টেমটাই এমন।

তিনি বলেন, দুই থেকে তিনবার অনেক সময় পাঁচ ছয়বারও এরকম লো ফ্লাই করতে হয় পাইলটকে। এখানে পাইলটের সঙ্গে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের যোগাযোগটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দৃষ্টিসীমা।

নেপাল বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি ছয়বার লো ফ্লাই করেছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ওই দিন দৃষ্টিসীমা কম ছিলো আর টেল উইন্ড বেশি ছিলো বলে সাতবারের সময় ক্যাপ্টেনকে বলা হয়- চাকা দেখা হয়েছে-কোনও সমস্যা নেই, তুমি নামতে পারো-তখনি কিন্তু উড়োজাহাজটি ল্যান্ড করেছে।

ইউএস-বাংলার ক্ষেত্রে অন্যান্য পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিলো, কিন্তু থাই এয়ারের বেলায় ঘটনাটি ঘটে দিনের বেলায়, আগে বৃষ্টি হয়ে গেলেও তখন বৃষ্টি ছিলো না ফলে আকাশে দৃষ্টিসীমা প্রশস্ত ছিল, আর সর্বোপরি গ্রাউন্ডের সঙ্গে যোগাযোগে কোনও ঘাটতি ছিলো না। সে কারণে পাইলট আস্থা ও দক্ষতার সঙ্গে ল্যান্ডিংয়ে যেতে পেরেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বোয়িং-৭৭৭ এয়ারক্র্যাফটি আকারে অনেক বড় হওয়াতেও দুর্ঘটনামুক্ত থাকা সম্ভব হয়েছে বলেও মন্তব্য এই বিশেষজ্ঞের।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্লেন ক্র্যাশ করবে এমন ধারণা নিয়েও ল্যান্ডিং হয়। পাইলট জানেন, ল্যান্ডিংয়ে উড়োজাহাজ ক্র্যাশ করবে। গ্রাউন্ডও জানে। আর সেক্ষেত্রে ক্যাজুয়ালিটি নিয়ন্ত্রণে গ্রাউন্ডে আগে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারসার্ভিসসহ অন্যান্য ব্যবস্থা আগে থেকেই নিয়ে রাখা হয়, বলেন এই বিশেষজ্ঞ।

২৫ জুলাইয়ের ঘটনায় তেমন গুরুতর কিছু ঘটে নি। আর তার পেছনে অবশ্যই পাইলটের দক্ষতা রয়েছে, বলেন তিনি।

‘কারণ বাম দিকে চাকা বার্স্ট হওয়াতে পাইলটকে ল্যান্ড করার সময় ডান দিকের চাকায় ভর করে নামতে হয়েছে। এতে ডান দিকে কাত হয়ে ল্যান্ডিং হয়। ফলে প্রথম প্রেসার পড়ে ডান চাকায়। ওই চাকা পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আগেই বাম চাকা নামানো হয়। আর গতি কমে এলে রানওয়ে থেকে দ্রুত পাশে সরে যেতে হয়। এটাই নিয়ম। তবে কাজটি করতে হয় চূড়ান্ত দক্ষতায়। টিজি-৩২১ এর পাইলটের দক্ষতা ছিল বিশাল ব্যাপার।’

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ওয়াহিদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ঘটনাটি নিয়ে খুব কনফিউশন রয়েছে। চাকা বার্স্ট করেছে ‘টাচ ডাউন’করার পরে। এবং এয়ারক্র্যাফটটি রানওয়ের শেষ গন্তব্যে গিয়ে ঘুরে তবেই বন্ধ হয়। যাতে বুঝা যায় আকাশে এর কোনও সমস্যা ছিল না।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন যাত্রীর কাছে শুনেছি, তিনবার নামতে গিয়েও নামতে পারেনি। হতে পারে পাইলট আগে থেকে সমস্যাটি বুঝতে পেরেছিলেন। হয়তো কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, সব ধরনের সতর্কতা নিয়ে তবেই ল্যান্ডিংয়ে গেছেন। এখানেই একজন পাইলটের দক্ষতা।

ওয়াহিদুল আলম বলেন, পাইলটের দক্ষতা বলতেই হবে, কারন পুরো রানওয়ে কাভার করে রানওয়ের একপাশে নিয়ে সে প্ল্যানটিকে পার্ক করিয়েছেন। আর সে কারলেই একটি বড় ধরণের দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছে অনেকগুলো প্রাণ।

তবে এটি ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং ছিল না, এমন মন্তব্য করে ওয়াহিদুল আলম বলেন, ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং হলে উড়োজাহাজের স্লাইডিং ডোর অটোমেটিক্যালি খুলে যায় এবং যাত্রীরা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এখানে স্লাইডিং ডোর খোলেনি এবং যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই বিমানবন্দর থেকে যাওয়া সিড়ি দিয়ে নেমেছেন। সো, ইট ওয়াজ নট ইমার্জেন্সি কেস বলেন ওয়াহিদুল আলম।

সবমিলিয়ে ইট ওয়াজ প্রোপারলি হ্যান্ডেলড, বলেন ওয়াহিদুল। তিনি বলেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিভিল অ্যাভিয়েশন সকলেই ভালো কাজ করেছে, কারণ তারা দুই ঘন্টার মধ্যেই রানওয়ে ক্লিয়ার করতে পেরেছে।

আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, চাকা নষ্ট হওয়া ছাড়া উড়োজাহাজটির আর কোনও ক্ষতি হয়নি মন্তব্য করে ওয়াহিদুল আলম বলেন, চাকা লাগানোর পর এক ঘন্টার মধ্যেই উড়োজাহাজটি ফিরতি ফ্লাইট অপারেট করেছে। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

সারাবাংলা/জেএ/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন