বিজ্ঞাপন

‘আমার গেছে সন্তান, শাজাহান খানের কাছে সংখ্যা’

July 30, 2018 | 7:35 pm

 ।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: কাল শুনলাম, মন্ত্রী শাজাহান খান নাকি বলেছেন—ভারতে ৩৩ জন মারা গেছে সেটা নিয়ে ওখানে এত হইচই হয় না, কথা বলে না? আর বাংলাদেশে দুজন মারা গেছে সেইটা নিয়ে এত কথা? মোবাইলে দেখলাম উনি হাসতেছিলেন। ক্যামনে পারলেন সে এমন ঘটনায় হাসতে হাসতে কথা বলতে। তার কাছে দুই জন মানুষ মরে যাওয়াটা কেবল সংখ্যা, কিন্তু আমারতো গেছে সন্তান…… বলে বুক চাপড়াতে লাগলেন জাহাঙ্গীর মিয়া।

কেবল জাহাঙ্গীর মিয়া নন, এই কষ্টের হাহাকার পুরো মহাখালীর দক্ষিণ এলাকা জুড়ে। আইসিডিডিআরবির উল্টোদিকে একটি চা দোকানের বিক্রেতা রুনা আক্তারের কাছে জানতে চাই—জাহাঙ্গীর সাহেবের বাড়ি কোন দিকে? রুনা আক্তার বলেন, আহারে! যে মেয়েটা মরে গেল সেখানে আসছেন? মেয়েটাকে চিনতেন প্রশ্ন করতেই চা বানানো থামিয়ে তিনি বলেন, চোখের ওপরে মেয়েটা বড় হইলো, সেই মেয়েরে চিনবো না? এই এলাকার সবাই সবাইরে চিনে বলে তিনি রাস্তার উল্টো দিকের আইসিডিডিআরবির পাশের গলি দিয়ে যেতে বলেন।

দিয়া খানম মিম

রাস্তা পার হলে গলিতে ঢুকে আবারও জাহাঙ্গীর সাহেবের বাসা কোথায় জানতে চাইতেই দোকান থেকে একজন সঙ্গী হলেন। অনেক খানি সরু পথ পেরিয়ে যে দুই রুমের বাসায় এসে থামলাম, তার দরজার মুখে অসংখ্য জুতা-স্যান্ডেল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না; এটাই জাহাঙ্গীর মিয়ার বাসা। গতকল জাবালে নূর বাস উঠিয়ে দেওয়া মিমের বাসা-‘মরা বাড়িতে’ সবাই ভিড় জমিয়েছে স্বান্ত্বনা দিতে।

বিজ্ঞাপন

ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই, মা রোকসানা বেগম বিলাপ করছেন, তাকে ঘিরে আছেন বড় মেয়ে রিয়া আর ছেলে আরাফাত। পাশে আত্মীয়-প্রতিবেশীরা, আছে মিমের কলেজ থেকে আসা সহপাঠীরাও।

তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হাজির হন মিমের বাবা জাহাঙ্গীর মিয়া। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি একনাগাড়ে কাঁদতে থাকেন, কথা বলতে বলতে খেই হারান। বলেন, বাস চালক হিসেবে তিনি এটা মানতে নারাজ যে, এটি একটি দুর্ঘটনা। তার ভাষায়, শিক্ষার্থীরা তো রাস্তার সাইডে দাঁড়াইয়া ছিল, আইল্যান্ডের ওপর দুইটা গাড়ি পাড়াপাড়ি কইরা উঠতে গিয়ে মাইয়া-পোলা দুইডারে মাইরা ফেলাইলো, এটাতো রোড অ্যাক্সিডেন্ট না, এটা হত্যা।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলতে থাকেন,  ‘আমি একজন বাস চালক। আমার মেয়ে মারা যাবার ঘটনা সবাই জাইনা গেছে। অথচ যে কোম্পানির বাস ইচ্ছা কইরা মারলো বাচ্চা দুইটাকে তারা কেউ আসলো না। মালিকপক্ষ দেখছে, পরিবহনের নেতৃবৃন্দরা দেখছে, ফেডারেশনের ভালো নেতৃবৃন্দরা দেখছে, কেউ শান্ত্বনা দিতে আইলো না। কেউ বললো না-তোমার মেয়েডারে আর ফেরত দিত পারমু না, কিন্তু তুমি শান্ত হও, বিচার চাও।’

জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘শাজাহান খান মন্ত্রী, নৌ পরিবহন মন্ত্রী-সে আবার বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি–সে একজন ভালো শ্রমিক নেতা, আবার সরকারের একজন মন্ত্রী। সেই নেতা বলছে, ভারতে ৩৩ জন মারা যায়, বাংলাদেশে দুজন মারা গেছে এতো কথা কেন? সে খালি দুইডা লোক দেখলো, দুইটা মানুষ আমি কষ্ট কইরা খাওয়ায়ে এ পর্যন্ত আনছি, আমি এতো কষ্ট কইরা এই পর্যন্ত আনছি কিন্তু তারাতো একটু দুঃখ, একটু শোক জানাইতে পারতো। অথচ সে হাসে আর বলে, বাংলাদেশে দুইটা লোক মারা গেলে কী হয়?

তার কাছে না হয় দুইটা মানুষ মারা গেছে, কিন্তু আমারতো গেছে সন্তান—আমি সন্তান হারাইয়া কেমনে আছি, সইটা তারা জানতে চাইছে, কেউ আসছে আমার কাছে?’

এ দেশের একজন নাগরিক তো আমিও। সে হিসেবে একটা বিচার চাই সরকারের কাছে, আমি খুব কষ্ট কইরা, লালান পালন কইরা এই পর্যন্ত আনছি-সেই মাইয়াডা আমারে শূন্য কইরা চইলা গেল—বলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

মেয়ে যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সেখানে আজ সকালেও গিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইজকাও সকাল বেলায় গেছি যেখানে আমার মেয়েডা মারা গেল। গিয়া দেখি, ছাতাটা পইরা আছে, স্যান্ডেল পইরা রইছে, ছাতিটা দেইখ্যা বইয়া বইয়া কান্দি। কেউ বললো, তুমি কাইন্দো না তুমি বিচার পাইবা।’

৩০ বছর ধইরা গাড়ি চালাই-এই জীবনে আইজন পর্যন্ত কোনো অ্যাক্সিডেন্ট করি নাই মন্তব্য করে তিনি বলেন, কিন্তু তারাতো এরাম অভিজ্ঞ ড্রাইভার দেখে না, পরিবহনের ড্রাইভারগুলো, নাই লাইসেন্স, নাই নিয়মকানুন। যারা নিয়মকানুন দেয় তারা টেকা-পয়সা খাইয়া দেয় বাসে উঠাইয়া। এই শহরে অদক্ষ ড্রাইভার দিয়া সব গাড়ি চলে।

বাবা জাহাঙ্গীর যখন কথা বলছিলেন তখন পাশে বসে মিমের সাত বছরের ভাই রিয়াদুল ইসলাম আরাফাত হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলো, আমার আপুকে যে বাস মেরে ফেললো আমি কেবল তার বিচার চাই, আর কিছু চাই না। আরেকটা ফ্লাইওভার দিয়া দিলে আপুর কলেজের সবার রাস্তা পার হইতে সুবিধা হইবো। আর সেটা যদি না করা যায় তাহলে সেখানে সেনাবাহিনী-পুলিশ আছে তারা যেন গাড়ি বন্ধ করে ছাত্র-ছাত্রীদের পারাপারের ব্যবস্থা করে দেয়। আমার আপুর মতো আর কেউ যেন বাসের চাপায় না মারা যায়।

এসময় পাশ থেকে সাব্বির হোসেন নামে এক আত্মীয় বলেন, কেউ মারা গেলে সরকার বলে ক্ষতিপূরণ দেবে, কিসের ক্ষতিপূরণ, একটা জীবনের বিনিময়ে কী দিয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়, কেমন করে সে জীবনের ক্ষতিপূরণ হয়।

দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে দিয়া খানম মিম ছিল দ্বিতীয়। বড় বোন রোকাইয়া খানম আর ছোট ভাই রিয়াদুল ইসলাম আরাফাত।

গতকাল কখন দুর্ঘটনার কথা জানতে পারলেন প্রশ্ন করলে জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, প্রতিদিন আমিই ওকে বাসে তুলে দেই। কিন্তু কাল দুপুরে আমার বাস নিয়ে রাজশাহী যাবার কথা। তখন মেয়েই ওর মাকে বলে, আব্বু একটু ঘুমাক তুমি আমাকে তুলে দিয়ে আসো। প্রতিদিন মেয়ে এভাবেই বাসে করে যেত কলেজে।

তারপর দুপুর একটার দিকে যখন বাসা থেকে বেরুলাম তখন একটা ফোনে মেয়ে কি রমীজ উদ্দিন কলেজে পড়ে বলে জানতে চায়। তাকে জ্বী বলতেই সে বলে, আপনি একটু তাড়াতাড়ি কুর্মিটোলা হাসপাতালে আসেন-এইটা শোনার পরই ভাবলাম, আমি রওনা দিয়া দেখি, সব বন্ধ-গাড়ি চলে না। পথে একজন মোটরসাইকেল দেখে বলি, ভাই আমাকে একটু নিয়ে যান হাসপাতালে।

কলেজের সামনে গিয়া দেখি ছাত্ররা মিছিল করতাছে। তাদেরকে বললাম, আমি মিমের বাবা। তখন তারাই নিয়ে যায় হাসপাতালের ভেতরে, আমি ভাবছিলাম হয়তো মেয়েটার অ্যাক্সিডেন্ট হইছে, চিকিৎসা হইতাছে। কতো কতো মানুষ-সবাইরে বললাম, আমার মেয়েটারে একটু দেখান।

তারপর সেনাবাহিনীর একজন অফিসার নিয়ে বলেন, আপনি একা আসেন আমার সঙ্গে। সে আমারে নিয়া গেল অন্ধকার একটা ঘরে, তালা মারা ঘরে, ঢাকা দেওয়া। তখন বুঝছি, আমার মেয়ে নাই।

তালা খুইলা দিলো-আমি আমার মা-রে দেখলাম, তারে বুকে জড়ায়ে ধরলাম, কিন্তু মা আমার আমারে আর আব্বু বইলা ডাকলো না।

মিমের বাবার সঙ্গে ছোট ভাই রিয়াদুল ইসলাম আরাফাত

মেয়েরে নিয়া আসতে চাইলাম। কিন্তু অফিসাররা বললো, এটা মামলা হবে, তারা ক্যান্টমেন্ট থানার পুলিশকে লাশ বুঝায়ে দেবে, পোস্টমর্টেম হবে। কিন্তু আমি আর মেয়েটাকে কাটা-ছাড়া করতে চাইলাম না, মেয়েটা তো এমনিতেই কতা কষ্ট পাইয়া মারা গেল, আর কতো কষ্ট করবে আমার মেয়েটা।

কিন্তু তারা দিতে চাইলো না, পরে পুলিশ এসে বাইরের পরিস্থিতি দেখে পোস্টমর্টেম ছাড়াই মেয়েটারে পাইলাম।

সকালে জানি যে, আমি মায় সাড়ে ছয়টায় উঠবো, সাতটায় কলেজে যাইবো। আমি আইজও ডাকছি-মিম, চলো মা, কলেজে যাই। কিন্তু আমার মায় আর আজকে উঠলো না, আমিতো ঘরে আর বইতে পারি না। পরে একলাই বাইরা গেলাম। বাস থেইক্যা নাইমা হাটতে হাটতে গেলাম আমার মা যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হইছে, যাইয়া দেখলাম-রাস্তার এক সাইডে ছাতিটা পইরা রইছে, ব্যাগের একটা টুকরা ছিড়া পইরা রাইছে, রাস্তা পরিষ্কার করতাছে।

আমি ছাতি হাতে বইয়া ছিলাম, আমার মায়ের পাশে বইয়া ছিলাম, কিন্তু মারে আর পাইলাম না।

শুনছি, বাসের মালিক শাজাহান খানের শ্যালক, কই কোম্পানির পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ আসলো না, অথচ কলেজের কতো ছাত্রছাত্রীরা আসছে, মিডিয়া আসছে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়রা আসছে, অথচ ২৪ ঘন্টা প্রায় হইয়া গেছে-তারা কেউ আসলো একটু, ফিরাইয়াতো দিতে পারবো না, একটু না হয়ে আসতো।

ঢাকাসহ আশেপাশের রাস্তার পাশের গার্মেন্টেসের দারোয়ানরা যদি রাস্তার গাড়ি থামায়ে তাদের কর্মীদের পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারে, তাহলে ক্যান্টেনমেন্টের মতো জায়গায় কেনো এতো বড় কলেজ, সেখানে ওভারব্রিজ কেন করা হয়নি, যেটা ছিল সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। গার্মেন্টেস মালিকরা যদি তাদের কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য গাড়ি থামায়ে দিয়ে ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে দেশের ভবিষ্যত সেসব শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তায় সরকার কেনো তাদের লোক দিয়ে নিরাপত্তা দিতে পারে না।

রাস্তা পার হবার জন্য কোনো কাটাও নেই, কেনো নেই প্রশ্ন করে তিনি বলেন, তারা যে কলেজটা হইছে এখানে শিক্ষার্থীরা কীভাবে পার হবে, সেখানে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা, পথচারীরা আইল্যান্ড লাফ দিয়ে পার হয়-শিক্ষার্থীরা কেনো ওভাবে পার হবে।

মিমের মা রোকাইয়া বেগম

মিমের মা রোকাইয়া বেগম পাশের ঘরে তখন জায়নামাজে বসে তসবীহ জপছিলেন আর বিলাপ করে কাঁদছিলেন। সেই ঘরে গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের ওপরে কারুকাজ করা একটি ছবির ফ্রেমে দুইবোন রিয়া আর মিমের একটি ছবি রাখা, টেবিলের ওপরে দেয়ালে টানানো রয়েছে বাবা-মা-দুই বোন আর ভাইয়ের অনেকগুলো ছবি দিয়ে বাঁধাই করা একটি ফ্রেম।

এই ঘরে থাকতো আমার মেয়ে—বলেন রোকাইয়া বেগম। আর বললেন, টি অ্যান্ড টি স্কুল থেকে পাস করার পর কেবল বলছিল, মা-আমারে রমিজ উদ্দিনে ভর্তি করায়ে দাও-আর কিছু চাই না, ওইটা ভালো কলেজ। আমি মেয়ের কথা শুনছিলাম, কিন্তু সেই কথা যে মেয়েরে আমার বুক থেকে কেড়ে নেবে-এটা যদি জানতাম তাহলে কোনোদিন মেয়ের কথা শুনতাম না, মেয়েটাকে তাহলে এভাবে হারাতো হতো না।

বড় বোন রোকাইয়া খানম রিয়া বলেন, আমার বোনটাকে হারিয়ে আমি অচল হয়ে গেলাম। আর ওর মতো সুন্দর আমাদের পরিবারের আর কেউ নেই। ও যখন চোখে একটু কাজল দিয়ে বাইরে বের হতো, আমরা নিজেরাই ওকে চিনতাম না। আমার সেই বোনটা চলে গেল-আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেল।

গতকাল রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে বিমানবন্দর সড়কে (হোটেল র‌্যাডিসনের উল্টো দিকে) বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও আব্দুল করিম নিহত হয় এবং অনেকেই সেখানে আহত হন।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন