বিজ্ঞাপন

‘আমরা আছি- যেন ওরা সাহস না হারায়’

August 3, 2018 | 1:19 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ছন্দা হাসানের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ আর ছোট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। দু’জনই ভিকারুন্নেছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী।

বৃহস্পতিবার (২ আগস্ট) বেলা পৌনে ১১টার দিকে বড় মেয়ে শান্তিনগর মোড়ে এসে দাঁড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। মা হয়ে তিনি আর বাসায় থাকতে পারেননি, ছোট মেয়েকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে নিজেও চলে এসেছেন। দাঁড়িয়েছেন মেয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে।

ছন্দা হাসান সারাবাংলাকে বলেন, দুইটা বাচ্চা মারা গেল। তার আগে রাজীব-রোজিনার কথা জেনেছি। আর প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে কতজন- সে হিসাবতো আমরা জানিই না।

বিজ্ঞাপন

“তাই দুই মেয়েকে নিয়ে আমি এসেছি। কারণ, আজ একজন মা হয়ে যদি ওদের পাশে, ওদের সঙ্গে না থাকি- তাহলে আমি নিজের সন্তানের কাছেই ছোট হয়ে যাব। ওরা কোনো অযৌক্তি আন্দোলন করছে না, কোনো অন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়নি। মীম আর করিমের মায়ের মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয় সেজন্য এসেছে- আমরা মায়েরাও তাই ওদের সঙ্গে আছি। কেবল আমি নই, এসব শিক্ষার্থীদের অনেকের বাবা-মা আজ এখানে সন্তানের সঙ্গে রয়েছেন, আমরা ওদের জন্য খাবার, পানি নিয়ে এসেছি। আমরা আছি ওদের সঙ্গে- যেন ওরা সাহস না হারায়।”

গতকাল ১ অগাস্ট নিরাপত্তার স্বার্থ বিবেচনা করে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় সরকার। তারপরও শিক্ষার্থীরা পুরো ঢাকা শহরের নানা জায়গায় জড়ো হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল ঢাকার বাইরেও।

বিজ্ঞাপন

শান্তিনগর মোড়ে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা সেখানে বিভিন্ন গাড়ির লাইসেন্স, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাই করেছে। তবে তারা খুবই সুশৃঙ্খলভাবে ছেড়ে দিয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ও হজযাত্রীদের গাড়ি। ছেড়ে দিয়েছে রোগী, বৃদ্ধ ও শিশুবহন করা রিকশা।

চাকরিজীবী সারোয়ার হোসেন মিন্টু কেবলমাত্র সন্তানের সঙ্গে থাকবেন বলে আজ ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুরোটা সময় শান্তিনগর ফ্লাই ওভারের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন। কখনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে চিৎকার করেছেন, ছেলে-মেয়েদের পানি খাইয়েছেন, বৃষ্টিতে সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় ছাতা ধরেছেন।

সারোয়ার হোসেন মিন্টু বলেন, শিক্ষার্থীরা গত পাঁচদিন ধরে রাস্তায়। যানবাহন কম। অফিসগামী মানুষ পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন- কিন্তু তাতে আমাদের কারো কষ্ট হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। পুরো জাতি এদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে। কারণ পুরো জাতির ক্ষোভের প্রতিফলন হচ্ছে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এদের কাছে ব্যর্থ হয়েছেন- কী করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সেটা এ কয়দিনে শিখিয়েছে এসব ছেলে-মেয়েরা।

নিজের নাম বললেন না আরেক বাবা। বৃষ্টির ভেতরে সন্তানের মাথায় ছাতা ধরে রাখলেন বৃষ্টির সময়টায়। বললেন, যা আমি পারিনি, আমরা পারিনি, সেটা ওরা করে দেখাচ্ছে। আমি কেবল ওদের পাশে দাঁড়িয়েছি।

ঠিক ১১টা বাজার আগে আগে শিক্ষার্থীরা শান্তিনগর মোড়ে জড়ো হতে থাকে। প্রথমে ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা থাকলেও পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, কমলাপুর শেরে বাংলা কলেজ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স উচ্চ বিদ্যালয়, স্টামর্ফোড ইউনিভার্সিটিসহ বেশকিছু স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

তাদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলে, ‘একটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল হয়ে ফুটবে কবে, সারা শহর উথাল পাতাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’/ ‘স্বাধীনতা তুমি, বাসের চাপায়-পিষ্ঠে যাওয়া দু’টি লাশ’।

এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তাদের ছোট ভাই-বোনেরাও। হাতে লেখা- ‘ভাইয়া এবং আপুরা- আমিও আছি তোমাদের সাথে’ / ‘নিরাপদ সড়ক আমিও চাই’/ ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও- তবেই তুমি বাংলাদেশ’ / ‘সাবধান-রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজ চলতেছে’ / ‘আমরা ১৮- দয়া করে মিথ্যা আশ্বাস দেবেন না’।

শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে। দুপুর গড়াতেই সেখানে বিস্কিট, চিপস, পানি, স্যালাইনসহ হাজির হন অনেক অভিভাবক।

এসব শিক্ষার্থীরা রাস্তার ওপর পরে থাকা চিপস, বিস্কিটের প্যাকেট রাখার জন্য প্লাস্টিকের ঝুড়িও রাখে। শিক্ষার্থীরা হাতে ধরে ঝুড়ি নিয়ে যায় প্রত্যেকের কাছে। তারা বলে, দেশটা আমাদের। আমিই কাল এ রাস্তা দিয়ে যাব। নিজেরা নোংরা করে যদি নিজেরা সেটা পরিষ্কার না করি তাহলে দায় আমাদের।

গত ২৯ জুলাই বাস চালকদের রেষারেষিতে জাবালে নূর পরিবহনের বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টেনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আরো কয়েকজন।

পর দিন থেকেই সড়ক দুর্ঘটনার নামে ‘মানুষ হত্যা’ বন্ধে রাজপথে নামে কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরো কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে দিন যতই যাচ্ছে, এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে ঢাকার প্রায় সবক’টি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সারাবাংলা/জেএ/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন