বিজ্ঞাপন

শিশুরা বার্তা দিয়েছে, শিখতে হবে রাষ্ট্রকে

August 4, 2018 | 12:01 am

।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: রাজধানীর রাজপথে বাসের রেষারেষিতে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় গড়ে ওঠা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এ আন্দোলনে সব স্তরের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং কিছু সৃজনশীল সংশোধন বার্তায় এরই মধ্যে তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর এমন বড় কোনো আন্দোলন এ দেশে হয়নি, যে আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। কেবল সামাজিক পরিবর্তন এবং অনিয়মকে নিয়মে আনার বার্তা রয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করে তুলবে। অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণকে হতে শেখাবে প্রতিবাদী।

তবে এটাকে কেবল সামাজিক আন্দোলন হিসেবে না নিয়ে তরুণরা যদি কেবল আমিত্ব কিংবা ‘হিরোইজম’ প্রদর্শনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিয়ে নেয়, তবে সেক্ষেত্রে সামাজিক ঝুঁকি বাড়তে পারেও বলে আশঙ্কা রয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, শিক্ষার্থী আন্দোলনের মূল মেসেজ সম্পর্কে প্রায় সব তরুণই সচেতন। তাই এমনটি হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি নেই।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা যেমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তেমনি তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে সরকারের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে অনেক অনিয়ম-অবব্যস্থাপনার ফল এ আন্দোলন। যুগের পর যুগ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা ধুলো যখন ডাস্টবিনে পরিণত হয়, তখন তুমুল সুনামিই পারে তা পরিষ্কার করতে। শিক্ষার্থীরা সে সুনামি হয়েই এসেছে। এর থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে কেউ আর সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখবে না।

আন্দোলনকে পুঞ্জীভূত অবব্যস্থাপনার ফল হিসেবে উল্লেখ করে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সারাবাংলা’কে বলেন, সাম্প্রতিককালের একাধিক দুর্ঘটনার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। তারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করছে, লাইসেন্স দেখছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার। কেননা এ কাজের জন্য নাগরিকদের টাকায় একটা বিশাল গোষ্ঠী পোষা হয়। তারা তাহলে এত বছর কী করেছে?

বিজ্ঞাপন

এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘এখন দেখা যাচ্ছে অনেকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, গাড়ির কাগজপত্র নেই। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের নজরে কি এগুলো পড়েনি? ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট একটি উদাহরণ মাত্র। মূলত শিক্ষার্থীরা এমন সব অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে বার্তা দিতে চায়, যেগুলোতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।’

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে ‘সামাজিক আন্দোলন’ আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা, ন্যায় কিংবা আইনের সঠিক প্রয়োগের অনুপস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। যার ফল শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি কোণায় যে অনাচার, তাতে এমন একটা বড় সামাজিক আন্দোলন ছিল সময়ের দাবি।’

সামাজিক আন্দোলন যেকোনো সময় সরকারের জন্য একটা প্রেশার। এ প্রেশারের কারণে হলেও সরকার সংশোধনের উদ্যোগ নেবেন— এমন মন্তব্য করে জিয়া রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র এখন মোটিভেশন দিতে পারে। কেননা রাষ্ট্র যা পারেনি তারা তা করে দেখিয়েছে। সেখানে তাদের উৎসাহিত করলে এরা বিপথগামী হবে না।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক আন্দোলনের ঝুঁকি সম্পর্কে এ অধ্যাপক বলেন, ‘প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনের কিছু ঝুঁকিও থাকে। যেহেতু এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বেশিরভাগই বয়সে একেবারে তরুণ, তাই পরিবার ও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা থাকে। তবে এসব শিশুদের দায়িত্ব এখন অভিভাবকদের। তারা তাদের বোঝাতে পারে, তোমরা যেটুকু করেছ, সেটুকু তোমাদের দায়িত্ব ছিল। এখন নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে এ সামাজিক আন্দোলন একদিন তোমাদেরই পীড়া দেবে।’

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘এটা সামাজিক আন্দোলন। যেকোনো দেশের নাগরিকের সামাজিক আন্দোলন করবার অধিকার আছে। এখানে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, যারা এখনও নাগরিক হয়ে ওঠেনি তারাই এই লড়ায়ের সামনে আছে। তার কারণ, তারা যখন রাস্তাঘাটে চলে, এই অনিরাপদ সড়কে তাদেরই বেশি ভুগতে হয়। আমাদের যাদের বয়স হয়েছে, তাদের কিন্তু হয় না। আমরা গাড়িতে চড়ি, হেঁটে যাই। কিন্তু তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেই কারণে এই আন্দোলনটা নিশ্চয় প্রয়োজন ছিল। তাদের দাবির সঙ্গে আমি একমত।’

দিনের পর দিন রাস্তায় এমন আন্দোলন চালানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাজ তারা করে দেখিয়েছে। এখন বাকি দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে রাষ্ট্রের লজ্জিত হওয়া উচিত। তাদের সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

এইভাবে সমাধান হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সামিনা বলেন, ‘এইভাবে সমাধান হবে না। সরকারকে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে হবে। তাহলে সমাধান হয়ে যাবে। তারপর ধীরে ধীরে মেকআপ করতে হয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘কথায় আছে, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কিন্তু কোনো উপায় থাকে না। এখানেও আমার যেটা মনে হয়, ঠিক সেই বিষয়টিই ঘটছে। শিক্ষার্থীরা দেখছে যে এত দুর্ঘটনা হচ্ছে, তার কোনোটার কোনো সুরাহা বা কূল-কিনারা হচ্ছে না। জিনিসটা দিন দিন খারাপই হচ্ছে। আসলে ওরা প্রতিবাদ ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। এই আন্দোলনটাকে ওটারই বহিঃপ্রকাশ আমরা বলতে পারি। আসলে আন্দোলনটা কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য না। তারা চাচ্ছে সরকারিভাবেই তাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হোক। এখন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তারা রাস্তায় নেমেছে।’

আরও পড়ুন-

‘পরিবহন ধর্মঘটের নেপথ্যে নৌমন্ত্রীর ফেডারেশন’

ভাঙচুর বন্ধ করুক তারপর বাস চলবে: মালিক সমিতি

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ‘কবজায়’ নেওয়ার চেষ্টায় জামায়াত: ডিবি

সারাবাংলা/এমএস/কেকে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন